• বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর ২০২৪, ০২:৩৯ অপরাহ্ন

মার্কিন নিষেধাজ্ঞায় জর্জরিত ইরান যেভাবে ঘুরে দাঁড়াচ্ছে

নিউজ ডেস্ক
আপডেটঃ : বৃহস্পতিবার, ১ জুন, ২০২৩

বিভিন্ন দেশের ওপর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অবরোধ নতুন কিছু নয়। এই অবরোধের মাধ্যমে একটি দেশকে কীভাবে কোণঠাসা করা যেতে পারে বা অর্থনৈতিক কঠিন অবস্থার মাঝে ফেলা যেতে পারে এর উৎকৃষ্ট উদাহরণ মধ্যপ্রাচ্যের দেশ ইরান।

ইরানের প্রতি মার্কিন অবরোধ শুরু হয় সেই ১৯৭৯ সালে ইসলামি বিপ্লবের মাধ্যমে পশ্চিমা বিশ্বের ভাবধারার ইরানি শাসক শাহ পাহলাভি ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পরবর্তী সময় থেকে। সময় যত গড়িয়েছে ইরানের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের অবরোধের ধরন এবং মাত্রা বৃদ্ধি পেয়েছে।

বিপ্লবের পরে বিভিন্ন সময়ে ইরানের ওপর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অবরোধের নমুনা:- ১৯৭৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরে থাকা ইরান সরকারের সকল সম্পদ সাময়িকভাবে জব্দ করা, ১৯৮৪ সালে ইরানের নিকট অস্ত্র বিক্রির ওপর নিষেধাজ্ঞা, ১৯৯৫ সালে মার্কিন নাগরিকদের ইরানের তেলশিল্পের সঙ্গে যে কোনোভাবে জড়িত থাকতে নিষেধাজ্ঞা আরোপ, ২০১০ সালে ‘Comprehensive Iran Sanctions, Accountability and Divestment Act’ জারির মধ্য দিয়ে ইরানের ওপর আরোপিত অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞার সর্বোচ্চ কাজটিও সম্পন্ন করা হয়।

২০১১ সালে এই নিষেধাজ্ঞার মাত্রা বৃদ্ধি করে যেসব বিদেশি কোম্পানি ইরানের তেল ও রাসায়নিক শিল্পের জন্য যন্ত্রপাতি ও কারিগরি সহায়তা প্রদান করে এবং যেসব প্রতিষ্ঠান ইরানি কোনো প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আর্থিক লেনদেনের সাথে জড়িত তাদেরকেও এই নিষেধাজ্ঞার আওতায় আনা হয়।

২০১৫ সালের নভেম্বরে ভিয়েনায় স্বাক্ষরিত ছয় জাতি পারমাণবিক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় কিন্তু এর পরে ২০১৮ সালে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প সেই পারমাণবিক চুক্তি থেকে বের হয়ে অপরিশোধিত তেলের ওপর অবরোধ জারি করেন।

এছাড়াও বিভিন্ন সময়ে ইরান সরকারের সাথে জড়িত এবং বিপ্লবের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি, ডলার বেচাকেনা ও সংগ্রহ, স্বর্ণ বা অন্যান্য মূল্যবান ধাতু বেচাকেনা, অ্যালুমিনিয়াম, স্টিল ও শিল্পকারখানায় ব্যবহৃত সফটওয়্যার আমদানি, ইরানের সার্বভৌম ঋণ, জাহাজ নির্মাণ, জ্বালানি খাতসংক্রান্ত লেনদেন এবং ইরানের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাথে বিদেশি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের আর্থিক লেনদেনের বিষয়গুলোর ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপিত হয়।

iran sanctions

ইরানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অবরোধের প্রভাব:
তেল রপ্তানি কমে যাওয়া
মধ্যপ্রাচ্যের দেশ ইরানের অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি তেল ও গ্যাস। রফতানি আয়ের ৬৩.৩ শতাংশ আসে তেল এবং ৫.৯৬ শতাংশ আসে গ্যাস থেকে। বিভিন্ন সময়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অবরোধের ফলে তেল রপ্তানি বাধাগ্রস্ত হতে থাকে। এছাড়াও যারা ইরান থেকে তেল ক্রয় থাকে সে দেশগুলোর প্রতি অবরোধের হুমকি দেয়া হয়।

