• বৃহস্পতিবার, ২৮ নভেম্বর ২০২৪, ১২:৫২ পূর্বাহ্ন

চীন-মার্কিন সংঘাত কি অবধারিত?

নিউজ ডেস্ক
আপডেটঃ : মঙ্গলবার, ৬ জুন, ২০২৩

সিংগাপুরে নিরাপত্তার ওপর আন্তর্জাতিক এক সম্মেলনে রোববার চীনা প্রতিরক্ষামন্ত্রী লি শাংফু হুঁশিয়ার করেছেন চীন ও আমেরিকার মধ্যে যুদ্ধ হলে তা পুরো বিশ্বের জন্য “অসহনীয় এক বিপর্যয়” ডেকে আনবে। মার্চে দায়িত্ব নেয়ার পর তার প্রথম কোনো গুরুত্বপূর্ণ ভাষণে চীনা মন্ত্রী বলেন, বাইরের “কিছু দেশ” এশিয়াতে একটি অস্ত্র প্রতিযোগিতা উসকে দিচ্ছে। স্পষ্টতই তিনি আমেরিকা এবং তার মিত্রদের দিকে ইঙ্গিত করেছেন।

সাং-রিলা ডায়ালগ নামে পরিচিত ঐ সম্মেলনের ভাষণে জেনারেল লি “শীতল যুদ্ধের মানসিকতা” লালনের জন্য যুক্তরাষ্ট্রকে অভিযুক্ত করে বলেন এই মানসিকতা “নিরাপত্তার জন্য চরম ঝুঁকি তৈরি করেছে।” সিংগাপুরে নিরাপত্তা নিয়ে এই সম্মেলন চলার সময়েই তাইওয়ান প্রণালীতে একটি চীনা এবং একটি মার্কিন যুদ্ধজাহাজের মধ্যে বিপদজনক পরিস্থিতি তৈরি হয়। যুক্তরাষ্ট্র অভিযোগ করেছে চীনা জাহাজটি তাদের একটি জাহাজের সামনে হঠাৎ এমনভাবে হাজির হয় যা নিরাপত্তা ঝুঁকি তৈরি করে। চীনারা পাল্টা অভিযোগ করেছে আমেরিকা “ইচ্ছাকৃতভাবে উসকানি দেয়ার চেষ্টা করছে।”

সাং-রিলা সম্মেলনে চীনা প্রতিরক্ষামন্ত্রী বলেন “এই পৃথিবী এত বড় যে চীন ও যুক্তরাষ্ট্র উভয় দেশই সেখানে জায়গা করে নিতে পারে এবং দুই পরাশক্তির উচিৎ অভিন্ন স্বার্থের পথ খোঁজা।” কিন্তু সেই সহাবস্থানের জন্য বিশ্বাসযোগ্য কোনো উদ্যোগ কি এই দুই দেশের রয়েছে? কেউই তা দেখতে পাচ্ছেন না। কারণ চীনা প্রতিরক্ষামন্ত্রী স্বয়ং তার ভাষণে যুদ্ধের পরিণতি সম্পর্কে বিশ্বকে সাবধান করলেও তেমন যুদ্ধ এড়ানোর জন্য তারা কী করছেন তা বলেননি। লিই যে প্রথম কোনো সিনিয়র চীনা নেতা যার মুখ দিয়ে যুদ্ধ শব্দটি উচ্চারিত হলো তা নয়। এর আগে মার্চে চীনা পররাষ্ট্রমন্ত্রী কিন গ্যাং বলেন, যুক্তরাষ্ট্র যদি তাদের “বর্তমান তৎপরতায় রাশ না টানে এবং একই ভুল পথে চলতে থাকে” তাহলে দুই দেশের মধ্যে “সংঘাত অবশ্যম্ভাবী।“

