• শুক্রবার, ২২ নভেম্বর ২০২৪, ০১:১৭ পূর্বাহ্ন

চলচ্চিত্র বিনিময়ে সাফটা চুক্তির ভালোমন্দ

আপডেটঃ : বৃহস্পতিবার, ৫ অক্টোবর, ২০১৭

‘কেলোর কীর্তি’র কীর্তি কী মনে আছে? ছবিটির বিরুদ্ধে দুর্বার আন্দোলন, মিছিল-মিটিং, মানববন্ধন, স্মারকলিপি, হাইকোর্টের স্থগিতাদেশ- আরও কত কী! তারপরও থামানো যায়নি ছবিটির মুক্তির চাকা। সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের গ্রিন সিগন্যালে পার পেয়ে যায় দেশীয় ‘রাজা ৪২০’ ছবির বিপরীতে আমদানি করা কলকাতার ছবিটি। এর আগে হিন্দি ‘ওয়ান্টেড’ ছবি নিয়েও একই সংকট তৈরি হয়। বাংলাদেশে এ ছবির মুক্তি ঠেকাতে অনেকেই কাফনের কাপড় পরে রাজপথে নামেন। তারপরও ঠেকানো যায়নি, হল মালিকদের ‘মোস্ট ওয়ান্টেড’ এই ওয়ান্টেড ছবির জয়োরথ। আর থামাবেই বা কী করে? গলদ যে গোড়াতেই! বাংলাদেশে ভারতসহ যে কোনো বিদেশি ছবির প্রবেশে ‘বোর্ডিং পাস’ হল সরকারের বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের ‘আমদানি নীতি আদেশ ২০১৫-২০১৮’।

আদেশে বিদেশি ছবি আমদানির রূপরেখা

দেশে-বিদেশি ছবি আমদানি বা ছবি বিনিময়ের ভিত ওই আদেশের ষষ্ঠ অধ্যায়ের ২৬(৪৯) অনুচ্ছেদ। এ অনুচ্ছেদ মতে, ভারত-পাকিস্তান ছাড়া অন্য দেশের ছবি আমদানিতে- ১. তথ্য মন্ত্রণালয়ের ‘অনাপত্তিপত্র’ লাগবে, ২. ইংরেজি ভিন্ন অন্য ভাষার ছবিতে বাংলা বা ইংরেজি সাবটাইটেল লাগবে, ৩. সেন্সর বিধি মানা লাগবে।

ভারতীয় ছবি আমদানি

ভারত-পাকিস্তানের ছবি সরাসরি আমদানি নিষিদ্ধ [অনু-২৬(৪৯)(খ)]। তবে এফডিসির সুনির্দিষ্ট সুপারিশ ও আমদানি পারমিট নিয়ে যৌথ প্রযোজনার ছবির প্রিন্ট নেগেটিভ আনা যাবে।

ছবি বিনিময়

ছবি বিনিময়ের বিষয়টি SAFTA ভুক্ত ৮ দেশের (বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলংকা, নেপাল, ভুটান, মালদ্বীপ ও আফগানিস্তান) মধ্যেই সীমাবদ্ধ। আমদানি আদেশে বলা হচ্ছে, ওইসব দেশের ছবি বাংলাদেশে সরাসরি আনা যাবে না। তার আগে সমানসংখ্যক বাংলাদেশি ছবি ওইসব দেশে রফতানি করতে হবে। এই পূর্বশর্ত মেনে, তথ্য মন্ত্রণালয়ের ‘অনাপত্তিপত্র’ নিয়েই কেবল সাফটাভুক্ত দেশের ছবি আমদানি করা যাবে। [অনু-২৬(৪৯)(গ)]। ছবি রফতানির বিপরীতে এ ছবি আমদানিকে আমরা বলছি ‘ছবি বিনিময়’। লক্ষণীয়, সাফটাভুক্ত দেশগুলোর বাইরে অন্য দেশের ছবি আমদানির ক্ষেত্রে কিন্তু এই ‘ছবি বিনিময়’ এর পূর্বশর্ত নেই।