ইউএস এনার্জি ইনফরমেশন অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের মতে, তেল রপ্তানি ২০১৭ সালে প্রতিদিন প্রায় ২.৫ মিলিয়ন ব্যারেল থেকে ২০২০ সালে প্রতিদিন সেই পরিমাণ অর্ধেকেরও কমে যায়। যদিও ধীরে ধীরে এখন কিছুটা উন্নতির দিকে যাচ্ছে। যেহেতু আন্তর্জাতিক সকল বাণিজ্যের ৮৫ শতাংশ ক্ষেত্রে মার্কিন ডলার ব্যবহার করা হয়। ইরান তেল রপ্তানি না করতে পারায় ডলার সঞ্চয়ের পথটি বন্ধ হয়ে যায়। এর ফলে ইরানে সরকারের রাজস্বতে এবং অর্থনীতিতে বড় ধরনের প্রভাব পড়েছে।

ইরানি মুদ্রার মান কমে যাওয়া
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পরমাণু চুক্তি ত্যাগ করার পর থেকে আনঅফিসিয়ালি ইরানের বাজারে মার্কিন ডলারের বিপরীতে ইরানি রিয়ালের মান ৫০% হারিয়েছে। এর ফলে আমদানিকৃত পণ্য ও যে পণ্য তৈরিতে বিদেশ থেকে কাঁচামাল ডলার দিয়ে কিনে আনতে হয় সেগুলোর মূল্য অত্যধিক পরিমাণে বৃদ্ধি পেয়েছে। অর্থাৎ ডলারের দাম বেশি হলে জিনিসপত্রের আমদানি খরচ বাড়বে এবং সবশেষে সাধারণ মানুষকেও বেশি মূল্য দিয়ে তা ক্রয় করতে হবে।

জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধি
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অবরোধের ফলে কাঁচামাল আমদানি করে যে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র দেশে উৎপাদন করা যেত তা ব্যাহত হচ্ছে। অনেকক্ষেত্রে উৎপাদন করা সম্ভব হলেও প্রচুর পরিমাণে সেগুলো আমদানিতে অর্থ খরচ বৃদ্ধি পেয়েছে যার ফলে অনেক প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের মূল্য প্রতিনিয়ত বাড়ছে। বিশেষ করে বিদেশি পণ্যসহ অন্যান্য জিনিসপত্রের দাম। এর ফলে ইরানের সাধারণ জনগণের জীবন কঠিন অবস্থার মধ্য দিয়ে অতিবাহিত হচ্ছে।

জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যাওয়ায় সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রায় যেমন বিরূপ প্রভাব পড়ছে তেমনি সর্বোচ্চ নাগরিক সুবিধা পাওয়ার ক্ষেত্রেও প্রতিবন্ধকতা তৈরি হয়েছে। অবরোধের প্রভাবের মাঝে একটি হচ্ছে ইরানের স্বাস্থ্যখাত। মহামারি করোনার সময়ের যদি উদাহরণ দেই, সেই সময় মার্কিন অবরোধের কারণে ওষুধ সহ বিভিন্ন কাঁচামাল ক্রয়ের ক্ষেত্রে বাধার সম্মুখীন হতে হয় ইরানকে। এর ফলে করোনা রোগীদের সর্বোচ্চ চিকিৎসাসেবা প্রদান ব্যাহত হতে থাকে। ২০২০ সালের ডিসেম্বরে, ইরানের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রধানের মতে, ইরানের ব্যাংকগুলির বিরুদ্ধে মার্কিন নিষেধাজ্ঞার কারণে ইরান একটি কোভিড-১৯ ভ্যাকসিনের জন্য অর্থ প্রদান করতে ব্যর্থ হয় এবং ভ্যাকসিন ক্রয়ের ক্ষেত্রে বাধার সম্মুখীন হতে হয়।

