বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স নিউজ প্রেজেন্টার দেখলাম, ভালোই লাগল। আমাদের দেশের জন্য বিষয়টি আসলেই নতুন। আমি প্রথমে চ্যানেল টুয়েন্টিফোরকে ধন্যবাদ দেব এ উদ্যোগ গ্রহণ করার জন্য। তবে আমি যেটা বলতে চাই, এআই নিউজ প্রেজেন্টার বলতে কোনো শব্দ নেই। হিউম্যান মেশিন কমিউনিকেশন নিয়ে যারা গবেষণা করেন, তারা একটা টার্ম ব্যবহার করেন যাকে বলে ‘এআই অ্যাভাটার’। অ্যাভাটার শব্দটা আবার এসেছে সংস্কৃত থেকে। হিন্দু পুরাণে ‘অবতার’ শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। অ্যাভাটার হলো বাস্তবের মতো একজন মানুষকে কম্পিউটারে দেখতে পাওয়া। বাংলাদেশে যারা গেমস খেলে তাদের সবারই একটা করে অ্যাভাটার আছে। অনলাইন গেমিংয়ে যারা যুক্ত তাদের মাধ্যমে অ্যাভাটার জনপ্রিয় হতে শুরু করে।
সংবাদ প্রচারের কাজে এই অ্যাভাটারের ব্যবহার অনেক আগে থেকেই শুরু হয়েছে। এই প্রযুক্তিকে একদম নতুন বলা যাবে না। আমার নিজের অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, ২০১৯ সালে আমি জার্মানি যাই একটা ‘গ্লোবাল মিডিয়া ফোরাম’ এর কনফারেন্সে। সেখানে আমি নিউজ প্রেজেন্টার অ্যাভাটার দেখি যা চীনের একটা প্রতিষ্ঠান নিয়ে এসেছিল। এই অ্যাভাটার তৈরির জন্য অনেক ওয়েবসাইট আছে, যেমন সিথেসিয়া নামে একটা ওয়েবসাইট আছে যেখানে খুব অল্প খরচে এআই অ্যাভাটার তৈরি করা যায়, সেটাকে সংযোন-বিয়োজন করা যায়। ওয়েবসাইটটি এ জন্য কিছু সাবস্ক্রিপশন ফি নেবে। এটা খুব আহামরি এআই টেকনোলজি না। উন্নত বিশ্বে এটা অনেক আগে থেকে ব্যবহার হয়ে আসছে।
প্রযুক্তির দিক থেকে বলব, আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স প্রতিদিন নতুন কিছু শিখছে, ভবিষ্যতে এটা আরো শিখবে। এ প্রযুক্তি মানব সমাজের কাজে লাগবে। বলতে হয়, এটাই ভবিষ্যৎ। বর্তমানে এআই অ্যাভাটারে হয়তো কিছু খুঁত আছে, কিন্তু মানুষ যখন ভষ্যিতে আরো ভার্চুয়াল রিয়েলিটিতে যাবে, তখন এআই অ্যাভাটারেরও উন্নতি ঘটবে। তখন আমরা আরো ভালো এআই অ্যাভাটর নিউজ প্রেজেন্টার বা সংবাদ পাঠক/পাঠিকা দেখতে পাব।
বাংলাদেশে যে এআই অ্যাভাটার নিউজ প্রেজেন্টার আমরা দেখলাম, তারা কোন ধরনের সফটওয়্যার ব্যবহার করেছেন তা অবশ্য এখনো জানতে পারিনি আমি। কারণ এ কাজের উপযোগী অনেক সফটওয়্যার আছে। যদি কেউ সিনথেসিয়াতে যায়, তাদের কিছু প্যাকেজ আছে। যেগুলো একজন ব্যক্তির জন্য খুব খরচসাপেক্ষ হতে পারে, তবে কোনো সংবাদ প্রতিষ্ঠানের জন্য বড় খরচ হবে না। এ ছাড়া নিজের পছন্দের অ্যাভাটার তৈরি করতে গেলে খরচ বাড়বে। তবে যে অ্যাভাটার তৈরি হয়ে আছে, সেটা কিনতে গেলে খুব বেশি খরচ হবে না। শুধু নিজের উপযোগী করে ব্যবহারের জন্য তাকে তৈরি করতে খরচ হবে।
