খোলা বাজারে ডলারে দাম হঠাৎ অস্থির হয়ে উঠেছে। প্রতি ডলারের দাম ১২৮ টাকা ছাড়িয়ে গেছে। রোববার (২২ ডিসেম্বর ) ব্যাংকপাড়া খ্যাত মতিঝিল, পুরানা পল্টনে এমন চিত্র দেখা গেছে।
আজ সোমবার সকাল থেকে মতিঝিল ও পল্টনের বিভিন্ন মানি এক্সচেঞ্জে প্রতি ডলার ১২৭ টাকা ৬০ পয়সা থেকে ১২৮ টাকায় বিক্রি করতে দেখা গেছে। চাহিদার তুলনায় জোগান তুলনামূলক কম থাকায় প্রতিনিয়ত হু হু করে ডলারের দাম বাড়ছে বলে জানাচ্ছেন অনেকে।
হঠাৎ ডলারের বাড়তি দামের বিষয়টি অনুসন্ধান করতে সরেজমিনে রাজধানীর কয়েকটি মানি এক্সচেঞ্জ হাউসে খোঁজ নেওয়া হয়।
দেখা গেছে, ডলার কিনতে গেলে প্রকৃত গ্রাহক নিশ্চিত করার পর ডলারের দাম ১২৮ টাকা ২০ পয়সা পর্যন্ত হাঁকছেন মানি চেঞ্জারের লোকজন। বেশি ডলার কিনতে চাইলে দাম কিছুটা কমে বিক্রি করতে চাইছে। অথচ মাত্র ১০ দিন আগেও খোলা বাজারে ১২৩-১২৪ টাকায় লেনদেন হয়েছে ডলার।
তবে ডলারের গ্রাহককে গণমাধ্যমকর্মী বা বাংলাদেশ ব্যাংকের টিম কিংবা সরকারি কোনো এজেন্সির লোক সন্দেহ হলে ডলার নেই জানিয়ে দিচ্ছেন তারা। কত দামে বিক্রি হচ্ছে জানতে চাইলে বোর্ডে লেখা ‘ক্রয় ১২০ টাকা, বিক্রয় ১২১ টাকা’ দেখিয়ে দিচ্ছেন। সব মানি এক্সচেঞ্জের বোর্ডে সাইনপেনের অস্থায়ী কালি বা চক দিয়ে লিখে রাখা হয়েছে ক্রয় ১২০ টাকা, বিক্রয় ১২১ টাকা।
মতিঝিলের গ্লোরি মানি এক্সচেঞ্জের কর্মকর্তা আদিলুর রেজা বাংলানিউজকে বলেন, ‘এখন ডলার সংকট, বিক্রি করতে পারছি না। আবার ডলার এলে বিক্রি হবে। ’
বাড়তি দাম বিক্রি করা হচ্ছে – এমন কথা বললে আদিলুর বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের বেঁধে দেওয়া কেনা ১২০ টাকা আর বিক্রি হচ্ছে ১২১ টাকা দামে।
দিলকুশার গ্লোরি মানি এক্সচেঞ্জ থেকে বের হয়েই বাইরে দেখা যায়, মানি এক্সচেঞ্জের এজেন্টরা পথচারীদের কাছে গিয়ে কানে কানে ডলারের বিভিন্ন দাম বলছেন। কম ডলার কিনলে ১২৮ টাকা ২০ পয়সা, আর বেশি কিনলে ১২৭ টাকা ৭৫ পয়সা থেকে ১২৮ টাকা ২০ পয়সা পর্যন্ত দামে বিক্রি করতে চাইছে। আবার ডলার কিনতে ১২৪ থেকে ১২৬ টাকা পর্যন্ত দাম দিতে চাইছে। তবে তারা কোনো মানি এক্সচেঞ্জে বা অফিসে যেতে রাজি নন; ফুটপাতে বা গলিতে ডলার কেনাবেচা করছেন।
সরেজমিনে মতিঝিল ও পুরানা পল্টনের ২০টি মানি চেঞ্জারে বাড়তি দামে ডলার কেনা-বেচা করতে দেখা গেছে। এদিকে হঠাৎ করে ডলারের চাহিদা বেড়ে যাওয়ার কিছু অসাধুচক্র এর সুযোগে বাজারে অস্থিরতা তৈরি করছে।
বিষয়টি জানতে বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট একাধিক দায়িত্বপ্রাপ্ত ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলা হলেও তারা নাম উল্লেখ করে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।
একজন দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা বাংলানিউজকে বলেন, যারা ডলারের দাম বেশি নিচ্ছে, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। পাশাপাশি ব্যাংকগুলো বেশি দামে ডলার কেনার কারণে খোলা বাজারেও বেশি দামে কেনা-বেচা হচ্ছে এমন ইঙ্গিত দেন তিনি।
