প্রস্তাবিত সরকারি কর্মচারী আইন-২০১৮ থেকে রাষ্ট্রপতির কোটায় বাইরে থেকে ১০% পদে রাজনৈতিক নিয়োগ সুপারিশ না করায় ক্ষোভ অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন বেশিরভাগ কর্মকর্তা।
বুধবার আইনটি নিয়ে উপ-কমিটির সুপারিশ রিপোর্ট যুগান্তরে প্রকাশিত হলে প্রশাসনের বিভিন্ন পর্যায়ে কর্মরত অনেকে তাদের এমন প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন। তারা বলেন, এটি বহাল রেখে সরকারি কর্মচারী আইন প্রণয়ন করা হলে প্রশাসন ক্যাডার কর্মকর্তাদের সার্বিক অবস্থান, মর্যাদা ও অধিকার নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।প্রসঙ্গত, প্রস্তাবিত সরকারি কর্মচারী আইনে রাষ্ট্রপতির বিশেষ এখতিয়ার সংক্রান্ত ১৭ ধারায় বলা আছে, ‘এই আইনের অন্যান্য বিধান, আপাতত বলবৎ অন্য কোনো আইন বা আইনের ক্ষমতাসম্পন্ন দলিলে ভিন্নরূপ যাহা কিছুই থাকুক না কেন, রাষ্ট্রপতি জনস্বার্থে বিশেষ মেধা, দক্ষতা, যোগ্যতা ও অপরিহার্যতা বিবেচনা করিয়া সরকারের সচিব, অতিরিক্ত সচিব, যুগ্মসচিব ও উপসচিব পদসংখ্যার অনধিক ১০ শতাংশ পদে, উক্ত পদে নিয়মিতভাবে নিয়োগযোগ্য কর্মচারিগণের বাইরে হইতে, কোনো ব্যক্তিকে প্রেষণ বা চুক্তি ভিত্তিতে নিয়োগ করিতে পারিবেন।’
অর্থাৎ দলীয় সরকার রাজনৈতিক বিবেচনায় এই ১০ শতাংশ কোটায় পছন্দমতো লোক নিয়োগ দিতে পারবে। স্বভাবত ধারণা করা যায়, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়সহ বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, বিভাগ ও অধিদফতরের গুরুত্বপূর্ণ পদে তাদেরকে পদায়ন করা হবে।
দলীয় সরকারের কাজের সুবিধার্থে আস্থাভাজন লোকজনকে সচিব, অতিরিক্ত সচিব, যুগ্মসচিব ও উপসচিব পদমর্যাদার গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোতে স্থান দেয়া হবে। এর ফলে বিসিএস পরীক্ষা দিয়ে প্রশাসন ক্যাডারে নিয়োগ পাওয়া এ সারির কর্মকর্তারা অনেকটা কোণঠাসা হয়ে পড়বেন।
এমনটিই আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা। এছাড়া বর্তমানে এই পদগুলোতে কর্মরত কর্মকর্তার সংখ্যা বিবেচনায় নিলে উল্লিখিত চারটি ধাপে রাজনৈতিক বিবেচনায় ১০% কোটায় নিয়োগ পাওয়া কর্মকর্তার সংখ্যা ৩শ’ জন ছাড়িয়ে যাবে।সূত্রমতে বর্তমানে সচিব পদে কর্মরত আছেন ৬৪ জন, অতিরিক্ত সচিব পদে ৫২৩ জন, যুগ্মসচিব পদে ৮০৬ জন এবং উপসচিব পদে ১৭৫৭ জন। এ হিসেবে ১০% কোটায় সচিব পদে অন্তত ৬ জন, অতিরিক্ত সচিব পদে ৫২ জন, যুগ্মসচিব পদে ৮০ জন এবং উপসচিব পদে নিয়োগ পাবেন ১৭৫ জন। এখন যদি এই আইন কার্যকর করা হয় তাহলে এ চারটি পদে বাইরে থেকে ৩১৩ জনকে নিয়োগ দেয়া সম্ভব হবে।
