• বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর ২০২৪, ০৯:২৯ অপরাহ্ন

তুমি বন্ধু কালা পাখি’ ও একজন হাশিম মাহমু

নিউজ ডেস্ক
আপডেটঃ : রবিবার, ২৮ মে, ২০২৩

শাহীনুর রেজা

গত এক যুগের মধ্যে চল” চিত্রের যে
কোন লোকের মুখে মুখে সে গানটি
হলো?
তুমি বন্ধু কালো পাখি আমি যেন কী
বসন্ত কালে যেন বলতে পারিনি
সাদা-সাদা কালা-কালা রঙ জমেছে
সাদা কালা
হইছি আমি মন-পাগেলা বসন্তকালে।।
গানটির গীতিকার ও সুরকার হাশিম
মাহমুদ। গানটি সিনেমায় গেয়েছেন
এরফান মৃধা শিবলু। তিনি যেমন
গেয়েছেন হাশিম মাহমুদ নিজে
গানটি গাইলে খুব মাধুর্য্যময়
হতো মনে করি। কারণ,
তারকণ্ঠে খালি গলায় আমরা
গানটি শুনেছি। নিজের সন্তানকে
পিতা-মাতা যে যত্ন করেন,
হাশিম মাহমুদ তেমন যত্নে
গানটি কণ্ঠে ধারণ করেছেন,
সম্পূর্ণরূপে Natural Voice
কিন্তু দুঃখের বিষয়

হাশিম মাহমুদ

Recording এর সময় তিনি
বেশ খানিকটা অসুস্থ¯’ ছিলেন।
‘তুমি বন্ধু কালা পাখি’ গানটি
দেখবার জন্যই আমি ‘হাওয়া’
সিনেমাটি ‘মধুমিতা’ হলে গিয়ে
দু’বার দেখেছি। গানটিতে
হাতের কাছে থাকা তৈযসপত্র
(শুধুমাত্র খমক ছাড়া) দিয়ে
যন্ত্রানুষঙ্গের কাজ করা হয়েছে।
এ গানের জাদু এখানেই।
গানটির দৃশ্য ধারণে চিত্রগ্রাহক যে
মুন্সিয়ানার পরিচয় দিয়েছেন, বাজি ধরে
বলা যায়, অনেকগুলো জাতীয়
পুরস্কারের সাথে তিনিও যুক্ত হবেন।
তারমানে এ সিনেমার কপালে অনেক
পুরস্কার লেখা আছে, হাশিম মাহমুদ
তো বটেই।
মধুমিতায় গিয়ে পুরানো একটা দৃশ্য
দেখে খুব ভালো লেগেছে। সেটা হলো
ব্লাকার। হল থাকবে, সিনেমা থাকবে
অথচ সিনেমায় টিকেট ব্লাক হবে না?
তা কি করে হয়। হলে ঢুকে দেখি
সিনেমা শুরু হয়ে গেছে। তারমানে
আমি কয়েকটি ঝপবহব মিস্ করেছি।
যা হোক, আমি ঘাড় ঘুরিয়ে, কখনোবা
একটু দাড়িয়ে দেখছি যে, পুরো হল
ভর্তি দর্শক হয়েছে কিনা। একসময় হল
কানায়-কানায় পূর্ণ হলো এবং যারা
দেরিতে আসছেন তাদের মুখে একটাই
প্রশ্ন? ‘কালা পাখি’ গানটা কি হয়ে
গেছে? পাশ থেকে জবাব দেয়া হলোনা-না বসেন। তারমানে বোঝা গেল, এ
গানটি ‘হাওয়া’ সিনেমাকে অনেকখানি
সামনে ঠেলে দিয়েছে। আর প্রযোজক
তো নিজ মুখে বলেছেন? এই এক
সিনেমা দিয়ে আরো চার সিনেমা
বানানো যাবে।
‘হাওয়া’ সিনেমার পরিচালক মেজবাউর
রহমান সুমন ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ে
চারুকলা বিভাগের ছাত্র ছিলেন। আর
হাশিম মাহমুদ ছিলেন ‘ছায়ানট’-এর
ছাত্র। ছায়ানটের ক্লাশ শেষে
ইউনিভার্সিটি ল্যাবরেটরি স্কুল থেকে
সোজা যেতেন চারুকলায়। সেখানেই
বকুলতলায় বসে সংগীত পিপাসুদের
সাথে মিলে আড্ডা দিতেন, গান
বাঁধতেন, সুর দিতেন এবং নিজ গলায়
গাইতেন। এরকম একটি আবহ থেকেই
‘তুমি বন্ধু কালা পাখি’ গানটি আজ
থেকে ২০/২২ বছর আগে তৈরী
হয়েছে। সে সময়কার ভিডিও
রেকর্ডও ইউটিউবে পাওয়া যায়।
একটা চমৎকার কথা হাশিম
মাহমুদ সব-সময় বলতেন তা হলো, তাঁর গান একদিন
হাজার-হাজার
মানুষ শুনবে। দেশ-বিদেশের মানুষ
তাঁকে চিনবে। আজ তা সত্যে পরিণত
হয়েছে। নারায়ণগঞ্জের তল্লা এলাকায়
অভিজাত ঢাকার এমন কোন পত্রিকা বা
টিভি চ্যানেল নেই যারা হাশিম
মাহমুদের মুখের কথা শোনার জন্য,
ছবি তোলার জন্য ধর্না দেননি। অবশ্য
এটি তারা অবশ্য-কর্তব্য বলে মনে
করেছেন।
অনেকদিন পর একটা বাংলাগানের কথা
ও সুর যখন বাংলাদেশের আকাশেবাতাসে তখন তাঁর সৃষ্টিকারীকে একটু
কাছ থেকে দেখা বা তাঁর দু-একটা কথা
শোনার তাগিদ অনুভব করলাম। সেই
তাগিদ থেকেই হাশিম মাহমুদের বাসায়
যাওয়া। কিন্তু‘‘ নাম জিজ্ঞেস করতেই
জানালেন, উনি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, লালন
শাহ, কাজী নজরুল ইসলাম। আবার
কখনোবা শামসুর রাহমান। বোন
দিলারা মাসুদ ময়না জানালেন হাশিম
মাহমুদ মস্তিষ্কের সিজোফ্রেনিয়া রোগে
ভুগছেন। এতে রোগী কথা বলতে
বলতে খেই হারিয়ে ফেলেন বা কথার
সূত্র থেকে সরে যান। ভাই রাশেদুল
হাসান জীবন (সরকারি মিউজিক
কলেজের তবলা বিভাগের প্রভাষক)
জানালেন, হাওয়া সিনেমা কর্তৃপক্ষ
তাদের উদ্যোগে হাশিম মাহমুদকে
ডাক্তার দেখিয়েছেন, উন্নত চিকিৎসা
চলছে। নারায়ণগঞ্জে মা জমিলা
আকতারের সাথে থাকেন হাশিম
মাহমুদ। মা’র চাওয়া তার সন্তান যেন
সুস্থ¯’’ হয়ে ওঠেন। পাঁচ ভাই দুই বোনের
মধ্যে হাশিম পঞ্চম। দেওভোগ সরকারি
প্রাথমিক বিদ্যালয়, নারায়ণগঞ্জ
হাইস্কুল, তোলারাম ডিগ্রি কলেজে
পড়েছেন হাশিম মাহমুদ। ছোট বেলা
থেকেই পরিবারে সাহিত্য-সংস্কৃতি চর্চার
মধ্যে বড় হয়েছেন। স্থানীয় নবারুণ’
পত্রিকায় নিয়মিত লিখতেন। ‘ধপাস’
নামে একটি ছড়া গ্রš’’ এবং ‘বিলুদের
দিনরাত্রি’ নামে একটি ছোট গল্পের বই
আছে। গান লিখেছেন প্রায় ৯০টি,
কিš‘ সংরক্ষণ করা গেছে ৫০/৬০টি।
ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা গানগুলো
সংরক্ষণের চেষ্টা চলছে। পরিবারের
পক্ষ থেকে জানানো হয়, হাওয়া
সিনেমার গানের আগেও তার আরো
গান মানুষের মুখে মুখে ছিল।

