প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, সংবিধানে যেভাবে রয়েছে সেভাবেই সময়মতো আগামী নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। নির্বাচন কারোর জন্য ঠেকে থাকবে না। যারা জনগণের ভোটের অধিকারে বিশ্বাস করে, যাদের জনগণ ও গণতন্ত্রের ওপর আস্থা-বিশ্বাস আছে- তারা নির্বাচন অংশগ্রহণ করবে। আর না করলে এখানে আমাদের কোন কিছুই করার নেই। ২০১৪ সালে এতো তাণ্ডব ও জ্বালাও-পোড়াও করেও যখন নির্বাচন ঠেকাতে পারেনি, ভবিষ্যতেও কেউ নির্বাচন ঠেকাতে পারবে না ইনশাল্লাহ।
গতকাল সোমবার বিকালে গণভবনে এক জনাকীর্ণ সাংবাদিক সম্মেলনে একাধিক প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী এসব কথা বলেন। সম্প্রতি ইতালি সফরের অর্জন ও সফলতা তুলে ধরতে এই সাংবাদিক সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। লিখিত বক্তব্যের পর প্রধানমন্ত্রী সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দেন। প্রশ্নোত্তর পর্বে ঘুরে ফিরেই আগামী নির্বাচন, বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়ার দুর্নীতির মামলায় কারাদণ্ড, প্রশ্নপত্র ফাঁস ও রোহিঙ্গা ইস্যুটি প্রাধান্য পায়। প্রধানমন্ত্রী স্বভাবসুলভ হাসিমুখে সাংবাদিকদের একের পর এক প্রশ্নের উত্তর দেন।
প্রধানমন্ত্রী আরো বলেন, দেশে এখন বহুদলীয় গণতন্ত্র বিদ্যমান। কোন দল নির্বাচন করবে, আর কোন দল নির্বাচন করবে না এটা সম্পূর্ণ তাদের দলীয় সিদ্ধান্তের ব্যাপার। তাই যথাসময়ে নির্বাচন হবে, জনগণও ভোট দেবে। যদি কেউ বলে নির্বাচন করতে দেবো না-এটা হচ্ছে গায়ের জোরের কথা। আর এটা বিএনপি বলতে পারে, কারণ তাদের জন্মটাই তো ওইভাবে। আর যদি বলেন বিএনপি প্রধান খালেদা জিয়াকে আমি শাস্তি দিয়েছি, যে আমি তুলে নেবো, তা তো আমি পারবো না। কারণ রায় দিয়েছে আদালত। এখানে আমাদের তো কিছু করার নেই। আর মামলাও তো আমরা দেইনি, দিয়েছে বিএনপি নেত্রীরই প্রিয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার। বিএনপির নেতাদের প্রতি প্রশ্ন রেখে শেখ হাসিনা বলেন, ’আপনাদের দলের কী এমনই দৈনদশা যে ভারপ্রাপ্ত সভাপতির দায়িত্ব নেওয়ার মতো কোন নেতা নেই? খালেদা জিয়া বিএনপির কোনো নেতার ওপর এতটুকু ভরসা রাখতে পারলেন না? ভারপ্রাপ্ত সভাপতি হওয়ার মতো এতটুকু যোগ্যতাও কী বিএনপি কোনো নেতার নেই? বিএনপির কোনো নেতার ওপর ভরসা না করে বিএনপি নেত্রী মুচলেকা দিয়ে বিদেশে পালিয়ে যাওয়া ও আদালতে ৭ বছরের দণ্ডিত আসামি নিজের ছেলেকে ভারপ্রাপ্ত সভাপতির দায়িত্ব দিলেন। দলের মধ্যে যোগ্য আর কাউকে কি খুঁজে পাওয়া গেল না। এর জবাব বিএনপির নেতারাই ভাল দিতে পারবেন।’