এদিকে এ বিষয়ে প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে ক্ষুব্ধ কর্মকর্তাদের কেউ কেউ বলেন, যুক্তরাষ্ট্র সরকারের প্রশাসন ব্যবস্থায় এ ধরনের পদ্ধতি বিদ্যমান আছে। যখন যে সরকার ক্ষমতায় আসে তখন তারা ২৫% দলীয় লোকজন প্রশাসনে নিয়ে আসেন।
আবার সরকার বিদায় হলে তাদের চুক্তি নিয়োগও শেষ হয়। হয়তো এমন যুক্তি দেখিয়ে এখানেও সেটি করা হচ্ছে। কিন্তু সেখানকার আইনের শাসন ও রাজনৈতিক সংস্কৃতির সঙ্গে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটের তফাতটা ঢের বেশি। তারা বলেন, এমনিতে দিন দিন প্রশাসনে পেশাদারিত্ব কমে যাচ্ছে।
পদ-পদবি ও ব্যক্তিগত নানা স্বার্থে কর্মকর্তাদের অনেকে এখন প্রতিযোগিতা করে দলীয় লেজুড়বৃত্তির পেছনে ছুটছেন। শুধু বর্তমান আওয়ামী সরকার নয়, প্রতিটি সরকারের আমলে এমন চিত্র দেখা গেছে। এখন যা প্রকট আকার ধারণ করেছে। তারা বলেন, প্রশাসনে সবাই এখন আওয়ামী লীগ।
বরং অবস্থাদৃষ্টে পরিস্থিতি অনেক স্থানে এমন দেখা দিয়েছে যে, নতুনদের চাপে প্রকৃত আওয়ামীপন্থী কর্মকর্তাদের টিকে থাকাই দায়। নব্য আওয়ামী লীগাররা সব সুবিধা আগেভাগে পেয়ে যাচ্ছে। তারা বলেন, প্রশাসনের এই যখন অবস্থা তখন যদি সরাসরি এভাবে রাজনৈতিক বিবেচনায় বাইরে থেকে দলীয় লোকজন এসব গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ দেয়া হয় তাহলে প্রশাসনে এখনও যেটুকু ইমেজ ও ঐতিহ্য টিকে আছে তাও আর থাকবে না।
ক্ষুব্ধ কর্মকর্তারা বলেন, যারা উপ-কমিটিতে আছেন তারা তো সবাই প্রশাসন ক্যাডারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা। শেষমেশ যদি সরকার এটি করতেই চায় সেক্ষেত্রে উপ-কমিটির উচিত ছিল বাস্তব প্রেক্ষাপট ও প্রশাসন ক্যাডারের পরিণতির কথা তুলে ধরে এ বিষয়ে জোরালো আপত্তি তুলে ধরা। কিন্তু অনেক গুরুত্বহীন বিষয়ে মতামত দিলেও এ নিয়ে তারা কোনো মতামতই দেননি। এটি দুঃখজনক। কর্মকর্তারা বলেন, আর যদি করতেই হয় তাহলে শুধু প্রশাসন কেন, সব ক্যাডারেই এই নিয়ম প্রবর্তন করা হোক।এ প্রসঙ্গে মন্তব্য জানতে চাইলে প্রশাসন ক্যাডার অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি ও সাবেক সচিব আবু আলম মো. শহিদ খান বলেন- প্রথমত এ পদ্ধতিতে প্রশাসনের এ চারটি ধাপে কাদের নিয়োগ করা হবে সেটি স্পষ্ট নয়। এমতাবস্থায় আইনটি কার্যকর হওয়ার পর যদি দেখা যায়, পেশাদার লোকজনের পরিবর্তে রাজনৈতিক লোকজন এসব পদে চলে আসে তাহলে সিভিল সার্ভিসের ভারসাম্য ও লক্ষ্য এবং জনগণের সেবা দিতে সিভিল সার্ভিসের যে সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা রয়েছে সে ক্ষেত্রে সাংঘর্ষিক হবে এবং ব্যত্যয় ঘটতে পারে।