iran

অবরোধের প্রভাব থেকে উত্তরণে ইরানের চেষ্টা:
নতুন বলয় সৃষ্টির চেষ্টা

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অবরোধের প্রভাব কমাতে ইরান সব সময় চেষ্টা করেছে বাণিজ্যিক সহ অন্যান্য ক্ষেত্রে নতুন একটি বলয় তৈরি করতে এবং এতে পাশে পেয়েছে চীন এবং রাশিয়াকে। এছাড়াও আর্থিক লেনদেন ব্যবস্থা গড়ে তুলতে ইউরোপীয় ইউনিয়নের মাধ্যমে চেষ্টা চালিয়ে গিয়েছে। ইরানের তেল আয়ের সিংহভাগ চীন থেকে। এর ফলে যুক্তরাষ্ট্র চীনকেও নিষেধাজ্ঞার আওতায় আনার পরিকল্পনা করে যদিও চীন আনুষ্ঠানিকভাবে মার্কিন নিষেধাজ্ঞা অমান্য করেই ইরানি অপরিশোধিত তেল আমদানির ঘোষণা দেয়।

নিজের দেশকে স্বয়ংসম্পূর্ণ হিসেবে গড়ে তোলার উদ্যোগ

ইরান ১৯৭৯ সালের বিপ্লবের পর থেকেই চেষ্টা করছে নিজের দেশকে সবদিক থেকে স্বয়ং সম্পূর্ণ হিসেবে গড়ে তোলা। নিজ দেশে গবেষক, বিজ্ঞানী তৈরি এবং বিদেশে ডিগ্রি অর্জন করে আবারো তাদের দেশে ফিরিয়ে নিয়ে আসা ইত্যাদি উদ্যোগ লক্ষণীয়।

এমন সব পরিকল্পনা থাকায় নিজ দেশেই অনেক প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র উৎপাদনের সক্ষমতা অর্জন করছে ইরান। এর ফলে অন্যান্য দেশের ওপর পর নির্ভরশীল কমছে। অন্যদিকে আমদানিকৃত পণ্যের ঘাটতি দেশীয় উৎপাদনকে যেমন উৎসাহিত করেছে তেমনি ইরানিদের জন্য আরও কর্মসংস্থান তৈরি করতে সহায়তা করেছে তা বলায় যায়। এক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের এত অবরোধের পরেও অনেক ক্ষেত্রে অবরোধের প্রভাব কাটিয়ে উঠা সম্ভব হয়েছে।

ডলার সংকট এড়াতে নতুন খাতগুলো গুরুত্ব দেয়া

ডলার সংকট এড়াতে ইরান নিজেদের বাণিজ্যিক রপ্তানি খাতসহ পর্যটন শিল্প এবং শিক্ষা খাতকে গুরুত্ব দিচ্ছে। ইরানের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এবং পর্যটন কেন্দ্রগুলোকে ঘিরে বিদেশি পর্যটকদের কীভাবে আকৃষ্ট করা যায় তা নিয়ে ইরানের দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা সচেষ্ট ভূমিকা পালন করছেন।
এছাড়াও ইরানের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর পড়াশোনার মান বৃদ্ধি করে ওয়ার্ল্ড র‍্যাংকিংয়ে নিয়ে এসে সেখানে বিদেশি শিক্ষার্থীদের পড়তে আগ্রহী করে ডলারের মাধ্যমে টিউশন ফি নিয়ে নিজেদের ডলার সঞ্চয়কে বৃদ্ধি করতে তারা নিয়মিত কাজ করে যাচ্ছেন।

এর পাশাপাশি ইরানে চিকিৎসা ব্যবস্থাকে বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে যার ফলে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে অনেকেই বিভিন্ন রোগেরে চিকিৎসায় ইরানকে বেঁছে নিচ্ছেন।

এরপরেও ইরান সরকার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে নিজেদের সর্বোচ্চ সক্ষমতা দিয়ে অর্থনৈতিক অবস্থাকে পৃথিবীর বুকে একটি স্থিতিশীল অবস্থায় নিয়ে যেতে। বলা কঠিন এই চেষ্টা সর্বোচ্চ সফলতার আলো দেখতে কতটা সময় নিবে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অবরোধ কখনোই কোন দেশের জন্য সুখকর নই। আশা করছি ইরানের ওপর এই অবরোধের সমাপ্তি ঘটবে এবং ইরান ফিরে পাবে নিজেদেরকে বিশ্বের বুকে সর্বোচ্চ মেলে ধরার।

লেখক: কামরুজ্জামান নাবিল

ইস্পাহান মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, ইরান।


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এই ক্যাটাগরির আরো নিউজ