সিনথেসিয়াতে প্রতি মাসে ৩০ ডলার সাবস্ক্রিপশন ফি রাখে। এখানে ব্যক্তিগত আছে, আবার প্রাতিষ্ঠানিকভাবে অ্যাভাটারকে কাজে লাগানোর সুযোগ আছে। সব মিলিয়ে বড় কোনো খরচের প্রয়োজন নেই।
আবার মোবাইল থেকেও নিজের অ্যাভাটার তৈরি সম্ভব। মোবাইলে নিজের ছবি তুলে অ্যাভাটার বানানো যায়। এর কারণ হলো ব্যবহারকারীকে নতুন করে কিছু তৈরি করতে হয় না এক্ষেত্রে। যা যা প্রয়োজন তা তৈরি হয়েই আছে।
তবে যে বিষয়টা এখানে গুরুত্বপূর্ণ তা হলো, একজন কৃত্রিম সংবাদ পাঠক কি সাংবাদিকদের জন্য হুমকি? এ বিষয় নিয়ে আসলে আমরা অনেকদিন ধরেই গবেষণা করছি। আমরা দেখেছি, যে এআইকে আমরা চোখে দেখতে পাই, তার পক্ষে মানুষের চাকরি খাওয়ার ভয় খুব কম। ভবিষ্যতে সাংবাদিকদের চাকরি কেড়ে নেয়ার ক্ষমতা যদি কারো থাকে সেটা হলো যে এআইকে চোখে দেখা যায় না তা।
যেমন একজন সাংবাদিকের এডিটিং সফটওয়্যার ব্যবহার করতে হয়। যদিও বাংলা ভাষায় ভালো কোনো এডিটিং সফটওয়্যার নাই। এখন নিজ হাতে এডিট করতে হয় বা পত্রিকার মেকআপ করতে হয়। আরো অনেক কাজ হাতের স্পর্শে করতে হয়। সে কাজগুলো খুব সহজে এআই করে দিতে পারবে। যেমন চ্যাট জিপিটি হচ্ছে এআই অ্যাভাটারের চেয়ে খুব শক্তিশালী সফটওয়্যার। যার কর্মক্ষমতা অনেক বেশি। তবে চাকরি হারানোর ভয় এত বেশি পাওয়ার দরকার নেই। কারণ এখন ছাপা পত্রিকার ক্ষয় আমরা দেখতে পাচ্ছি। সংবাদমাধ্যমের ক্ষেত্রে এখন অনলাইনের যুগ বলতে গেলে। এই বিবর্তন ঘটে গেছে। আগে পত্রিকায় চাকরি করার জন্য দক্ষ হতে হতো। এখন ইলেকট্রনিক্স বা অনলাইন মাধ্যমে কাজ করার জন্য দক্ষ হতে হচ্ছে। একইভাবে ভবিষ্যৎ সংবাদমাধ্যম হবে এআই নির্ভর।
এই এআই নির্ভর সংবাদমাধ্যম গড়ে তুলতে গেলে তখন প্রযুক্তিগত জ্ঞান অর্জন করতে হবে। সেটা যে যত দ্রুত মানিয়ে নিতে পারবে, তার পক্ষে তত দ্রুত এইআকে কাজে লাগানো সম্ভব হবে। তখন আর চাকরি হারানোর ভয় থাকবে না। এ ছাড়া সাংবাদিকতা এমন এক পেশা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে যার পরিবর্তন করতে হয়। আজকে যিনি একটি অনলাইন সংবাদমাধ্যম পরিচালনা করছেন, তিনি হয়তো বিশ বছর আগে সেটা নিয়ে ভাবেননি। হয়তো দশ বছর পর অনলাইনেই এআই নির্ভর সংবাদ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। যা মার্কেটিং, সংবাদ প্রচার, সংবাদ তৈরি-সব দিক থেকেই এআই দ্বারা পরিচালিত হবে।
