‘রোডের কথা আর জিগায়েন না। মোটে ১২ কিলোমিটার রাস্তা। যাইতে চাইর-পাঁচ ঘণ্টা লাইগ্যা যায়। হাঁইট্যা গেলে গাড়ির আগে যাইবেন গিয়া।’ নিত্যদিনের দুর্ভোগের কথা বলতে গিয়ে এই মন্তব্য করলেন ঢাকা-গাজীপুর পথের ভিআইপি পরিবহনের বাসচালক শফিকুল ইসলাম।
ঢাকা থেকে গাজীপুরে বাসে যেতে সময় লাগে পাঁচ ঘণ্টার ওপরে। নিজের গাড়িতে গেলে কিছুটা সময় বাঁচে বটে, তবু সাড়ে তিন-চার ঘণ্টার কমে যাওয়া যায় না। পথের দূরত্ব মাত্র ৩০ কিলোমিটার। ঢাকা শহরের যানজট পেরিয়ে টঙ্গী সেতুতে পৌঁছাতেই এক থেকে দেড় ঘণ্টা লেগে যায়। তারপর শুরু আসল দুর্ভোগ। টঙ্গী সেতু থেকে জয়দেবপুর চৌরাস্তা পর্যন্ত দুপাশের সড়কের যে হাল, তাতে মনে হয় এর চেয়ে খারাপ সড়ক দেশের আর কোথাও নেই। অথচ এটিই রাজধানীর সঙ্গে উত্তর ও উত্তর-পূর্ব অঞ্চলের যোগাযোগের অন্যতম প্রধান সড়ক। প্রতিদিন লাখ লাখ মানুষ এই পথে যাতায়াত করছে দুর্বিষহ যন্ত্রণা সহ্য করে।
টঙ্গী সেতু থেকে জয়দেবপুর চৌরাস্তা পর্যন্ত দূরত্ব প্রায় ১২ কিলোমিটার। সকাল থেকেই এই সড়কের উভয় পাশ শত শত বাস, ট্রাক, লরি, ব্যক্তিগত গাড়ি, সিএনজিচালিত অটোরিকশা, ব্যাটারিচালিত অটো আর রিকশার জটলায় প্রায় স্থবির হয়ে পড়ে। এই অবস্থা চলতে থাকে রাত প্রায় ১২টা পর্যন্ত। পুরোনো পিচঢালা সড়কের বুকে অসংখ্য ছোট-বড় গর্ত। সেগুলো ভরাট করা হয়েছে ইট-সুরকি ফেলে। বৃষ্টির পানি আর যানবাহনের চাকার চাপে বহু জায়গায় সেই জোড়াতালি উঠে গেছে। দুপাশে দোকানপাট তুলে সড়কের জায়গা দখল করা হয়েছে। এতে অনেক জায়গায় সড়ক সংকীর্ণ হয়ে পড়েছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে নর্দমা উপচে পড়া পচা পানি। আশপাশের কারখানাগুলোর রাসায়নিক বর্জ্য মেশা পচা পানি পুঁতিগন্ধময় ও বিষাক্ত করে তুলেছে পরিবেশ।
এই বিধ্বস্ত সড়ক দিয়ে যানবাহনগুলো ৫-১০ গজ যাচ্ছে আর দু-তিন মিনিট থামছে, আবার একটু এগোচ্ছে—এভাবেই ধুঁকে ধুঁকে পাড়ি দিচ্ছে এই ১২ কিলোমিটার। গত সপ্তাহে তিন দফায় এই সড়কে যাতায়াত করতে গিয়ে ব্যক্তিগত গাড়িতে কখনোই সাড়ে তিন ঘণ্টার কম সময়ে যাওয়া কিংবা আসা যায়নি। সকাল সাড়ে ৮টা থেকে ১০টা এবং বিকেল ৪টা থেকে সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত যানজট থাকে মারাত্মক পর্যায়ে। গাজীপুরে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়, উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, কৃষি-ধান-ইক্ষু গবেষণার জাতীয় পর্যায়ের