শুধু চীনাদের কাছ থেকে নয়. আমেরিকার ভেতর থেকেও ইদানীং চীনের সাথে সরাসরি যুদ্ধের সম্ভাবনার কথা এমনকি অনেক দায়িত্বশীল ব্যক্তির মুখ থেকেও শোনা যাচ্ছে। ফেব্রুয়ারিতে আমেরিকার বিমান বাহিনীর একজন চার-তারকা জেনারেল, মাইক মিনিহান, তার অধীনস্থ সেনা ইউনিটগুলোর কাছে এক চিঠিতে লেখেন ২০২৫ সালে চীনের সাথে আমেরিকার যুদ্ধ হবে, এবং সেজন্য তিনি তার সৈন্যদের প্রস্তুত হতে বলেন। জেনারেল মিনিগান মার্কিন বিমান বাহিনীর এয়ার মোবিলিটি কম্যান্ডের প্রধান। তার অধীনে ৫০০০০ সৈন্য এবং ৫০০ যুদ্ধবিমান রয়েছে।

তার এই কথা নিয়ে অনেক হৈচৈ হয়েছে, তবে অনেক বিশ্লেষক মনে করেন চীনকে নিয়ে আমেরিকাতে যেসব আলোচনা চলছে, জেনারেল মিনিহানের কথায় তারই প্রতিফলন ছিল। লন্ডনের দৈনিক ফাইনানসিয়াল টাইমসের আন্তর্জাতিক ঘটনাপ্রবাহের প্রধান ভাষ্যকার, গিদিওন র‍্যাকম্যান এপ্রিলে যুক্তরাষ্ট্র থেকে ফিরে তার এক ভাষ্যে লিখেছেন – চীনের সাথে যুদ্ধের সম্ভাবনা নিয়ে ওয়াশিংটনে যেভাবে খোলাখুলি কথাবার্তা হচ্ছে তাতে তিনি বিস্মিত হয়েছেন। “সরকারের ভেতর এবং বাইরের অনেক প্রভাবশালী ব্যক্তি মনে করেন চীনের সাথে যুদ্ধ খুবই সম্ভব।“

ব্রিটেনে কৌশলগত ঝুঁকি সম্পর্কিত গবেষণা প্রতিষ্ঠান কন্ট্রোল রিস্কের সাম্প্রতিক এক রিপোর্টে বলা হয় যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের সম্পর্কের টানাপড়েন ব্যবসা-বিনিয়োগের সমনে এখন সবচেয়ে বড় ঝুঁকি। তারা বলছে, যদিও ২০২৩ সালে কোনো সংঘাত শুরু হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম, “কিন্তু দুই দেশের রেষারেষি এখন ব্যবসা এবং প্রযুক্তি ছাপিয়ে সামরিক অঙ্গনে প্রবেশ করেছে।“ কন্ট্রোল রিস্ক তাদের বিশ্লেষণে বলছে – “এশিয়াতে চীনা এবং আমেরিকান যুদ্ধ জাহাজগুলো এখন খুব কাছাকাছি চলাচল করছে এবং যে কোনো সময় যে কোনো পক্ষ ভুল সিদ্ধান্ত নিতে পারে, এবং তেমন পরিস্থিতির জন্য ২০২৩ সালে কোম্পানিগুলোকে প্রস্তুত থাকতে হবে।“

ঐ প্রতিষ্ঠানের মতে, দুদেশই এখন একটি সংকটে জড়িয়ে পড়ার জন্য প্রস্তুত হচ্ছে এবং সে লক্ষ্যে তারা “সামরিক পরিকল্পনা, কূটনৈতিক তৎপরতা এবং দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিকে প্রস্তুত করছে।“ সবচেয়ে বড় কথা, উত্তেজনা কমাতে দুদেশের মধ্যে যেসব রাজনৈতিক, কূটনৈতিক, সামরিক চ্যানেলগুলো কাজ করতো তা এখন আগের যে কোনো সময়ে চেয়ে দুর্বল এবং অকার্যকর হয়ে পড়েছে। সেই লক্ষণ এ সপ্তাহে চোখে পড়েছে সিংগাপুরে সাং-রিলা সম্মেলনেও।

