সংবিধান সংস্কার কমিশন ছাড়াও বুধবার (১৫ জানুয়ারি) প্রতিবেদন জমা দিতে যাচ্ছে নির্বাচনব্যবস্থা, দুর্নীতি দমন ও পুলিশ সংস্কার কমিশন। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে তারা এই প্রতিবেদন জমা দেবে।
সোমবার (১৩ জানুয়ারি) চার কমিশন সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
সংবিধান সংস্কার কমিশন সূত্র জানায়, দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ ও ক্ষমতার ভারসাম্যের সুপারিশ করতে যাচ্ছে তারা। খসড়া প্রস্তাব অনুযায়ী, সংসদের নিম্নকক্ষে আসন থাকবে ৪০০টি। আর নির্বাচন হবে বর্তমান পদ্ধতিতে। এর মধ্যে ১০০ আসন নারীদের জন্য সংরক্ষিত থাকবে, তারা নির্বাচিত হবেন সরাসরি ভোটে। আর উচ্চকক্ষে আসন থাকবে ১০৫টি। সেক্ষেত্রে নির্বাচন হবে আনুপাতিক পদ্ধতিতে। সংসদের এই দুই কক্ষ মিলিয়ে মোট আসন হবে ৫০৫টি।
এ ছাড়া সাংবিধানিক একনায়কতন্ত্র ঠেকাতে বা এক ব্যক্তির হাতে যাতে ক্ষমতা কুক্ষিগত হয়ে না যায়, সে জন্য ক্ষমতার ভারসাম্য আনতে আরও কিছু সুপারিশ করবে এই কমিশন।
এর বাইরে, জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার সর্বনিম্ন বয়স ২৫ বছর থেকে কমিয়ে ২১ বছর করারও সুপারিশ করা হবে বলে জানা গেছে কমিশন সূত্রে।
এদিকে, বিএনপিসহ বেশ কিছু রাজনৈতিক দল দীর্ঘদিন ধরেই দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদের কথা বলে আসছে। ইতোমধ্যে বিএনপি লিখিতভাবে সংবিধান সংস্কার কমিশনকে যে ৬২ দফা প্রস্তাব দিয়েছে, সেখানেও তারা দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ গঠনের কথা বলেছে। এ ছাড়া জাতীয় নাগরিক কমিটিও দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদের প্রস্তাব দিয়েছে।
এর বাইরে, সংবিধান সংস্কার কমিশন ও নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের মতবিনিময়েও অংশীজনদের অনেকে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ চালুর প্রস্তাব দিয়েছেন।
এ বিষয়ে সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রধান অধ্যাপক আলী রিয়াজ গণমাধ্যমকে বলেন, ক্ষমতার ভারসাম্য শুধু রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে না। সরকারের নির্বাহী বিভাগকে দায়বদ্ধ রাখতে এবং প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার অপব্যবহার রোধ করতে আরও প্রতিষ্ঠান তৈরি করে ক্ষমতার ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা করা হবে।
নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশন সূত্র জানায়, দীর্ঘ মেয়াদে অবাধ, নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানে একটি কার্যকর ব্যবস্থা গড়ে তোলার লক্ষ্যে প্রস্তাব তৈরি করছে তারা। এ জন্য নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালী করতে আইন পরিবর্তনের পাশাপাশি কিছু প্রাতিষ্ঠানিক পরিবর্তনেরও সুপারিশ করবে কমিশন।
এ বিষয়ে নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের প্রধান বদিউল আলম মজুমদার গণমাধ্যমকে বলেন, বুধবার প্রতিবেদন জমা দেওয়া হবে। সেখানে কমিশনের সুচিন্তিত মতামত থাকবে। সেই সুপারিশগুলো নিয়ে সরকারের ভেতরে ও রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা হবে।
তিনি আরও বলেন, আশা করি, এর মধ্য দিয়ে একটি ঐকমত্যে পৌঁছানো যাবে।
দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) সংস্কার কমিশন সূত্র জানায়, তারা দুদকের চেয়ারম্যান ও কমিশনার নিয়োগ আইনে সংশোধন আনার প্রস্তাব দেবে। পাশাপাশি দলীয় প্রভাবমুক্ত ও যোগ্য ব্যক্তিদের একটি স্বচ্ছ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে কীভাবে নিয়োগ দেওয়া যায়, তার একটি রূপরেখাও সেখানে থাকবে।
এর বাইরে, সংস্কার কমিশন দুদকের সচিব থেকে পরিচালক পর্যায়ের পদে সরকারি কর্মকর্তাদের নিয়োগ না দেওয়ারও সুপারিশ করবে।
এ বিষয়ে দুদক সংস্কার কমিশনের প্রধান ইফতেখারুজ্জামান গণমাধ্যমকে বলেন, কমিশন বুধবার প্রধান উপদেষ্টার কাছে প্রতিবেদন জমা দেবে।
এছাড়া পুলিশ সংস্কার কমিশন সূত্র বলছে, আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোকে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত করার পাশাপাশি তাদের যেসব সদস্য অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে যুক্ত হয় তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি এবং জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার ওপরও জোর দেবে কমিশন। এ ছাড়া ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৪ ধারায় বিনা পরোয়ানায় গ্রেপ্তার এবং ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৭ ধারার অধীনে রিমান্ডে থাকা ব্যক্তিদের সঙ্গে আচরণের বিষয়ে হাইকোর্ট ও আপিল বিভাগের নির্দেশনা অনুসরণ করে একটি নির্দেশিকা তৈরিরও প্রস্তাব দেবে কমিশন।
এর বাইরে, প্রাণঘাতী নয় এমন অস্ত্র পুলিশের হাতে দেওয়ার জন্যও সুপারিশ করবে পুলিশ সংস্কার কমিশন।
এ বিষয়ে পুলিশ সংস্কার কমিশনের প্রধান সফর রাজ হোসেন গণমাধ্যমকে বলেন, আগামীকাল (বুধবার) কমিশন তাদের প্রতিবেদন জমা দেবে।
সংস্কার কমিশনগুলোর প্রতিবেদন পাওয়ার পর রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপে বসবে অন্তর্বর্তী সরকার। চলতি মাসেই সেই আলোচনা শুরু হতে পারে। সবমিলিয়ে সংস্কার প্রস্তাব ও এগুলোর বাস্তবায়ন নিয়ে ঐকমত্য তৈরি হলে সংলাপ থেকে একটি রূপরেখা আসতে পারেও বলে মন্তব্য সংশ্লিষ্টজনদের।
প্রসঙ্গত, ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের মুখে গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হয়। পরে একই মাসে দায়িত্ব গ্রহণের পর দুর্বল গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে শক্তিশালী করতে এবং জনমালিকানা, জবাবদিহিতা ও জনকল্যাণ নিশ্চিত করার জন্য ১৫টি সংস্কার কমিশন গঠন করে অন্তর্বর্তী সরকার।
এর মধ্যে সংবিধান, নির্বাচনী ব্যবস্থা, পুলিশ, বিচার বিভাগ, জনপ্রশাসন এবং দুদকের সংস্কারের জন্য প্রথম ছয়টি কমিশন ৩ অক্টোবর গঠিত হয়। প্রতিবেদন জমা দেওয়ার জন্য ৯০ দিন সময় দেওয়া হয়েছিল তাদের। পরে বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশনের সময়সীমা ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত এবং বাকি পাঁচটি কমিশনের সময়সীমা ১৫ জানুয়ারি পর্যন্ত বাড়ানো হয়।