প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী, শিক্ষক, গবেষক, কর্মকর্তা, কর্মাচারীদের অনেকে যাতায়াত করেন সকালে-বিকেলে। এ ছাড়া টঙ্গী থেকে গাজীপুর পর্যন্ত সড়কের উভয় পাশে গড়ে উঠেছে বহু শিল্পকারখানা। এসব কারখানার শ্রমিক-কর্মচারীদেরও অনেকে এই সড়কের নিয়মিত যাত্রী। আবার গাজীপুর, শফিপুর, মৌচাক, কোনাবাড়ী এলাকার অনেক মানুষ ঢাকায় চাকরি করেন। তাঁরাও নিয়মিত যাত্রী। এতে অফিস শুরু ও ছুটির সময় যানজট বাড়ে। তাই বৃহত্তর ময়মনসিংহ অঞ্চল থেকে রাজধানীতে আসা যাত্রীবাহী বাস ও অন্যান্য যানবাহনকে ঢাকা শহরে প্রবেশের আগে জয়দেবপুর চৌরাস্তায় এসে পড়তে হয় বিরক্তিকর দীর্ঘ যানজটের কবলে। একই অবস্থা ঢাকা ছেড়ে যাওয়া যানবাহনগুলোর ক্ষেত্রেও। সেগুলো আটকা পড়ে টঙ্গী সেতু থেকে। এ ছাড়া চান্দনা চৌরাস্তা হয়ে যেসব দূরপাল্লার যানবাহন বগুড়া, রংপুর, দিনাজপুরে যাতায়াত করে, তার যাত্রীদেরও একই রকম ভোগান্তিতে পড়তে হয়।
এই ১২ কিলোমিটার সড়কের সবচেয়ে খারাপ অবস্থা চেরাগ আলী বাজারের সামনে। এখানে নর্দমা উপচে পানি জমে আছে। কুনিয়া তারগাছ বাজারের সামনে উভয় পাশে প্রায় আধা কিলোমিটারজুড়ে পিচের সড়কের চিহ্নই নেই, ইট বিছিয়ে কোনোমতে সড়ক চালু রাখা হয়েছে। গাড়ি চলছে ধীরগতিতে, হেলেদুলে। গভীর খাদ সৃষ্টি হয়েছে ছয়দানা ও ভোগরা বাসস্ট্যান্ডে। সাইনবোর্ড বাসস্ট্যান্ড ও বোর্ডবাজার বাসস্ট্যান্ডও খানাখন্দে ভরা। পাশাপাশি রয়েছে দোকান ও হকারদের পসরা সাজিয়ে সড়কের দুই পাশ দখল।
বনানীর একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন গাজীপুরের কোনাবাড়ীর আলতাফ হোসেন। তিনি বলেন, সকাল নয়টায় অফিস ধরার জন্য ছয়টায় গাড়িতে ওঠেন। নামেন কাকলী বাসস্ট্যান্ডে। কোনো কোনো দিন তিন ঘণ্টার বেশি সময় লাগে। তাই অফিস পৌঁছাতে দেরি হয়ে যায়। সঙ্গে পথের দুর্ভোগ তো আছেই। এ যেন ১২ কিলোমিটারে ১২ মাস দুঃখ লেগেই থাকে।
যানজট মূলত লাগছে বাসস্ট্যান্ডগুলোর সামনে থেকে। খানাখন্দের কারণে সড়ক সংকীর্ণ হয়ে গেছে। আর সড়কের কিনার দিয়ে জমেছে কাদাপানি। যাত্রী তোলা ও নামানোর জন্য বাসগুলো সড়কের ওপরেই দাঁড়াচ্ছে। এ ছাড়া বিকল্প ব্যবস্থাও নেই। তখন অন্য গাড়ির পাশ কাটিয়ে যাওয়ার মতো জায়গা থাকে না। পেছনের গাড়িগুলো বাধ্য হয়ে থেমে যায়। এ কারণে যানজট সারাক্ষণ লেগেই থাকছে।
