• সোমবার, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ১১:৩৫ পূর্বাহ্ন
শিরোনাম:

চালকদের বেপরোয়া গতির নেপথ্যে ট্রিপভিত্তিক মজুরি

আপডেটঃ : রবিবার, ২২ এপ্রিল, ২০১৮

রাজধানীতে কুড়ি বছর গণপরিবহন চালানোর অভিজ্ঞতা চালক শাহজাহানের। গাবতলি থেকে সদরঘাট রুটের ৭ নম্বর লোকাল বাসের ওই চালক আগে সাতটি প্রতিষ্ঠানের গাড়ি চালালেও কখনো নিয়োগ পত্র পাননি। এমনকি নিয়োগ পত্রের বিষয়টিও তার জানা নাই বলে জানান। তবে নিজেকে পাকা চালক দাবি করে জানান, কুড়ি বছর ধরে পরিবহন জগতে আছেন। কখনো এক্সসিডেন্ট করেননি। দিনে তিনটি ট্রিপ মারেন। প্রতি ট্রিপে ১৫০ টাকা পান। তবে রাস্তায় যানজট থাকলে কখনো কখনো দুইটির বেশি ট্রিপ দেয়া যায় না।
পরিবহন নৈরাজ্যের কবলে পড়ে সমপ্রতি সরকারী তিতুমীর কলেজের ছাত্র রাজীব হোসেন নিহতের ঘটনায় সারাদেশ কেঁদে উঠলেও বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতি বলছে, প্রতিদিন দেশে সড়ক-মহাসড়কে ঝরছে কমপক্ষে ৬৪টি তাজা প্রাণ। প্রতিদিন আহত ও পঙ্গুত্ববরণকারীদের তালিকায় যুক্ত হচ্ছে দেড়শ’র বেশি মানুষ।
রাস্তায় কার আগে কে যাবে, কে বেশি যাত্রী তুলবে-এমন প্রতিযোগিতায় বেপরোয়া হয়ে ওঠে রাজধানীর পরিবহন চালকরা। তীব্র যানজট থাকার পরও এমন প্রতিযোগিতা দেখা যায় বিভিন্ন রুটে একই প্রতিষ্ঠান কিংবা ভিন্ন প্রতিষ্ঠানের পরিবহনের মধ্যে। রাস্তায় বাসে বাসে পাল্লাপাল্লি ও রেষারেষি হচ্ছে, প্রাণ হারাচ্ছে মানুষ। যার সর্বশেষ শিকার কলেজছাত্র রাজীব হোসেন।
জানা যায়, রাজধানী ও এর আশপাশে দুই পদ্ধতিতে বাস চলে। প্রথমত, মালিক সরাসরি চালক-শ্রমিককে দৈনিক ভিত্তিতে নির্দিষ্ট পরিমাণে বেতন দেন। দ্বিতয়ত, মালিক নির্দিষ্ট টাকার বিনিময়ে চালক-শ্রমিকের কাছে বাস ভাড়া দিয়ে দেন।
সদরঘাট থেকে গুলিস্তান, ফার্মগেট হয়ে মিরপুর, পল্লবী ও কালশী রুটের ইউনাইটেড পরিবহনের চালক আলমগীর বলেন, ঢাকার রাস্তায় অধিকাংশ গাড়ি চলে ট্রিপভিত্তিক মজুরিতে। দিনে তিনটির বেশি ট্রিপ দেয়া যায় না। তাতে যা আয় হয় তা দিয়ে ভালোভাবে সংসার চলে না। তাই সব চালকরা চায়, একটা বাড়তি ট্রিপ দিতে। আর এজন্য বেশি যাত্রী উঠাতে আগের গাড়ি পিছে ফেলার ভাবনায় গতি বাড়িয়ে গাড়ি চালায়। এতে সামনের গাড়িও পিছে পড়ার ভয়ে আগে যাওয়ার জন্য গতি বাড়িয়ে দেন। আর তাতেই ঘটছে দুর্ঘটনা।
বিকল্প, মেট্রো, সূচনা, ঢাকা, ইটিসি, শিকড় ও শিখর, ৬ নং বাস, ৩ নং বাস (লোকাল) পরিবহনের একাধিক চালকের সঙ্গে কথা বলে একই বক্তব্য পাওয়া যায়। তারা বলছেন, পরিবহন জগতের এই পদ্ধতির সঙ্গে তারা অভ্যস্ত। তাদের অধিকাংশই বাসের সহকারী থেকে চালক হয়েছেন।
তবে বিআরটিসির চালক শামসুজ্জামানের দাবি, এমন প্রতিযোগিতায় নেই বিআরটিসি। কারণ বিআরটিসির কোনো গাড়ি দুর্ঘটনার কবলে পড়ে যে ক্ষতি হয় তা মেরামতের খরচ সম্পূর্ণ চালককে বহন করতে হয়। অন্যদিকে চালকের পালিয়ে যাওয়ারও কোনো সুযোগ নেই। পালিয়ে গেলে তার বেতন উঠাতে পারবে না।
