আলবার্ট আইনস্টাইনের পর সমকালীন বিশ্বের তাত্ত্বিক পদার্থবিদদের মধ্যে অন্যতম বিবেচনা করা হয় স্টিফেন হকিংকে। কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের লুকাসিয়ান অধ্যাপক (স্যার আইজ্যাক নিউটনও একসময় এই পদে ছিলেন) হিসেবে ১ অক্টোবর, ২০০৯ সালে অবসর নেন তিনি। এছাড়াও তিনি কেমব্রিজের গনভিলি এবং কেয়াস কলেজের ফেলো হিসাবে কাজ করেছেন।
শারীরিকভাবে ভীষণরকম অচল এবং এ.এল.এসের (এমায়োট্রফিক ল্যাটারাল স্ক্লেরোসিস বা লাউ গেহরিগ রোগ- যা একপ্রকার মোটর নিউরন রোগ) জন্য ক্রমাগতভাবে সম্পূর্ণ অচলাবস্থার দিকে ধাবিত হওয়া সত্ত্বেও বহু বছর যাবত তিনি তাঁর গবেষণা কার্যক্রম সাফল্যের সঙ্গে চালিয়ে যান। পদার্থবিজ্ঞানে হকিংয়ের দুইটি অবদানের কথা সবচেয়ে বেশি স্বীকৃত। প্রথম জীবনে সতীর্থ রজার পেনরোজের সঙ্গে মিলে সাধারণ আপেক্ষিকতায় সিঙ্গুলারিটি সংক্রান্ত তত্ত্ব দেন। হকিং প্রথম অনিশ্চয়তার তত্ত্ব ‘ব্ল্যাক হোল’ এর ঘটনা দিগন্তে প্রয়োগ করে দেখান যে, ব্ল্যাক হোল থেকে বিকিরিত হচ্ছে কণা প্রবাহ। এই বিকরণ এখন হকিং বিকিরণ নামে (অথবা কখনো কখনো বেকেনস্টাইন-হকিং বিকিরণ) অভিহিত।
তত্ত্বীয় কসমোলজি আর কোয়ান্টাম মধ্যাকর্ষ ছিলো হকিংয়ের প্রধান গবেষণা ক্ষেত্র। ১৯৬০ এর দশকে ক্যামব্রিজের বন্ধু ও সহকর্মী রজার পেনরোজের সঙ্গে মিলে হকিং আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতার তত্ত্ব থেকে একটি নতুন মডেল তৈরি করেন। সেই মডেলের উপর ভিত্তি করে ১৯৭০ এর দশকে হকিং প্রথম তাঁদের (পেনরোজ-হকিং তত্ত্ব নামে পরিচিত) তত্ত্বের প্রথমটি প্রমাণ করেন। এই তত্ত্বগুলো প্রথমবারের মতো কোয়ান্টাম মহাকর্ষে এককত্বের পর্যাপ্ত শর্তসমূহ পূরণ করে। আগে যেমনটি ভাবা হতো এককত্ব কেবল একটি গাণিতিক বিষয়। এই তত্ত্বের পর প্রথম বোঝা গেল, এককত্বের বীজ লুকোনো ছিল আপেক্ষিকতার সাধারণ তত্ত্বে।
হকিংয়ের কাছে কেউ যদি জানতে চাইত, বিজ্ঞানের চূড়ান্ত লক্ষ্য কী? হকিং বলতেন, ঈশ্বরের মন বুঝতে পারা। কীভাবে? এই বস্তুজগতের নিয়মাবলীর সাধারণ, সহজ ও সরল সূত্র আবিষ্কারের মাধ্যমে। এই তত্ত্ব হবে সব পেয়েছি’র তত্ত্ব। এই যে হকিং কদিন আগেও বেশি মাথা ঘামিয়েছেন কাল্পনিক সময়, ওয়ার্মহোল প্রভৃতি নিয়ে- এ সবকিছুর লক্ষ্যও কিন্তু এক। নিছক কোনো কাগুজে সমীকরণ নয়, এ হচ্ছে সব পেয়েছি’র চাবি। এর সাহায্যে মানুষ যেমন পারবে বস্তুজগতের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র মৌলিক কণার খবর জানতে, তেমনি সক্ষম হবে দূর মহাকাশের বিশালাকার কৃষ্ণবিবরের আচরণ ব্যাখ্যা করতে। ‘এই মহাবিশ্বের শুরু কীভাবে হলো- এমন সব প্রশ্নের উত্তর দিতে পারে এসব নিয়ম’, তিনি বলেন ‘কবে এর শেষ হবে? কীভাবে শেষ হবে? এসবের উত্তর যদি আমরা জানতে পারি, তাহলে আমরা আসলেই ঈশ্বরের মন বুঝতে পারবো।’
ক্ষমতার দৌড়ে এগিয়ে থাকতে বর্তমান মানব সভ্যতার যুদ্ধংদেহী মনোভাব সম্পর্কে বিশেষ চিন্তিত ছিলেন হকিং। তাই বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডে বুদ্ধিমান মানব জাতির অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে মহাকাশের অন্য কোথাও নতুন বসতি স্থাপনের ব্যাপারেও জোর পরামর্শ ছিলো তাঁর। তিনি বলেন, ‘আমার বিশ্বাস পারমাণবিক যুদ্ধ, জিন প্রকৌশলের মাধ্যমে তৈরি ভাইরাস অথবা অন্য কোন কারণে পৃথিবীতে প্রাণের অবসান হতে পারে। মানুষ যদি মহাকাশে না যায় তাহলে আমার মনে হয় মানবজাতির কোন ভবিষ্যৎ নেই। যে কারণে আমি মানুষকে মহাকাশে যাওয়ার বিষয়ে উদ্বুদ্ধ করতে চাই।’
পৃথিবী কাঁপিয়ে দেয়া বই ‘আ ব্রিফ হিস্ট্রি অব টাইম’ ছাড়াও ‘ইউনিভার্স ইন আ নাটশেল’, ‘ব্রিফার হিস্টরি অব টাইম’, ‘ব্ল্যাকহোল অ্যান্ড বেবি ইউনিভার্স’, ‘গড ক্রিয়েটেড দ্য ইন্টিজার’, ‘দ্য গ্র্যান্ড ডিজাইন’ প্রভৃতি বই লিখেছেন হকিং। মেয়ে লুসির সঙ্গে লিখেছেন, ‘জর্জ’স সিক্রেট কি টু ইউনিভার্স’, যেখানে হ্যারি পটারের স্টাইলে বিজ্ঞানের জটিল বিষয় তুলে ধরা হয়েছে। হকিং অভিনয় করেছেন স্টারট্রেকের ডিসেন্ট এপিসোডে। ব্রিটিশ ব্যান্ড পিঙ্ক ফ্লয়েডের ‘ডিভিশন বেল’ অ্যালবামের ‘কিপ টকিং’ গানে হকিংয়ের সিনথেসাইজড শব্দ আছে, সেখানে তাঁর সিনথেসাইজড ভয়েস ব্যবহার করা হয়েছে। ২০১৪ সালে স্টিফেন হকিংয়ের জীবন নিয়ে তৈরি হয় ‘থিওরি অফ এভরিথিং’ চলচ্চিত্র। জেন হকিংয়ের বর্ণনার ওপর ভিত্তি করে তৈরি করা হয় চলচ্চিত্রটি।