গাজীপুর-ঢাকা পথের প্রভাতি বনশ্রী পরিবহনের চালকের সহকারী মোবারক হোসেন এবং গাজীপুর পরিবহনের চালক খায়রুল ইসলাম বলেন, ভাঙা সড়কে চলতে গিয়ে অনেক সময় তো লাগছেই, আর এত ঝাঁকুনি হয় যে যাত্রীরা গালিগালাজ করে। উপরন্তু যানবাহনের যন্ত্রপাতির ক্ষতি হচ্ছে। কিন্তু তাঁদের দুর্ভোগের কথা কেউ ভাবে না।
গাজীপুর বাস-মিনিবাস পরিবহন মালিক সামিতির সভাপতি সুলতান সরকার বললেন, সড়কের বর্তমান যে অবস্থা, তাতে যেকোনো সময় গাড়ি চালানো বন্ধ করে দিতে হতে পারে। লম্বা সময় গাড়ি পথে আটকে থাকায় ট্রিপ কমে গেছে, খরচ বেড়ে গেছে। এতে মালিকদের লোকসান গুনতে হচ্ছে। এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ সড়ক বছরের পর বছর ধরে এমন বেহাল যে এটা ভাবাই যায় না। অথচ বাস্তবে তা-ই হয়েছে।
উন্নয়নের প্রকল্প
টঙ্গী থেকে জয়দেবপুর চৌরাস্তা পর্যন্ত সড়কটির উন্নয়নে ২ হাজার ৪০ কোটি টাকার এক বিশাল প্রকল্পের কাজ শুরু হয়েছে বলে জানালেন সড়ক ও জনপথ (সওজ) বিভাগের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী সানাউল হক। ‘গ্রেটার ঢাকা সাসটেইনেবল আরবান ট্রান্সপোর্ট প্রজেক্টের’ পরিচালকও তিনি। প্রকল্পের ব্যবস্থাপক সওজের নির্বাহী প্রকৌশলী নূর ই আলম ও গাজীপুর সওজের নির্বাহী প্রকৌশলী ডি এ কে এম নাহিন রেজার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, চলতি মাসের প্রথম দিন থেকেই প্রকল্পের কাজ শুরু হয়েছে। প্রথম পর্যায়ে সড়কের উভয় পাশে নর্দমা তৈরির কাজ হচ্ছে।
কর্মকর্তারা জানালেন, পুরো কাজটি হবে চারটি ভাগে। বিমানবন্দর থেকে জয়দেবপুর চৌরাস্তা পর্যন্ত সাড়ে ২০ কিলোমিটার সড়কটি হবে আট লেনের। মাঝের দুই লেনে প্রকল্পের নিজস্ব বাস চলবে। এর উভয় পাশের চার লেনে চলবে অন্য সব গাড়ি। আর প্রান্তবর্তী দুই পাশে দুই লেনে চলবে অযান্ত্রিক যানবাহন। এ ছাড়া থাকবে ফুটপাত ও নিচ দিয়ে নর্দমা। টঙ্গী সেতু থেকে চেরাগ আলী পর্যন্ত সাড়ে চার কিলোমিটারের একটি ফ্লাইওভার নির্মাণ করবে বঙ্গবন্ধু সেতু কর্তৃপক্ষ। বাকি ১৬ কিলোমিটার সড়ক ও ছয়টি ফ্লাইওভার নির্মাণ করবে সওজ। এলজিইডি দুই পর্যায়ে সড়কের পার্শ্ববর্তী সংযোগ সড়ক এবং গাজীপুরে প্রকল্পটির নিজস্ব বড় বাস ডিপো নির্মাণ করবে। আগামী ২০২০ সালের শুরুতে প্রকল্পের কাজ শেষ হবে বলে প্রকল্প পরিচালক আশা করছেন।
তবে নির্ধারিত সময়ে কোনো প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার নজির এ দেশে বিরল। সেই নজির যদি এ ক্ষেত্রে সৃষ্টি হয়ও, তবু অন্তত আরও দুই বছর যে জনসাধারণকে এই পথের দুর্ভোগ পোহাতে হবেই, তা একরকম নিশ্চিত।