সম্মেলন শুরুর আগের দিন রাতে আগত অতিথিদের জন্য আয়োজিত নৈশভোজে চীনা প্রতিরক্ষা মন্ত্রী লি শাংফু এবং মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী লয়েড অস্টিন হ্যান্ডশেক করে খুব অল্প সময়ের জন্য কুশল বিনিময় করেছেন, কিন্তু তাদের মধ্যে কার্যত কোনো কথাই হয়নি। মার্কিন প্রতিরক্ষা দপ্তরের সূত্র উদ্ধৃত করে নিউইয়র্ক পোস্ট সহ একাধিক আন্তর্জাতিক মিডিয়া খবর দিয়েছে সম্মেলনের এক ফাঁকে চীনা মন্ত্রীর সাথে একটি দ্বিপাক্ষিক বৈঠকের জন্য আমেরিকার প্রস্তাব চীনারা অগ্রাহ্য করে।

রাশিয়া থেকে যুদ্ধবিমান কেনার জন্য ২০১৮ সালে যুক্তরাষ্ট্র মি. লির ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয়। তিনি তখন চীনা সামরিক কমিশনের ঊর্ধ্বতন একজন কর্মকর্তা ছিলেন। চীনের পক্ষ থেকে ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে তাদের মন্ত্রীর ওপর এ ধরণের নিষেধাজ্ঞা থাকলে দ্বিপাক্ষিক বৈঠকের প্রশ্নই ওঠেনা। নিউ ইয়র্ক পোস্টের রিপোর্ট বলছে সামরিক পর্যায়ে যোগাযোগ এখন এতটাই খারাপ হয়ে পড়েছে যে ফেব্রুয়ারিতে চীনা একটি পর্যবেক্ষণ বেলুন গুলি করে নামানোর ঘটনার ব্যাখ্যা দেওয়ার জন্য মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী ফেব্রুয়ারিতে বেইজিংয়ে ফোন করলেও চীনা মন্ত্রী তার সাথে কথা বলেননি। পেন্টাগনের একজন সিনিয়র কর্মকর্তাকে উদ্ধৃত করে পত্রিকাটি লিখেছে ২০২১ সাল থেকে দুই সেনা কর্তৃপক্ষের মধ্যে যোগাযোগ কার্যত বন্ধ এবং চীনার কোনো কথাতেই সাড়া দিচ্ছেনা।

“এমন পরিস্থিতিই সবচেয়ে বড় বিপদ। দুই বৈরি দেশের মধ্যে যোগাযোগ বন্ধ হলে সংঘাতের ঝুঁকি অনেক বেড়ে যায়। আকস্মিক ভুল কোনো সিদ্ধান্তে দুই পারমানবিক শক্তিধর দেশের মধ্যে অনিচ্ছেকৃতভাবে সংঘাত শুরু হয়ে যেতে পারে,” বলেন ঢাকায় নিরাপত্তা বিষয়ক গবেষণা প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশে ইন্সটিটিউট অব পিস অ্যান্ড সিকিউরিটি স্টাডিজের প্রধান মেজর জেনারেল (অব) এনএনএম মুনীরুজ্জামান। তিনি বলেন, সংঘাত এড়াতে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে এ ধরণের সিবিএম (কনফিডেন্স বিল্ডিং মেজরস) রয়েছে, চীন ও ভারতের মধ্যে রয়েছে। দুই সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ে তাৎক্ষণিক যোগাযোগের ব্যবস্থা রয়েছে। “কিন্তু অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে চীন ও আমেরিকার মধ্যে তা ভেঙ্গে পড়েছে।“

