ব্যাংকগুলোর ঋণ ঝুঁকি কমাতে কমপক্ষে ১০ শতাংশ মূলধন সংরক্ষণ করতে হবে। কিন্তু চার রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের ন্যূনতম এ সীমা তো দূরের কথা, ধারের কাছেও যেতে পারছে না। বরং দুইটি ব্যাংকের মূলধন ঋণাত্মক হয়ে গেছে। বড় অঙ্কের মূলধন ঘাটতি পড়েছে রাষ্ট্রের মালিকানাধীন চার ব্যাংক- সোনালী, অগ্রণী, রূপালী ও জনতা ব্যাংক। ডিসেম্বর শেষে চার ব্যাংকেরই শুধু মূলধন ঘাটতি হয়েছে ৯ হাজার ১৭৮ কোটি টাকা। এর ফলে আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে পিছিয়ে পড়ছে ব্যাংকগুলো। এমনি পরিস্থিতিতে ন্যূনতম মূলধন ১০ শতাংশে উন্নীত করতে আগামী জুন পর্যন্ত সময়সীমা বেঁধে দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। বলা হয়েছে, আগামী জুনের মধ্যে মূলধন সংরক্ষণ ন্যূনতম সীমার মধ্যে আনতে হবে। একই সাথে খেলাপি ঋণের পরিমাণও কমাতে হবে।
এ বিষয়ে চার রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের প্রধান নির্বাহীদের নিয়ে গতকাল বৈঠক করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। আর ওই বৈঠকেই এই নির্দেশনা দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। সংশ্লিষ্ট সূত্র এ তথ্য জানিয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদারের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এ বৈঠকে চার রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের প্রধান নির্বাহীরা ছাড়াও বাংলাদেশ ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
জানা গেছে, আইএমএফের কাছ থেকে বাংলাদেশকে ঋণ সহায়তা হিসেবে সাড়ে চার বিলিয়ন ডলার পেতে বেশ কিছু শর্ত পূরণ করতে হচ্ছে। উল্লেখযোগ্য শর্তগুলোর মধ্যে ব্যাংকিং খাত সংস্কার করতে হবে। আর এজন্য রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ ১০ শতাংশের মধ্যে নামিয়ে আনতে হবে। কমাতে হবে খেলাপি ঋণ। মূলধন ঘাটতি পূরণ করতে হবে। এজন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ইতোমধ্যে কাজ শুরু করেছে। এটা পূরণ করার জন্যই বিভিন্ন পর্যায়ে বৈঠক করছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
জানা গেছে, সংশোধিত ব্যাংক কোম্পানি আইন অনুযায়ী, বছরের পর বছর কোনো ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি থাকতে পারবে না। আইন অনুযায়ী, বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি সর্বোচ্চ দুই বছর পর্যন্ত মেনে নেবে। দুই বছরের পর মূলধন ঘাটতি হলে ওই ব্যাংককে হয় মার্জার অর্থাৎ অন্য কোনো ব্যাংকের সাথে একীভূত হয়ে যেতে হবে অথবা বন্ধ হয়ে যাবে। এ কারণে কোনো ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি হলে, তাকে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে কীভাবে মূলধন ঘাটতি পূরণ করবে তার পরিকল্পনা জমা দিতে হবে। বাংলাদেশ ব্যাংক সময়ে সময়ে তা মনিটরিং করবে। এভাবে দুই বছর পর আইন অনুযায়ী ওই প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে। কিন্তু বছরের পর বছর সরকারি ব্যাংকগুলোর মূলধন ঘাটতি দেখা দিলেও এর বিরুদ্ধে ব্যাংক কোম্পানি আইন অনুযায়ী কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয় না।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী মূলধন সংরক্ষণ করতে না পারলে নানাবিধ সমস্যা দেখা দেবে। এর মধ্যে অন্যতম হলো আন্তর্জাতিক বাণিজ্য নিষ্পত্তিতে ব্যয় বেড়ে যাবে। কারণ মূলধন ঘাটতি থাকলে ব্যাংকিং খাতের রেটিং খারাপ হবে। ফলে পণ্য আমদানিতে দেশীয় ব্যাংকগুলোর গ্রহণযোগ্যতা কমে যাবে। এতে থার্ডপার্টি গ্যারান্টির মাধ্যমে পণ্য আমদানি করতে হবে। আর ব্যয় স্বাভাবিকের চেয়ে বেড়ে যাবে। পরিস্থিতি উন্নতি করতে হলে ব্যাংকগুলোকে আরো সতর্কতার সাথে ঋণ বিতরণ করতে হবে। পাশাপাশি খেলাপি ঋণ আদায়ে সমন্বিত উদ্যোগ নিতে হবে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, চার ব্যাংকের মধ্যে অগ্রণী ও জনতা ব্যাংকের অবস্থা সবচেয়ে খারাপ। অগ্রণী ব্যাংকের ডিসেম্বর শেষে খেলাপি ঋণের হার সবচেয়ে বেশি অর্থাৎ ২২.৩১ শতাংশ। ব্যাংকটির প্রভিশন ঘাটতি হয়েছে চার হাজার ৪২২ কোটি টাকা এবং মূলধন ঘাটতি তিন হাজার ৭৩৯ কোটি টাকা।
জনতা ব্যাংকের ডিসেম্বর শেষে খেলাপিঋণের হার হয়েছে ১৮.২৪ শতাংশ, রূপালী ব্যাংকের ১৬.৫৬ শতাংশ এবং সোনালী ব্যাংকের ১৫.৪৩ শতাংশ। বৈঠকে খেলাপিঋণের হার ১০ শতাংশের নিচে নামিয়ে আনতে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে বলা হয়েছে। পাশাপাশি ন্যূনতম মূলধন ১০ শতাংশের ওপরে উন্নীত করতে হবে। এ দিকে ব্যাংক চারটির বেশির ভাগ ঋণ মাত্র পাঁচ শাখার মধ্যে পুঞ্জীভূত। এসব ঋণের সব শাখার মধ্যে বিস্তৃতি করা, আদায় বাড়ানোর তাগিদ দেয়া হয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষ থেকে। অবলোপন, খেলাপি ও অর্থঋণ আদালতের মামলা দ্রুত নিষ্পত্তি প্রক্রিয়া জোরদারেরও নির্দেশ দেয়া হয় বৈঠকে। তবে আগামী জুনের মধ্যে ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদের বিপরীতে মূলধন সংরক্ষণের হার কমপক্ষে ১০ শতাংশ উন্নীত করতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে।