গত বছরের ২৫ আগস্ট মিয়ানমারের ২৩টি সেনা চৌকিতে বোমা হামলার অজুহাত তুলে সেদেশের সামরিক জান্তা, পুলিশ ও সশস্ত্র রাখাইন উগ্রবাদী দুর্বৃত্তরা রোহিঙ্গাদের উপর নির্বিচারে দমন, নিপীড়ন নির্যাতন, জুলুম, অত্যাচার ধর্ষন, হত্যা, ঘুম, গণ গ্রেপ্তার, শিশুদের আগুনে নিক্ষেপ করে পুড়িয়ে মারার ঘটনায় এ পর্যন্ত প্রায় ৭ লক্ষাধিক রোহিঙ্গা এদেশে চলে আসার ৬মাস পূর্ণ হয়েছে আজ রবিবার। নতুন-পুরাতন মিলিয়ে বর্তমানে উখিয়া-টেকনাফে প্রায় ১০ লাখের অধিক রোহিঙ্গা ৫হাজার একর বন ভূমিতে ১২টি অস্থায়ী ক্যাম্পে ১ লাখ ৬৫ হাজার ঝুপড়ি নির্মাণ করে বসবাস করছে।
বাংলাদেশ পার্সপোর্ট এন্ড ইমিগ্রেশনে অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক আবু নোমান মুহাম্মদ জাকের হোসেন জানিয়েছেন শনিবার (২৪ ফেব্রুয়ারী) পর্যন্ত এদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের মধ্যে নতুন-পুরাতন মিলে ১০ লাখ ৭৬ হাজার ৬৪০ জন রোহিঙ্গাকে নিবন্ধনের আওতায় আনা হয়েছে। নিবন্ধিত ওই সব রোহিঙ্গাদের আইডি কার্ড দেওয়া হয়েছে, যাতে ত্রাণ বিতরণসহ বিভিন্ন সরকারি, বেসরকারি সুযোগ-সুবিধা গ্রহণ করতে রোহিঙ্গাদের ঝামেলা পোহাতে না হয়।
কক্সবাজার শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার (যুগ্ম সচিব) মোঃ আবুল কালাম সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, গত বছরের ২৫ আগস্ট থেকে এ পর্যন্ত ৬ লাখ ৯০ হাজার রোহিঙ্গা এদেশে পালিয়ে এসে উখিয়া-টেকনাফের বিভিন্ন ক্যাম্পে আশ্রয় নিয়েছে। এদের খাদ্য ও মানবিক সহায়তা প্রদান করছে সরকারের পাশাপাশি প্রায় ১৪০টি এনজিও সংস্থা। তিনি বলেন, আশ্রিত এসব রোহিঙ্গাদের দ্রুত সময়ের মধ্যে প্রত্যাবাসনের লক্ষ্যে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে যৌথ ওয়ার্কিং গ্রুপ ঘটন করা হয়েছে। নির্মাণ করা হয়েছে ট্রানজিট ক্যাম্প। যেসব রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের চূড়ান্ত বিবেচনায় আসবে ওইসব রোহিঙ্গা পরিবারদের সাময়িক ভাবে ট্রানজিট ক্যাম্পে রাখা হবে। পরে সেখান থেকে মিয়ানমারের ট্রানজিট ক্যাম্পে কর্মরত যৌথ ওয়ার্কিং গ্রুপের সদস্যের হাতে রোহিঙ্গাদের হস্তান্তর করা হবে। তিনি এও বলেন, আগামী ২ সপ্তাহের মধ্যে সীমান্তের শূন্যরেখায় অবস্থিত রোহিঙ্গাদের পরিবার ভিত্তিক তালিকা প্রণয়ন করে মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো হবে।
রোহিঙ্গা নাগরিকদের চিহ্নিতকরণ কমিটির সভাপতি চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনার মোঃ আব্দুল মান্নান বলেন, রোহিঙ্গাদের কারনে এদেশে ভূমি, পরিবেশ, জীববৈচিত্র, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, দ্রব্যমূল্যের গতি পরিবর্তন ও আইনশৃংখলা পরিস্থিতি হুমকির মূখে পড়লেও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার মানবিক দৃষ্টিকোন থেকে সহায় সম্বলহীন নিরাশ্রয় রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়ে যে মহানুবভতার পরিচয় দিয়েছে তা বিশ্বের ইতিহাসে বিরল দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। তিনি বলেন, এসরকার বিশাল রোহিঙ্গা জনগোষ্টিকে খাদ্য,বাসস্থান,ওষুধ সরবরাহসহ সব ধরনের সুযোগ সুবিধা প্রদানের পাশাপাশি রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন করার একটি চুড়ান্ত রূপ রেখায় উপনীত হয়েছে। এতে মোটামুটি সরকার সাফল্য।