তবে বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি সূত্র জানায়, ৬টি ব্যাংক বেশি দামে ডলার কেনায় প্রভাবে পড়েছে নগদ ডলার বাজারে। গত কয়েকদিনেই বাংলাদেশ ব্যাংক নির্ধারিত দামের তিন থেকে চার টাকা বেশিতে বিক্রি হচ্ছিল। বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর ডলার কিনতে বেপরোয়া হওয়ার কারণে খোলা বাজারেও ডলারের টান পড়েছে। তারই ধারাবাহিকতায় এক লাফে ডলারের দাম বেড়ে ১২৮ টাকা অতিক্রম করেছে।
অথোরাইজ ডিলার ব্যাংক ১২৫ টাকার বেশি দামে ডলার কিনছে। তাই বাড়তি দামে ডলার ক্রয় বা বিক্রয় করা ছাড়া উপায় নেই।
যারা বেশি দামে ডলার ক্রয়-বিক্রয় করছে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার উপায় নেই বলে মন্তব্য করেন মানি চেঞ্জার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশর সভাপতি এম এস জামান।
তিনি বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক ডলার ক্রয়ে ১২০ টাকা বেঁধে দিয়েছে। সর্বোচ্চ এক টাকা বাড়িয়ে ১২১ টাকায় ডলার ক্রয় বা বিক্রয় করতে পারে। বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা মানতে হলে ১১৯ টাকা বা ১২০ টাকা দরে ডলার কিনে ১২০ বা ১২১ টাকা দরে ডলার বিক্রি করতে হবে। কিন্তু ব্যাংকই যখন ১২৫ টাকা দামে ডলারের কিনে, সেখানে মানি চেঞ্জাররা ১২০ টাকায় কীভাবে কেনা-বেচা করবে, এটা কোনোভাবেই সম্ভব না।
তিনি বলেন, মানি এক্সচেঞ্জ হাউজগুলো লাখ লাখ টাকা বিনিয়োগ করে, অফিস-কর্মচারীর বেতন দেয়। তারা তো লোকসান দেবে না। মতিঝিলের অলিগলিতে ১২৮ টাকা দামে ডলার কেনা-বেচা হচ্ছে। খারাপ সিস্টেমের কারণেই তারা এটা করছে। বাড়তি দামে ডলার কেনাবেচা করা ব্যক্তিরা মানি এক্সচেঞ্জের লোকজন হতে পারে, আবার ব্যাংকের লোকজনও হতে পারে। কে কাকে ধরবে!
তিনি আরও বলেন, মানি চেঞ্জারদের ডলার উৎস প্রবাসফেরত লোকজন, ব্যবসায়ী ও বিদেশে ঘুরতে যাওয়া মানুষ। বিদেশ থেকে ফেরা ব্যক্তিরা তাদের বেঁচে যাওয়া ডলার মানি চেঞ্জারদের কাছে বিক্রি করেন। বিদেশে এসব লোক বাংলাদেশে বাড়তি দামে ডলার কেনেন। দেশে এসে তো কম দামে বিক্রি করবে না বা যে প্রবাসী বিদেশ থেকে ব্যাংকিং চ্যানেলে প্রণোদনাসহ ১২৫ টাকা দরে দেশে ডলার পাঠান তিনি কখনো দেশে এসে লোকসান দিয়ে বিক্রি করবেন না।
মুদ্রা বিনিময়কারী প্রতিষ্ঠানের এই নেতা বলেন, বৈশ্বিক মূল্যস্ফীতির কারণে ডলার দামে বেড়ে গেছে। বাংলাদেশেও মূল্যস্ফীতি বেড়েছে। তাছাড়া ডিসেম্বরে মানুষ দেশে কম আসছে। সব জায়গায় ডলারের দাম বেড়েছে, ডলারের দাম ১২০ টাকার মধ্যে ধরে রাখার কথা মুখে বললেও বাস্তবে সম্ভব নয়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের অন্য একটি সূত্র জানিয়েছে, সন্দেহভাজন অন্তত ১৩টি ব্যাংকের কাছে ডলার কেনাবেচার তথ্য তলব করেছে। সংশ্লিষ্ট একাধিক ব্যাংক থেকেও এমন খবর পাওয়া গেছে। একই সঙ্গে বৈদেশিক মুদ্রাবাজার স্থিতিশীল করতে মনিটরিং কার্যক্রম জোরদার করা হয়েছে।
ব্যাংকের মতো খোলাবাজারেও রোববার ডলারের লেনদেনের ঘোষিত দর ১২০-১২১ টাকা ছিল। যা গত জুনে ছিল ১১৯-১২০ টাকা এবং গত বছরের ডিসেম্বরে ছিল ১১২-১১৩ টাকা। সে হিসাবে এক বছরে বেড়েছে প্রায় আট টাকা। তবে বিদ্যমান বাজারের তুলনায় বেড়েছে ১৬ টাকা।