সম্প্রতি মার্কিন ভিসা নিষেধাজ্ঞার বিষয়টি বেশ আলোচিত হচ্ছে। বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্টের একটি বক্তব্য ঘিরে বিষয়টি নতুন করে চর্চায় এসেছে। যেখানে বলা হয়েছে বাংলাদেশে আগামী নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু করতে যারা বাধা দেবে তাদেরকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভিসা দেবে না। আমেরিকার এই ভিসা নীতি ঘোষণার পরই রাজনৈতিক অঙ্গন সরগরম। আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি দেখাতে চাইছে নতুন ভিসা নীতি কারণে তাদের প্রতিপক্ষ চাপে পড়েছে।
|
বিবিসির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইতোমধ্যে আফ্রিকার কয়েকটি দেশে মার্কিন ভিসা নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়েছে। সেসব দেশ হচ্ছে– নাইজেরিয়া, উগান্ডা এবং সোমালিয়া। এসব দেশে ভিসা নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়েছে নির্বাচনের পরে। অন্যদিকে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে ভিসা নিষেধাজ্ঞার হুমকি দেয়া হয়েছে নির্বাচনের অন্তত সাত মাস আগে। প্রশ্ন হচ্ছে, আফ্রিকার দেশগুলোতে এই ভিসা নিষেধাজ্ঞার বিষয়টি কতটা কার্যকর হয়েছে?
নাইজেরিয়া
বাংলাদেশে ভিসা নীতি ঘোষণার ঠিক নয় দিন আগে একই ধারা ব্যবহার করে নাইজেরিয়াতে ভিসা নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়েছে। সেখানে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ভোটারদের ভয় দেখানো, ভোটের ফলাফল কারচুপি ও গণতন্ত্রবিরোধী কর্মকাণ্ডের জন্য কিছু ব্যক্তির বিরুদ্ধে ভিসা নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে আমেরিকা।
২০১৯ সালের নির্বাচনের এক মাস আগেও আমেরিকা ঘোষণা করেছিল – নাইজেরিয়ায় নির্বাচন সুষ্ঠু না হলে জড়িতদের বিরুদ্ধে ভিসা নিষেধাজ্ঞা দেয়া হবে। সে বছরই সাধারণ ও স্থানীয় দুই নির্বাচনের পর দুই দফায় কিছু ব্যক্তির উপর ভিসা নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিল আমেরিকা।
নাইজেরিয়া থেকে বিবিসির সংবাদদাতা নকোচি ওবোন্না বলেন, কিছু ব্যক্তির উপর ভিসা নিষেধাজ্ঞা দিলেও নাইজেরিয়ার রাজনৈতিক পরিস্থিতির কোন পরিবর্তন হয়নি।
যাদের উপর ভিসা নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়েছিল তাদের নাম প্রকাশ করা হয়নি। ফলে তাদের পরিচয় কেউ জানে না। গোপনীয়তার অধিকারের জন্য আমেরিকার সেসব নাম প্রকাশ করেনি।
“সোশ্যাল মিডিয়ায় কিছু নাম ছড়িয়ে পড়েছিল। এসব নামের বিষয়ে বিবিসির তরফ থেকে সত্যতার খোঁজ নেয়া হয়েছিল। তখন আমেরিকার তরফ থেকে লেগোস অফিসকে জানানো হয় – সেসব ভুয়া,” বলেন মি. ওবোন্না।
২০১৯ সালে ভিসা নিষেধাজ্ঞার পরে ধারণা করা হয়েছিল যে এসব আর হবে না। মি. ওবোন্না মনে করেন, আমেরিকা যদি নাম প্রকাশ করতো তাহলে হয়তো এটার প্রভাব থাকতো।
“২০১৯ সালে ভিসা নিষেধাজ্ঞার পরও ২০২৩ সালে নাইজেরিয়ার নির্বাচনে সহিংসতা হয়েছে, ভোটারদের ভয় দেখানো হয়েছে, এমনও নজির দেখা গেছে যে ব্যাপক সংখ্যক ফলোয়ার থাকা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করে হুমকি, সহিংসতার উস্কানি দেয়া হয়েছে”
নাইজেরিয়ার প্রভাবশালী রাজনৈতিক ও সরকারি কর্মকর্তাদের অনেকের পরিবার আমেরিকায় বসবাস করে। অনেকে সেখানে বসেই ‘উস্কানিমূলক’ পোস্ট দিয়েছে। সর্বশেষ প্রেসিডেন্ট নির্বাচন নিয়ে বিরোধী দল আদালতে গেছে যে প্রক্রিয়া চলমান।
সোমালিয়ার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ভোট দিয়েছেন পার্লামেন্টের সদস্যরা।
সোমালিয়া
জঙ্গিবাদ, খরা, দারিদ্র্য – এমন নানা সমস্যায় আক্রান্ত আফ্রিকার আরেক দেশ সোমালিয়া। সোমালিয়ার রাজনৈতিক সংকটের জায়গা হল তারা কখনোই সময়মত নির্বাচন সম্পন্ন করতে পারে না। রাজনৈতিক বিরোধ, অস্থিতিশীলতা, নিরাপত্তা এমন নানা কারণে নির্বাচন বারবার পিছিয়ে যায়।
