দীর্ঘদিন ধরে রাজধানীর গণপরিবহনে প্রধান দুই সমস্যা- অতিরিক্ত ভাড়া আদায় ও ফিটনেসবিহীন গাড়ি। এরমধ্যে অতিরিক্ত ভাড়া আদায় রোধে ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতি রাজধানীর সব রুটে তিন ধাপে চালু করে ই-টিকিটিং সার্ভিস।
২০২২ সালের ১৩ নভেম্বর ৩০টি কোম্পানির ১ হাজার ৬৪৩টি বাস দিয়ে শুরু হয় ই-টিকিটিং সার্ভিস। এরপর চলতি বছরের ১০ জানুয়ারি দ্বিতীয় পর্বে ১৮টি কোম্পানির ৭১৭টি বাসে ই-টিকিটিং চালু করা হয়। সবশেষ ১ মার্চ তৃতীয় পর্যায়ে ১৩টি কোম্পানির ৯৪৭টি বাসে ই-টিকিটিং চালু হয়।
ই-টিকিটিং চালুর শুরুর সময় মালিক সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্যাহ বলেছিলেন, ঢাকা শহর ও শহরতলী রুটের বাসে অতিরিক্ত ভাড়া আদায়সহ বিভিন্ন অনিয়ম দূর করার জন্য ই-টিকিটিং পদ্ধতি চালু করা হয়েছে।
ই-টিকিটিং চালুর ৯ মাস পরে এসে রাজধানীর কোনো রুটের গণপরিবহনেই চালু নেই ই-টিকিটিং। শুরু থেকেই বাস মালিক-শ্রমিকদের বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা না থাকার। ফলে ই-টিকিটিং চালুর পরও যাত্রীদের সঙ্গে চলতে থাকে প্রতিনিয়ত কথা-কাটাকাটি।
এ বিষয়ে যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক বলেন, ই-টিকিটিং ব্যর্থ হয়েছে কারণ শ্রমঘণ্টা হিসেবে শ্রমিকদের বেতন না দিয়ে তাদের কাছে দৈনিক চুক্তিতে বাস দিচ্ছেন। ফলে মালিক নির্দিষ্ট টাকা বুঝে নিচ্ছেন বাসের চালক-হেলপারের কাছ থেকে। অন্যদিকে বাসের চালক-হেলপাররা অতিরিক্ত টাকা আদায় করছেন যাত্রীদের কাছ থেকে। কারণ এ আদায়কৃত টাকা থেকে তারা নিজেদের মজুরির ব্যবস্থা করেন আবার মালিককে দৈনিক চাঁদা দেন।
এদিকে শ্রমিকদের অভিযোগ, মজুরি না বাড়ায় ই-টিকিটিংয়ে লোকসান হচ্ছে। কারণ বাস মালিকদের দৈনিক ৪ থেকে ৫ হাজার টাকা চুক্তি অনুযায়ী দিতে হয়। সেজন্য না চাইলেও চুক্তির টাকা ও নিজেদের মজুরি তুলতে অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করতে হয়।
যা বলছে বাস মালিক সমিতি
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্যাহ বাংলানিউজ প্রতিবেদকের সঙ্গে ফোনে প্রথমে কথা বলতে চাইলেও ই-টিকিটিং কেন কার্যকর নেই এমন প্রশ্ন করার পর জবাব দিতে চাননি।
তখন তিনি বলেন, আমি এখন মিটিংয়ে আছি, কথা বলতে পারছি না।
তবে এ বিষয়ে সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সাংগঠনিক সম্পাদক মাহবুবুর রহমান বলেন, রাজধানীর বাসগুলোতে ই-টিকিটিং চালুর জন্য আমরা চেষ্টা চালাচ্ছি। যেভাবেই হোক কার্যকর করব, আমরা মনিটরিং করছি।
তরঙ্গ পরিবহন, ভিক্টর পরিবহন, রাইদা পরিবহন, মিডলাইন, মালঞ্চ, ভিআইপি, মিরপুর মেট্রো কোনো বাসেই ই-টিকিটিং চলছে না বলে এ প্রতিবেদক পরিবহন মালিক সমিতির নেতাকে জানান।
প্রতি উত্তরে এ পরিবহন নেতা বলেন, তিনি খোঁজ নিয়ে দেখবেন এ বাসগুলোতে কেন চালু নেই। কোন বাসে চালু আছে এমন প্রশ্নের জবাব দেননি মাহবুবুর রহমান।
সমাধানের পথ কী
ই-টিকিটিং ব্যর্থ হওয়ায় সমাধানের পথ নিয়ে ভিন্ন কথা বলছেন নানা জন।
এ সম্পর্কে যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক বলেন, স্মার্ট বাংলাদেশ তৈরির সঙ্গে স্মার্ট গণপরিবহন ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। গণপরিবহনে স্মার্ট পদ্ধতিতে ভাড়া পরিশোধের পদ্ধতি আনতে হবে। এর বিকল্প নেই।
একইসঙ্গে গণপরিবহন শ্রমিক কর্তৃক যাত্রী হয়রানি বন্ধ করতে অবশ্যই তাদের পরিচয়পত্র ইস্যু করতে হবে এবং শ্রম আইন অনুযায়ী মজুরির ব্যবস্থা করতে হবে।
নৌ, সড়ক ও রেলপথ রক্ষা জাতীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক আশীষ কুমার দে বলেন, ই-টিকিটিং চালুর বিকল্প নেই। এটি চালু করতে হবে। আমাদের দেশে মেগাপ্রকল্প হাতে নেওয়ার অনেক রকম সুযোগ-সুবিধা এবং চমকপ্রদ কথাবার্তা বলা হয়। কিন্তু পরবর্তী পর্যায়ে দেখা যায়, প্রকল্প প্রস্তাবনায় অনেক ত্রুটি থেকে যায় প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত পরামর্শক ও কারিগরি বিশেষজ্ঞদের অদূরদর্শিতা। সরকারের উচিত ভবিষ্যতে এ ধরনের প্রকল্প হাতে নেওয়ার সময় সঠিক যাচাই করা। তাহলে জনস্বার্থ সংরক্ষিত হবে।
বিআরটিএ’র চেয়ারম্যান নুর মোহাম্মদ মজুমদার বলেন, তারা সব সময় এ বিষয়গুলো মনিটরিং (নিয়ন্ত্রণ) করতে পারেন না। এক্ষেত্রে ঢাকায় তাদের যে লোকবল আছে তা দিয়ে এটি করা সম্ভব হয়ে উঠে না।
সমাধানের পথ সম্পর্কে চেয়ারম্যান বলেন, যদি কেউ অভিযোগ করে তবে সে বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
কীভাবে অভিযোগ করবে তা জানতে চাইলে তিনি বলেন, কোনো যাত্রী যদি গাড়ির নম্বর প্লেট বা নাম বা কোনো পরিচয় দিয়ে বিআরটিকে জানায় তাহলে সেই গাড়ি ও মালিকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।