আমদানি আদেশে যা নেই, অথচ দরকার

চলমান সংকটটি মূলত ভারতীয় ছবি আমদানিকে ঘিরে, যা শুধু ‘ছবি বিনিময়’ সূত্রেই সম্ভব। ওই বিনিময়ে আমদানি আদেশের ভাষ্য কেবল ‘ছবির সমান সংখ্যানুপাতে’ই সীমাবদ্ধ। মানের সমানুপাত, প্রদর্শনের সমানুপাত (হল সংখ্যা), ছবি মুক্তির সমসাময়িকতা, মুক্তির পর মনিটরিং, শর্ত লঙ্ঘনে গৃহীত ব্যবস্থা ইত্যাদি প্রাসঙ্গিক ও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে ওই আদেশ অনুপস্থিত। নকল ছবির বিষয়টিও উপেক্ষিত। অথচ মুক্তিপ্রাপ্ত একাধিক ভারতীয় ছবি ছিল তামিল-তেলেগু ছবির চর্বিত-চর্বণ। যেমন- ‘খোকাবাবু’ (তেলেগু Dhee), ‘খোকা ৪২০’ (তেলেগু Brindavanam), ‘কেলোর কীর্তি’ (তামিল ‘চার্লি চ্যাপলিন’), ‘অভিমান’ (তেলেগু Attarintiki Daredi) ইত্যাদি। তাছাড়া বছরে সর্বোচ্চ কয়টি ছবি আমদানি করা যাবে, তা নির্ধারণও জরুরি।

সাফটা চুক্তির সঙ্গে সংযোগসূত্র

সার্কভুক্ত দেশগুলোতে মুক্ত বাণিজ্যের মাধ্যমে অর্থনৈতিক উন্নতির মন্ত্রে সাফটা (SAFTA-South Asian Free Trade Area) চুক্তির জন্ম। এ চুক্তির কোথাও সরাসরি ‘ছবি বিনিময়’ সম্পর্কে কোনো কিছু বলা নেই। সাফটা চুক্তির সঙ্গে ছবি বিনিময়ের হয়তো একটা আত্মিক যোগসূত্র আছে, কিন্তু প্রায়োগিক যোগসূত্র যথেষ্ট ক্ষীণ। এবং সেটি কেবল একটা জায়গায়। তাহল, আমদানি আদেশে বলা আছে, কেবল সাফটাভুক্ত দেশগুলোর মধ্যেই ছবি বিনিময় চলবে।

বিতর্কটা যেখানে

এক ভারত ছাড়া অন্য ভাষার ছবি আমদানি নিয়ে খুব একটা বিতর্ক নেই। যত দ্বন্দ্ব কেবল ভারতীয় ছবি আমদানি বা বিনিময়কে ঘিরে। কারণগুলোও সঙ্গত। যেমন- ১. ভারতের মানসম্পন্ন, তারকাবহুল, সুপারহিট ও সদ্য মুক্তিপ্রাপ্ত ছবির বিপরীতে সিংহভাগ ক্ষেত্রে রফতানি করা হচ্ছে বাংলাদেশের পুরনো, দুর্বল ও ফ্লপ ছবি। যেমন- কিছুদিন আগে বাংলাদেশে মুক্তি পেল কলকাতার সুপারস্টার দেবের সদ্য মুক্তি পাওয়া সাড়া জাগানো ছবি ‘চ্যাম্প’। বিপরীতে ভারতে গেল কাজী মারুফ ও মৌসুমী হামিদ অভিনীত নিন্মমানের ফ্লপ ছবি ‘মাস্তানি’। গত বছর কলকাতার সুপারহিট ‘হরিপদ ব্যান্ডওয়ালা’র বিপরীতে ভারতে মুক্তি পায় বাংলাদেশের অখ্যাত, পুরনো ও বিতর্কিত ছবি ‘নগর মাস্তান’। তাতে ভারতে বাংলাদেশের ছবি ও শিল্পীদের সম্পর্কে ভুল বার্তা যাচ্ছে। দেশি ছবির বাজার সম্প্রসারণের পথটা রুদ্ধ হয়ে যাচ্ছে। বিপরীতে বাংলাদেশে ভারতের ছবির বাজার চক্রবৃদ্ধি হারে বাড়ছে।

২. ভারতের ছবিগুলো বাংলাদেশের অসংখ্য হলে প্রদর্শিত হয়। অথচ রফতানিকৃত সিংহভাগ বাংলাদেশি ছবিই ভারতে প্রদর্শিত হচ্ছে না। হলেও সীমিত কয়েকটি সিনেমা হলে। যেমন- ২০১৩ সালে ভারতের ৮টি ছবি আমদানির বিপরীতে, ৮টি বাংলাদেশি ছবি রফতানি হয়। তার মধ্যে কেবল ১টা ছবি ভারতে প্রদর্শন করা হয়।

৩. বাংলাদেশি ছবি প্রদর্শিত হচ্ছে কেবল কলকাতায়, তাও আবার অজপাড়াগাঁয়ের অখ্যাত হলে। অথচ ভারতীয় ছবি বাংলাদেশে প্রদর্শিত হচ্ছে সারা দেশে, রাজধানীসহ সব শহর ও শহরতলীর গুরুত্বপূর্ণ হলে।

৪. একই সময়ে মুক্তিপ্রাপ্ত দেশীয় ছবি ব্যবসা করতে পারছে না। যেমন, ৫ মে মুক্তি পেল দেশের প্রথম সায়েন্স ফিকশন ছবি ‘পরবাসিনী’। একই সময়ে মুক্তি পেল আমদানিকৃত কলকাতার ‘ওয়ান’ ছবি। ‘ওয়ান’ পেল ৮০টি হল, অথচ ‘পরবাসিনী’ পেল ১৪টি হল। সম্প্রতি (২২ সেপ্টেম্বর) মুক্তি পেল দেশ ভাগের ওপর নির্মিত বাংলাদেশি ছবি ‘খাঁচা’। একই দিন মুক্তি পেল আমদানিকৃত ভারতীয় ছবি ‘পোস্ত’। পরদেশি ‘পোস্ত’ পেল ২৫টি হল, আর দেশি ‘খাঁচা’ পেল মাত্র ৫টি হল!

সমাধান সূত্র

* ছবি বিনিময়ে, বিশেষত ভারতীয় ছবি আমদানির ক্ষেত্রে, আমদানি আদেশের অস্পষ্টতা, অসঙ্গতি ও সীমাবদ্ধতা দূর করে পৃথক একটা নীতিমালা ও রূপরেখা প্রণয়ন করা যেতে পারে; যা অসম ছবি বিনিময় এবং মুক্ত বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণে কার্যকর অর্থে বটিকার কাজ করবে। এবং সরকার চাইলে যে কোনো মুহূর্তে প্রজ্ঞাপন বা বিজ্ঞপ্তি দিয়ে কাজটা করতে পারে। এমন সুযোগ বিদ্যমান আমদানি আদেশের ১(৪) অনুচ্ছেদেই রয়েছে।

* মানসম্পন্ন ছবির বিনিময় নিশ্চিতের জন্য তথ্য মন্ত্রণালয় চলচ্চিত্র ব্যক্তিত্বদের নিয়ে একটি কমিটি গঠন করতে পারে, যারা বিনিময়ের জন্য প্রস্তাবিত ছবি দুটি দেখে মতামত দেবেন। তাদের ইতিবাচক মত পেলেই কেবল তথ্য মন্ত্রণালয় নিঃশর্তে বা শর্তসাপেক্ষে ‘নো অবজেকশন’ সার্টিফিকেট দেবে। সেখানে, দু’দেশের প্রতিনিধির সঙ্গে আলোচনা সাপেক্ষে সমানসংখ্যক ও সমগুরুত্বপূর্ণ হলে ছবি প্রদর্শনের শর্ত আরোপ করা যেতে পারে।

* বিনিময়ের পর বিনিময়কৃত ছবির অবস্থা বা বাণিজ্য পরিদর্শনে এবং বিনিময়ের শর্ত বা আমদানি-রফতানির নিয়ম পালনের বিষয়টি পর্যবেক্ষণে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে একটা মনিটরিং সেল গঠন করা যেতে পারে।

* দেশীয় ছবির বাজার সম্প্রসারণে সাফটাভুক্ত দেশের বাইরে বন্ধুত্বপূর্ণ দেশগুলোকেও ছবি বিনিময়ের আওতায় আনা যেতে পারে।

* দেশীয় শিল্প বা চলচ্চিত্রের জন্য সার্বিক অর্থে ক্ষতিকর মনে হলে, যে কোনো সময় প্রজ্ঞাপন বা বিজ্ঞপ্তি দিয়ে বিদেশি ছবি আমদানি বা ছবি বিনিময় নিষিদ্ধ করা যেতে পারে। বিকল্প হিসেবে, যৌথ প্রযোজনার চলচ্চিত্র তো আছেই।

যৌথ প্রযোজনার ছবির চায়ের কাপে ঝড় তোলা বিতর্কে ঢাকা পড়ে গেছে ছবি বিনিময়ের বৃদ্ধ/পুরনো বিতর্ক। সরকার সম্প্রতি যৌথ প্রযোজনার বিদ্যমান নীতিমালা যুগোপযোগী ও পূর্ণাঙ্গ করার উদ্যোগ নিয়েছে। সম্প্রতি তার খসড়াও প্রকাশ করেছে। উদ্যোগটি নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়। ‘যৌথ প্রযোজনা’ ও ছবি আমদানি বা বিনিময়- এ দু’য়ের পথ হয়তো ভিন্ন, কিন্তু গন্তব্য তো এক। তাই প্রশ্ন হচ্ছে, একই উদ্যোগ উপমহাদেশীয় ছবি আমদানি বা ছবি বিনিময়ের ক্ষেত্রে নয় কেন?


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এই ক্যাটাগরির আরো নিউজ