২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে যে নির্বাচন হওয়ার কথা তার এক বছর পার হয়ে যায়। ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে সোমালিয়ার জন্য ভিসা নীতি ঘোষণা করে আমেরিকা। এর উদ্দেশ্য ছিল সোমালিয়ায় যেন দ্রুত এবং সঠিকভাবে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়।
নির্বাচন পিছিয়ে দিলে নির্বাচনে বাধা সৃষ্টির দায়ে বেশ কিছু সোমালি কর্মকর্তা ও ব্যক্তিবর্গের উপর ভিসা নিষেধাজ্ঞা দেয় আমেরিকা। তবে যুক্তরাষ্ট্র যাদের উপর ভিসা নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে, প্রাইভেসি ইস্যুতে কারো নাম প্রকাশ করেনি।
সোমালিয়ার নির্বাচনে নাগরিকদের সবার ভোট দেয়ার সুযোগ ছিল না। সেখানকার নিয়ম অনুযায়ী বিভিন্ন গোষ্ঠীর নেতারা সাধারণ নির্বাচনে ভোট দিয়ে সংসদ সদস্য নির্বাচন করেন। এর পরের ধাপে সেই সংসদ সদস্যরা ভোট দিয়ে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত করেন। সর্বশেষ ২০২২ সালে যিনি প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন তিনি ৩২৮ জন এমপির মধ্যে ২১৪ ভোট পেয়ে জিতেছেন। অথচ সোমালিয়ার জনসংখ্যা দেড় কোটির বেশি, যাদের মত দেয়ার সুযোগই ছিল না। তবে সম্প্রতি মে মাসের স্থানীয় নির্বাচনে জনগণের ভোট দেয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে।
বিবিসি সোমালি বিভাগের সাবেক সংবাদদাতা বিডান দাহির বলেন, সোমালিয়ায় আমেরিকার যথেষ্ট প্রভাব আছে। ভিসা নিষেধাজ্ঞার ঘোষণা রাজনীতিবিদদের জন্য একটা ধাক্কা ছিল, কারণ সোমালিয়াকে পশ্চিমা সাহায্যের জন্য নির্ভর করতে হয়। রাজনীতিবিদদের অনেকের আমেরিকান পাসপোর্ট আছে, তাদের পরিবার সেখানে থাকে। সোমালিয়ায় আমেরিকার সামরিক ঘাঁটিও আছে।
“মানুষ এই নিষেধাজ্ঞাকে স্বাগত জানায়, কারণ সোমালিয়ার সুপ্রিম কোর্ট বা নির্বাচন কমিশন রাজনীতিবিদদের নিয়ন্ত্রণ করার মতো শক্তিশালী নয়। মানুষ চেয়েছে যে রাজনীতিবিদদের চ্যালেঞ্জ করার এবং জবাবদিহি করার একটা জায়গা থাকুক,” বলেন বিডান দাহির।
মি. দাহির বলেন, সামগ্রিকভাবে আমেরিকার ভিসা নিষেধাজ্ঞা সোমালিয়ার নির্বাচন ও গণতন্ত্রকে অনেকটাই এগিয়ে নিয়েছে। এতে করে সমস্যার সমাধান হয়েছে বলা যায় না।
সবচেয়ে বড় প্রভাব হচ্ছে, সোমালিয়ার রাজনীতিবিদরা বুঝতে পেরেছিলেন যে আমেরিকা তাদের উপর নজর রাখছে। এটা সোমালিয়ার রাজনীতিবিদদের ঐকমত্যে এগিয়ে নিতে, নির্বাচনকে এগিয়ে নিতে সাহায্য করেছে। বর্তমানে সোমালিয়ার স্থানীয় নির্বাচন ‘এক ব্যক্তি, এক ভোট’ নীতিতে অনুষ্ঠিত হচ্ছে।
উগান্ডায় বিরোধীদের দমনের জন্য নিরাপত্তা বাহিনীগুলো শক্তি প্রয়োগ করেছে।
উগান্ডা
আফ্রিকার আরেক দেশ উগান্ডাতেও নির্বাচন ঘিরে কিছু ব্যক্তির উপর ভিসা নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়েছিল। বিবিসির দু’জন সহকর্মী জানান, ভিসা নিষেধাজ্ঞার তেমন প্রভাব উগান্ডায় পড়েনি। উগান্ডায় ১৯৮৬ সাল থেকে ক্ষমতায় আছেন প্রেসিডেন্ট ইওয়েরি মুসেভেনি, একই সাথে রাষ্ট্রপ্রধান ও সেনাপ্রধান।
প্রেসিডেন্টের সমর্থকরা তাঁকে দেশে শান্তি ও সমৃদ্ধি আনার জন্য প্রশংসা করেণ। সমালোচকরা তাঁর কর্তৃত্ববাদী হয়ে ওঠার সমালোচনা করেন। একটা সময় তরুণ নেতা হিসেবে মুসেভেনির প্রশংসা করতো পশ্চিমারাও। একসময় তবে দীর্ঘ দিনে সেটা পাল্টে গেছে।
২০২১ সালের জানুয়ারিতে উগান্ডায় সাধারণ নির্বাচনের পর আমেরিকার তরফ থেকে কিছু ব্যক্তির উপর ভিসা নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়।
নিষেধাজ্ঞা ঘোষণার সময় যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টোনি ব্লিঙ্কেন বলেছিলেন, বিরোধী দলের প্রার্থীদের ধারাবাহিকভাবে হয়রানি করা হয়েছে এবং কোন অভিযোগ ছাড়াই আটক করা হয়েছে।
সে নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হয়নি – একথা উল্লেখ করে মি. ব্লিঙ্কেন বলেন, কয়েক ডজন বিরোধী দলের কর্মী ও সাধারণ মানুষ নিহত হবার জন্য দেশটির নিরাপত্তা বাহিনীগুলো দায়ী। সূত্র: বিবিসি