‘তুমি বন্ধু কালা পাখি’ গান ‘হাওয়া’
সিনেমায় জনপ্রিয় হওয়ায় আমরা
হাশিমকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, এটি
তার সেরা গান কিনা! তিনি জানিয়েছেন
এটি তাঁর সেরা গান নয়। তবে গানটি
অনেক গানের মধ্যে কালজয়ী হয়ে বেঁচে
থাকবে। গানের মানুষ হিসেবে আমি
হাশিম মাহমুদের নিজের কণ্ঠে গানটি
শুনলাম। বলার অপেক্ষা রাখে না,
একটা ভিন্ন মাত্রার আমেজ মেশানো।
‘ফুল ফুটেছে গন্ধে সারামন’ ‘তোমার
আমায় ধরতে পারি বাজি’ গান দুটো যে
কোন সংগীতবেত্তা শুনলে বলবেন
এরকম সুরের কাঠামোর গান গত ৫০
বছরে সুরারোপিত হয়নি। তিনি
নিয়মিত গান লিখলে এবং তা প্রচারিত
হলে একটা নিজস্ব ট্র্যাক তৈরি হবে।
‘হাওয়া’ ও ‘হাশিম’ সম্পর্কে আমরা ওই
সিনেমা সংশ্লিষ্ট অন্যান্যদের অনুভুতি
শুনতে চাইলাম?
চঞ্চল চৌধুরী (অভিনেতা)ঃ হাশিম ভাই
আমাদের প্রাণের মানুষ। আমরা যখন
চারুকলায় ফার্স্ট ইয়ার/সেকেন্ড ইয়ারে
পড়তাম তখন হাশিম ভাই প্রতিদিন
এসে গান বাজনা করতো। কখনো
বারান্দায়, কখনো বকুল তলায়, কখনো
ছবির হাটে, কখনো সামনের ফুটপাতে।
তারসাথে কেউ গিটার বাজাত, কেউ
দোতরা, একতারা ইত্যাদি। আমরা
তার সাক্ষী। আজ সারাদেশের মানুষ যে
তার গান শুনছে এটা অনেক আনন্দের।
এমন নয় যে, উনি গান লিখেছেন আমি
অভিনয় করেছি। প্রায় ২৫/৩০ বছর
ধরে আমি তাকে চিনি। তিনি অনেক
ভালো-ভালো গান লিখেছেন-সুর
করেছেন। আজ সারা দেশের মানুষ
তাকে চিনছে, একজন শিল্পীর বড়
স্বার্থকতা এটাই। হাওয়ায় গানটি
কালজয়ী হয়ে রইলো।
মেজবাউর রহমান সুমন (পরিচালক)ঃ
হাশিম ভাইয়ের সাথে আমার
চারুকলাতে পরিচয়। চঞ্চল ভাই
চারুকলাতে আমাদের সিনিয়র ভাই
ছিলেন। চারুকলার অনেক ভাই হাশিম
ভাইয়ের গানের সাথে পরিচিত। আজ
যে গোটা দেশের মানুষ হাশিম ভাইয়ের
গান শুনছে তা অনেক অনেক
আনন্দের। হাওয়া সিনেমার
মাধ্যমে তার গানের যে পরিচয়
এটাই আমাদের স্বার্থকতা।
হাশিম ভাই অনেক গুণী
একজন গীতিকার-সুরকার।
তার অনেক গান আমরা
শুনেছি।
ইমন চৌধুরী (সংগীত
পরিচালক)ঃ প্রায় তিন বছর
ধরে আমরা গানটা করেছি।
থিমটা সিনেমা শুরু হবার
আগেই পরিচালক মেজবাউর
রহমান সুমন আমাদের বলে
দিয়েছিলেন যে, অনেকগুলো
লঞ্চ এক সাথে ভিরে তার
ছাদের উপর ৪০/৫০ জন মাঝি
গানটা খোলা আকাশের নিচে
গাবে। কোন Instrument.
থাকবে না। এই Standard.
মেনেই গানটা এগিয়ে গেছে। এই গানে
আমি Music Direction. এ ছিলাম বটে

কিন্তু‘ প্রত্যেকটা মানুষের কষ্টপরিশ্রম এখানে কাজ করেছে। কতবাররেকর্ডিং যে এই গানের জন্য হয়েছে তা
বলে শেষ করা যাবে না।
এরফান মৃধা শিবলু (কণ্ঠশিল্পী)ঃ ৯৮
সাল থেকে আমার হাশেম ভাইয়ের
সাথে পরিচয়। টিএসসিতে এক চায়ের
দোকানে উনার গান শুনে আমি
মন্ত্রমুগ্ধের মত দাড়িয়ে থাকি। তারপর
থেকেই আলাপ, আড্ডা, গান শোনা,
গান গাওয়া চলতে থাকে। হাওয়া
সিনেমায় প্রথমে হাশিম ভাইকে দিয়েই
গানটি গাওয়ানোর চেষ্টা করা হয়েছিল
কিন্তু‘ উনি অসু¯’ থাকায় পরিচালক
আমাকে গানটি গাইবার চেষ্টা করতে
বলেন। হাশিম ব্যর্থ না হলে গানটি
অনেক ভালো হতো কারণ উনি খুব
ফিল করে গানটা গাইতেন।
মিঠুন চক্রবর্তী (যন্ত্রশিল্পী)ঃ এ গানটা
আমাদের ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ।
প্রথমে অনেক তিক্ত অভিজ্ঞতা দিয়ে
শুরু কারণ সাধারণ গানের মত এটি
ছিলোনা। অনেক রিহার্সেল করতে
হয়েছে নানা প্রাকৃতিক অনুষঙ্গ (অযন্ত্র)
দিয়ে। অনেক সময় লেগেছে। অনেক
বিরক্তি নিয়ে কাজটা শুরু করেছিলাম।
তবে যখন শিবলু ভাই গানটা গাইল
তখন জোস লেগেছে। আমরা গানটার
স্পন্দন ধরতে পেরেছিলাম যা
শ্রোতাদের আকৃষ্ট করেছে এবং গানটার
জবধষ গধমরপ এটাই। গানটার প্রথম
ক্রেডিট যিনি লিখেছেন সুর করেছেন,
তারপর যিনি গানটা গেয়েছেন, তারপর
পরিচালক সুমন ভাই, তারপর সংগীত
পরিচালক, সবশেষে আমি। এ গানটা
ছিল আমাদের একটা বড় জার্নি।
‘হাওয়া’ সিনেমার কুশীলবদের আমরা
অভিনন্দন ও প্রাণঢালা শুভে”ছা জানাই
আর একজন হাশিম মাহমুদের আশু
আরোগ্য কামনা করি, যেন সুস্থ¯’ হয়ে
নিজের সৃষ্টির স্বাদ পরিপূর্ণরূপে গ্রহণ
করতে পারেন।

শাহীনুর রেজা
কণ্ঠশিল্পী, লেখক, গবেষক
shahinurmusic70@gmail.com


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এই ক্যাটাগরির আরো নিউজ