শনিবার উখিয়ার কুতুপালং লম্বাশিয়া,মধূরছড়াসহ বেশ কয়েকটি ক্যাম্প ঘুরে বয়োবৃদ্ধ ও বিভিন্ন শ্রেণির রোহিঙ্গাদের সাথে মিয়ানমারে ফিরে যাওয়ার ব্যাপারে কথা হয়। তারা বার বার বলে আসছে মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করা হলে রোহিঙ্গাদের স্বইচ্ছায় মিয়ানমারে ফিরে যেতে আগ্রহী। বুচিদং কেয়াংপাড়া গ্রামের ছালামাতুল্লাহ (৪০)। সামনে বর্ষা, তাই নিজের বাড়ির ছাউনি সংস্কারের কাজ করছিলেন। মিয়ানমারে ফিরে যাবে কি না জানতে চাইলে হাতে কাজ ফেলে তিনি বলেন, মিয়ানমারে ফিরে গেলে যদি জানাযা পড়ার পরিবেশ পাওয়া না যায় সেদেশে ফিরে যাওয়ার চাইতে এদেশে না খেয়ে মরে যাওয়া অনেক ভাল। অন্তত পক্ষে মুসলমানের দেশে মরতে পেরেছি এটাই মনকে সান্ত্বনা দেওয়া যাবে। তার পাশেই বসা আলি আহমদ (৪৫) জানান, মিয়ানমারে তাদের পুড়িয়ে দেওয়া বাড়ি ঘরের ক্ষতিপূরণ, জায়গা জমির মালিকানা ফেরত দিতে হবে। এছাড়া স্বাধীনভাবে চলাফেরা করা ও ছেলে/মেয়েদের পড়ালেখা করার নিশ্চিয়তা দিলেই তাদের ইচ্ছা করেও এখানে কেউ ধরে রাখতে পারবে না। একাধিক রোহিঙ্গারা জানান, তাদের জমি-জমা, বসতভিটা, চাষাবাদ সহ বিভিন্ন ধরনের ফলজ বাগান রয়েছে। যেখানে তারা শান্তিতে পরিবার পরিজন নিয়ে বসবাস করার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু মিয়ানমার সেনারা সেখানকার বিদ্রোহী আরসা’র নাম ভাঙ্গিয়ে জাতিগত নিধনযঞ্জ চালিয়ে যাওয়ার কারণে দেশ থাকতেও তাদেরকে আজ পরদেশে ছোট্ট কুঠুরিতে রাত কাটাতে হচ্ছে। এভাবে জীবন কাটাতে তারা চান না। মিয়ানমার সরকার নাগরিক অধিকার ফিরিয়ে দিলেই তারা মিয়ানমারে যেকোন সময়ে ফিরে যেতে রাজী আছে। বাংলাদেশে পালিয়ে আসা আজ ৬ মাস পূর্ণ হয়েছে এমন প্রশ্নের জবাবে বেশ কয়েকজন রোহিঙ্গা যুবক জানালেন, আজ যদি তারা মিয়ানমারে ফিরে যেতে পারত তাহলে নিজেকে ধন্য মনে করত।
রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন সংগ্রাম কমিটির সভাপতি অধ্যক্ষ হামিদুল হক চৌধুরী জানান, এদেশে রোহিঙ্গা আসার আজ ৬মাস পূর্ণ হয়েছে। কিন্তু যে ভাবে সরকার আগ্রহ করে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের জন্য দেশ বিদেশে ঘুরে ফিরেছে তাতে এতদিনে রোহিঙ্গারা স্বদেশে ফিরে যাওয়ার কথা। কিন্তু ক্যাম্পে অবস্থান নিয়ে কতিপয় এনজিও সংস্থার কর্তা ব্যক্তিরা রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে না ফেরার জন্য ইন্ধন যোগাচ্ছে। এর একমাত্র কারণ বিদেশ থেকে আসা কোটি কোটি টাকা থেকে তারা বঞ্চিত হবে। এ জন্য ওই সব এনজিওরা রোহিঙ্গা সমস্যা জিইয়ে রাখার জন্য তত্পর বলে তিনি অভিযোগ করেন।