খালেদা জিয়া ছাড়া নির্বাচন নয়, নির্বাচন করতেও দেয়া হবে না- মর্মে বিএনপির নেতাদের হুমকি প্রসঙ্গে এক প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, খালেদা জিয়ার মামলা নিয়ে এখন অনেকে অনেক কথা বলছেন। এ মামলার শুরুর সময়ই বিএনপি নেত্রীর আইনজীবী ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম তাকে বলেছিলেন, টাকা দিলেই মামলা থাকবে না। তখন এতিমের টাকা দিয়ে দিলেই তো মামলা থাকতো না। আর পবিত্র কোরআন শরিফেও তো লেখা আছে এতিমের টাকা মেরে খাওয়া যায় না। আর খেলে শাস্তি যেমন আদালত দেয়, আল্লাহ’র তরফ থেকেও দেয়। এখানে তো আমাদের কিছু করার নেই। তিনি বলেন, বিএনপি থেকে হুমকি দেয়া হচ্ছে, তারা নাকি নির্বাচন করবে না! নির্বাচন যদি না করে কারোর করার কিছু নেই। গতবারও তারা নির্বাচন করেনি। আমরা জানতাম তারা নির্বাচনে আসবে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আসেনি। এবারও যদি না আসে, কোনো দল যদি নির্বাচন না করে আমাদের করার কী আছে? আর যদি বলেন আমি শাস্তি দিয়েছি আমি তুলে নেবো। তা তো আমি পারবো না। এটা কোর্ট দিয়েছে। মামলা করেছে দুদক। আমাদের কিছু করার নাই। আর এখানে বহুদলীয় গণতন্ত্র। কোন দল নির্বাচন করবে কোন দল নির্বাচন করবে না এটা সম্পূর্ণ তাদের দলীয় সিদ্ধান্ত।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, বিএনপি হুমকি দিতেই পারে কারণ তাদের জন্মটাই তো হয়েছে ওইভাবে। বিচারপতি সায়েম সাহেবকে অস্ত্রের মুখে রাষ্ট্রপতির পদ থেকে সরিয়ে দিয়ে জেনারেল জিয়া নিজেকে প্রেসিডেন্ট ঘোষণা দিল। ১৫ আগস্ট হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে সম্পূর্ণ জড়িত সেই মোশতাক অবৈধভাবে প্রেসিডেন্ট হয়েই জিয়াকে সেনাপ্রধান বানিয়ে দিল। জিয়া কতটা বিশ্বস্ত ছিল খুনী মোশতাকের। আর সেই জিয়াউর রহমান একাধারে সেনাপ্রধান, একাধারে প্রেসিডেন্ট। একি অঙ্গে দুই রূপ নিয়ে উনি ক্ষমতায় এলেন।
দুর্নীতিবাজদের দলে রাখতে বিএনপির রাতারাতি গঠনতন্ত্র পরিবর্তন এবং দণ্ডপ্রাপ্ত তারেক রহমানকে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপার্সন করার বিষয়ে অপর এক প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে আদালতের রায় হওয়ার আগেই বিএনপি তাদের গঠনতন্ত্রে থাকা ৭ ধারা পরিবর্তন করে নির্বাচন কমিশনে জমা দিয়েছে। আর বিএনপি গঠনতন্ত্র মানে বলে মনে হয় না। তবে বিএনপির গঠনতন্ত্র অনুযায়ী সবসময় ক্ষমতার অধিকারী চেয়ারপার্সন, আওয়ামী লীগের গঠনতন্ত্রে আমার কিন্তু ওতো ক্ষমতা নেই। তিনি বলেন, বিএনপির গঠনতন্ত্রে ছিলো দুর্নীতি মামলায় সাজাপ্রাপ্ত হলে দলে থাকতে পারবে না। কিন্তু রায়ের আগেই সেই ধারাটি পরিবর্তন করা হলো। আমার প্রশ্ন- বিএনপিতে কি একটি যোগ্য নেতাও নেই যাকে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপার্সন করা যেত? তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আগে কোনোদিন রাজনীতি করবে না এমন মুচলেকা দিয়ে যে দেশ ছেড়ে চলে গেছে, যার বিরুদ্ধে মামলায় ৭ বছরের সাজার রায় হয়েছে, বিদেশে থাকা তাকেই (তারেক জিয়া) ভারপ্রাপ্ত সভাপতি করা হলো! প্রধানমন্ত্রী প্রশ্ন রেখে বলেন, বিএনপিতে দেশে থাকা কী একটা নেতাকেও খুঁজে পাওয়া গেল না? বিএনপির কী এমনই দৈনদশা যে, খালেদা জিয়া তার দলের কাউকে দায়িত্ব দেওয়ার ভরসা পেলেন না? ভারপ্রাপ্ত সভাপতি হওয়ার মতো এতটুকু যোগ্যতাও কী বিএনপি কোনো নেতার নেই?
কোন আইনের বিধান অনুযায়ী কারাগারে খালেদা জিয়াকে ব্যক্তিগত গৃহপরিচারিকা দেওয়া হলো- একজন সাংবাদিকের এমন প্রশ্নের জবাবে শেখ হাসিনা বলেন, সবাই কি দিতে পারে? একজন ভাগ্যবতী আছেন (খালেদা জিয়া) তিনি শুধু নিয়েই যান। আর একজন (শেখ হাসিনা) শুধুই দেন। আমরা দু’বোন উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত বঙ্গবন্ধুর বাড়িটিও জনগণের জন্য দিয়ে দিয়েছি। তিনি বলেন, কারাগারে ব্যক্তিগত কাউকে নেওয়া নতুন নয়। ওয়ান ইলেভেনের সময়ও কারাগারে বন্দী থাকা অবস্থায় খালেদা জিয়ার জন্য এই ফাতেমাই মেড সার্ভেন্ট হিসেবে তার সঙ্গে ছিলেন। আর আদালত তাকে মেড সার্ভেন্ট হিসেবে দিতে বলেছেন। তবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে বলেছি যেন ফাতেমার কাছ থেকে সই নিয়ে রাখা হয় যে সে স্বেচ্ছায় কারাবন্দি থাকতে রাজি আছে। নইলে এ নিয়েও হয়তো কেউ নানা কথা বলবে।
রোহিঙ্গা ইস্যুতে অপর এক প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, মিয়ানমার আমাদের প্রতিবেশী দেশ। তাই আলোচনার মাধ্যমে আমরা রোহিঙ্গা সংকট সমাধানের চেষ্টা করছি।
সংবাদ সম্মেলনে দেওয়া লিখিত সম্পূরক তথ্য তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, জিয়াউর রহমান মারা যাওয়ার পর টেলিভিশনে ভাঙা স্যুটকেস এবং ছেঁড়া গেঞ্জি দেখানো হয়। তাকে সততার মূর্ত প্রতীক বানানো হলো। কয়েক বছরের মধ্যেই দেখা গেল জিয়া পরিবার হাজার হাজার কোটি টাকার সম্পদের মালিক। তিনি প্রশ্ন রেখে বলেন, হঠাত্ করে এতো টাকার মালিক তারা হলো কীভাবে?
নির্বাচন হচ্ছে মানুষের একটা অধিকার
নির্বাচনকে মানুষের অধিকার হিসেবে আখ্যায়িত করে শেখ হাসিনা বলেন, এটা গণতান্ত্রিক ও সাংবিধানিক অধিকারও। আমরা সেটা পূরণ করবো। এখন নির্বাচনে তারা যাবে না। যারা দুর্নীতির বিরুদ্ধে এতো কথা বলেন, সেই দুর্নীতিতে যিনি (খালেদা জিয়া) সাজাপ্রাপ্ত তাকে ছাড়া নির্বাচনে যাবে না। রায়টা তো আর আমি দেই নাই। রায়টা দিয়েছে কোর্ট। মামলা করেছে তত্ত্বাবধায়ক সরকার। আর সেই তত্ত্বাবধায়ক সরকার কে? ফখরুদ্দিন সাহেব ওয়ার্ল্ড ব্যাংকে কাজ করতেন। তাকে নিয়ে এসে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর করা হলো। কারণ বিএনপি বা খালেদা জিয়ার তিনি অত্যন্ত বিশ্বস্ত। সেই জন্যই তো নিয়ে আসল। তিনি বলেন, জেনারেল মইনকে সেনাবাহিনীর ৯ জন জেনারেলকে ডিঙ্গিয়ে সেনাপ্রধান করা হলো। ৯ জন জেনারেল ডিঙিয়ে যখন কাউকে করা হয় তার মানে কী? তিনিও সব থেকে বিশ্বস্ত সবচেয়ে প্রিয় পাত্র। আর প্রেসিডেন্ট ইয়াজউদ্দিন সাহেব তো তাদের ইয়েস উদ্দিনই ছিলেন। এই যে ইয়াজউদ্দিন ফখরুদ্দিন মইনুদ্দিন সবগুলোই খালেদা জিয়ার নিজের লোক। তারাই মামলাটা দিয়েছে। উল্লেখযোগ্য উপদেষ্টারাইতো দায়িত্বে ছিলেন। সেখানে সেই মামলা দুদক করেছে। প্রধানমন্ত্রী আরো বলেন, জিয়া অরফানেজ মামলাটি কিন্তু দশ বছর চলেছে।
সাংবাদিক সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত, কৃষিমন্ত্রী বেগম মতিয়া চৌধুরী, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের ও তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু উপবিষ্ট ছিলেন।