১৯৬২ সালে কিউবায় পারমানবিক ক্ষেপণাস্ত্র মোতায়েন নিয়ে পারমানবিক যুদ্ধের হুমকি তৈরির পরিপ্রেক্ষিতে সেময় ওয়াশিংটন ও মস্কো নিজেদের মধ্যে যোগাযোগের একটি ব্যবস্থা তৈরি করেছিল। ১৯৬৩ সালেই হোয়াইট হাউস এবং ক্রেমলিনের মধ্যে হট-লাইন প্রতিষ্ঠিত হয়। দুই দেশের সামরিক বাহিনীর নেতারা নিয়মিত কথা বলতে শুরু করেন। আর তার ফলেই, শীতল যুদ্ধের প্রচণ্ড রেষারেষির মধ্যেও আমেরিকা ও সোভিয়েত ইউনিয়ন যুদ্ধ এড়াতে পেরেছিল।

আমেরিকা এখন তেমন একটি ব্যবস্থা চাইছে বেইজিংয়ের সাথে। ফাইনানসিয়াল টাইমসের গিদিওন র‍্যাকম্যান লিখেছেন, যুক্তরাষ্ট্র এখন শীতল যুদ্ধের সেই “গার্ড-রেইল মডেলের” দিকে নজর দিয়েছে। তবে চীন রাজী তো হচ্ছেইনা, বরঞ্চ যুক্তরাষ্ট্রের উদ্দেশ্য নিয়ে সন্দেহ করছে। মার্চে চীনা পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বিবৃতিকে প্রত্যাখ্যান হিসাবে দেখেছেন অনেক পর্যবেক্ষক। চীনা পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলার চেষ্টা করেন যুক্তরাষ্ট্র এমন একটি ফাঁদ তৈরির চেষ্টা করছে যেখানে “আক্রান্ত বা অপদস্থ হলেও চীন যেন পাল্টা প্রতিক্রিয়া না দেখাতে পারে।“

চীন মনে করে – তাইওয়ান প্রণালিতে মার্কিন সামরিক গতিবিধি অবৈধ, তাইওয়ান নিয়ে আমেরিকার মাথাব্যথার কোনো কারণ নেই, আর ‘ফ্রিডম অব ন্যাভিগেশনের’ নামে দক্ষিণ চীন সাগরে আমেরিকা এবং তাদের পশ্চিমা মিত্ররা উসকানি দিচ্ছে। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের ভয় – তার শাসনকালেই তাইওয়ানকে চীনা নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসতে প্রেসিডেন্ট শি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছেন। সুতরাং আমেরিকানরা এখন প্রেসিডেন্ট শি জিন পিংয়ের হিসেব-নিকেশ বদলানোর পথ নিয়েছে বলেই মনে হচ্ছে। মিত্রদের ইন্দো-প্যাসিফিকে একত্রিত করছে তারা। জাপানের সামরিক শক্তিবৃদ্ধিকে সমর্থন করছে। অকাস এবং কোয়াডের মত জোট গঠন করেছে। তাইওয়ানের কাছাকাছি ফিলিপাইনের নৌ ঘাঁটিতে বাড়তি জায়গা নিয়েছে।

আর এর ফলে, আমেরিকা চীনকে “আয়ত্তে রাখতে, ঘিরে ফেলতে এবং নতজানু করতে বদ্ধপরিকর” বলে যে প্রেসিডেন্ট শির যে সন্দেহ তা আরো দৃঢ় হচ্ছে। এ মাসে জাপানে জি-সেভেন শীর্ষ বৈঠকের পর চীনের দেওয়া ক্রদ্ধ প্রতিক্রিয়ায় তা স্পষ্ট। জি-সেভেন জোটের শীর্ষ বৈঠকের সময় প্রেসিডেন্ট বাইডেন বলেছিলেন তিনি আশা করছেন চীনের সাথে সম্পর্কে বরফ গলতে শুরু করবে। কিন্তু বাস্তবে বরফ আরও জমাট বাধছে। সম্পর্কের দূরত্ব বাড়ছে, এবং সেইসাথে বাড়ছে অকস্মাৎ বড় কোনো বিপর্যয়ের ঝুঁকি। সূত্র: বিবিসি।


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এই ক্যাটাগরির আরো নিউজ