জানা গেছে, রাজধানীতে ৪২টি  কোম্পানির বাসে চালক, সহকারী ও কন্ডাক্টরদের বেতন দেওয়া হয় দৈনিক ট্রিপ ভিত্তিতে। এতে বেশি ট্রিপ দিয়ে বেশি আয় করতে চালকরা নিয়ম না মেনে  যেখানে সেখানে যাত্রী উঠান-নামান। ঢাকা মহানগরীতে ২০০টি বাস থামার স্থান আছে। তবে এসব স্থানে বাস না থামিয়ে পুরো রুটের স্থানে স্থানে বাস থামিয়ে যাত্রী তোলা হয়।
যাত্রীরা বলছেন, চালকরা বাস বোঝাই করার নেশায় রাস্তায় বেপরোয়া হয়ে ওঠে। স্টপেজে আসার আগেই পথে পথে যাত্রী তুলে বোঝাই করে ফেলে। চালকদের এমন আচরণে রাস্তায় বের হয়ে নিরাপদে বাসায় ফেরাটাই এখন চ্যালেঞ্জ হয়ে দাড়িয়েছে।
আইন অনুযায়ী, মোটরযান শ্রমিকদের নিয়োগপত্র দেওয়া এবং দিনে সর্বোচ্চ আট ঘণ্টার বেশি কাজ না করানোর বাধ্যবাধকতা থাকলেও ৩৪ বছর ধরে তা মানছেন না পরিবহন মালিকরা। মাসিক বেতন না থাকায় এসব চালক রোজগারের জন্য দিনে আট ঘণ্টার বদলে ১৪ থেকে ২০ ঘণ্টা পর্যন্ত গাড়ি চালাতে বাধ্য হচ্ছেন।
গাড়ি চালক এবং সহকারীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তাদের বেশিরভাগ ঘুমান গাড়ির আসনে। রাতে চার থেকে পাঁচ ঘন্টার বেশি ঘুমাতে পারেন না। ভোর ৫টার মধ্যে গাড়ি নিয়ে রাস্তায় বের হতে হয়। আবার রাতে ঘুমাতে যেতে যেতে রাত ১ টা পাড় হয়ে যায়। এভাবে বিশ্রাম না নিয়ে, নির্ঘুম কাটিয়ে আয় করা বাড়তি টাকার পুরোটা অবশ্য তারা ঘরে নিতে পারেন না। মালিক ছাড়াও এর ভাগ দিতে হয় পুলিশ ও পরিবহন মালিক-শ্রমিক নেতাদের।
জানা গেছে, দূরপাল্লার হাতে গোনা কয়েকটি বাস কোম্পানি মাসিক ভিত্তিতে চালকদের নিয়োগ দিয়ে থাকে। বেসরকারি হিসাবে, ৯৫ শতাংশ মালিকই নিয়োগপত্র দিচ্ছেন না, এমনকি খোরাকিও না। চালকদের উল্টো ট্রিপনির্ভর করে তুলছেন গাড়ি চালনায়। এতে কম সময়ে বেশি ট্রিপ দিতে তারা বেশি গতিতে ও ওভারটেক করে গাড়ি চালাচ্ছেন।
বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মো. মোজাম্মেল হক চৌধুরী ইত্তেফাককে বলেন, ট্রিপভিত্তিক মজুরিতে গাড়ি চালালে মালিকের মুনাফা বাড়ে। অন্যদিকে চালক যদি মালিকের মন জয় করতে না পারে তাহলে পরের দিন তাদের চাকরি থাকে না। যেহেতু অধিকাংশ চালকের পরিবহনে স্থায়ী চাকরি নেই। সেহেতু মালিক যেভাবে চাইবে সেভাবে চালাতে বাধ্য থাকেন চালকরা।
সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্লাহ ইত্তেফাককে বলেন, আমরা চালকদের নিয়োগপত্র দিতে রাজি আছি। তবে বাস্তবতা হলো, নিয়োগপত্রের পরিবেশ এখনো তৈরি হয়নি। কারণ আমাদের যেখানে চালক স্বল্পতা আছে, সেখানে নিয়োগপত্র দিলে চালক পাওয়া যাবে না। অন্যদিকে এক্ষেত্রে সময় ব্যবস্থাপনার একটা বিষয় আছে। রাজধানীতে ৫০ শতাংশ রোডে চুক্তিভিত্তিক গাড়ি চলে। চালকরাই বেশি মুনাফার আশায় চুক্তিতে নেন। অন্যদিকে রাজধানীর সব রাস্তায় কাউন্টার, টিকেট পদ্ধতির পরিবেশ তৈরি না হওয়ায় মালিকরা একটা নির্দিষ্ট হিসেব ধরে চুক্তিতে চালকদের গাড়ি দেন।
তিনি আরো বলেন, ‘বেশি মুনফার আশায় অদক্ষ চালকরা পাড়াপাড়ি করে। আমরা পরিবহন মালিকদের সাথে মিটিং করে বলেছি, যেসব চালক এ ধরনের কাজ করবে তাদের বিরুদ্ধে সাথে সাথে ব্যবস্থা নিতে হবে। অন্যদিকে যদি কোন গাড়ি বার বার দুর্ঘটনা ঘটায় তাহলে ওই কোম্পানীর লাইসেন্স বাতিল হবে।’


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এই ক্যাটাগরির আরো নিউজ