আমার মূল কাজের বিষয় সাংবাদিকরা কীভাবে আর্টিফিশিয়াল ইনটেলিজেন্সকে কাজে লাগাবে তা নিয়ে গবেষণা করা। ফলে আমার দিকটা টেকনিক্যাল না। আমি জানি বাংলাদেশে অনেকে এআই নিয়ে কাজ করছেন এবং এর ব্যবহারও করছেন। তবে বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যমে এর ব্যবহার কতটা হচ্ছে তা আমার জানা নাই। বা আমাদের সংবাদমাধ্যম এআই প্রযুক্তি ব্যবহারের জন্য প্রস্তুত কি না তাও জানা নেই। তবে কাজ হচ্ছে এটা আমি বলতে পারি। কারণ আমার নিজের একটা প্রকল্প আছে ‘বাংলা এআই্’। এটা ছোট একটা স্টার্টআপ, যাতে নিউইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয় অর্থায়ন করেছে। আমরা কাজ করছি কীভাবে অনুবাদ এবং সংবাদ সংগ্রহকে আরো সহজ করা যায় তা নিয়ে।
এ ছাড়া বেঙ্গল ডট এআই কাজ করছে ভয়েজ রিকগনিশন নিয়ে। যেমন কেউ যদি ইংরেজিতে কথা বলেন, তার জন্য একটা সফটওয়্যার আছে অলটার ডট এআই। এই সফটওয়্যার প্রত্যেকটা শব্দকে ট্রানসক্রাইব করে দেবে। আমাদের দেশে যেমন শুনে শুনে লিখতে হয়, তা করতে হবে না।
বিদেশে সাংবাদিকদের জন্য এ ধরনের এআই প্রযুক্তি ব্যবহার করা হচ্ছে। নিউইয়র্ক টাইমস অফিসে আলাদা একটি বিভাগ রয়েছে যেখানে এআই নির্ভর প্রযুক্তি নিয়ে কাজ করা হয়। সেখানে তারা এআই প্রযুক্তির উদ্ভাবন করেন যা সাংবাদিকতার জন্য উপযোগী। গার্ডিয়ান প্রথম জিপিটি-৩ দিয়ে সংবাদ লিখেছিল। রোবট দিয়ে লেখা ছিল সেই প্রতিবেদন ছিল, ‘আর ইউ স্ক্যায়ার্ড হিউম্যান’। বিশ্বের অনেক বড় বড় সংবাদ মাধ্যমে এ খাতে বিনিয়োগ শুরু করেছে।
বাংলাদেশে যারা অনলাইনে কাজ করছেন, তারা খুব সহজে কম খরচে এ ধরনের প্রযুক্তির ব্যবহার শুরু করতে পারেন। কারণ অনেক এআই টুলস বিনামূল্যে পাওয়া যায়। হয়তো কিছু সাবস্ক্রিপশন ফি দিতে হবে। তবে সাংবাদিকরা খুব বেশি কাস্টমাইজ করতে না চাইলে তাদের নতুন করে কিছু উদ্ভাবন করতে হবে না। যেসব টুল এখন পাওয়া যায়, সেগুলো কীভাবে ব্যবহার করা যায় তা শিখে নিতে পারেন বাংলাদেশের সাংবাদিকরা।
তবে এআই অ্যাভাটার সাংবাদিকদের জন্য খুব ছোট একটা ঘটনা। এআই অ্যাভাটার কখনো সংবাদিকদের চাকরির জন্য ক্ষতিকার হবে না। চিন্তা করতে হবে ভবিষ্যতে যে এআই প্রযুক্তি তৈরি হচ্ছে তা নিয়ে। কারণ এ প্রযুক্তির মাধ্যমে ট্রান্সক্রিপ্ট হয়ে যাবে স্বয়ংক্রিয়ভাবে। সংবাদ অথবা ফিচার লেখার কাজও এআই করে দেবে। আর নিউজ এডিট করার বিষয়টি তো অবশ্যই থাকছে। তখন আর সাব-এডিটরের প্রয়োজন হবে না। তবে এর জন্য ভয় পাওয়ার কিছু নাই। যারা এই এআই প্রযুক্তিকে কাজে লাগাতে পারবেন, তারা সংবাদ প্রচার, মার্কেটিং থেকে শুরু করে সব বিষয়ে এগিয়ে থাকবেন।
সুত্র, মো. আশরাফুল গনি: উদ্যোক্তা, প্রজেক্ট বাংলা এআই এবং যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাস টেক ইউনিভার্সিটি অ্যান্ড কলেজের ডক্টরাল স্টুডেন্ট।