দশম সংসদ নির্বাচন বর্জনকারী বিএনপি আগামী একাদশ সংসদ নির্বাচনে অংশ নেবে- এমনটাই ধরে নিয়ে নির্বাচনী ছক আঁকছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। সেক্ষেত্রে দলটির এখন পর্যন্ত চিন্তা-ভাবনা হচ্ছে তাদের আদর্শিক জোট ১৪ দলকে সঙ্গে নিয়েই জোটগত নির্বাচন করা। শেষ পর্যন্ত এই চিন্তা-ভাবনাই বহাল থাকবে, না-কি তাতে কোনো পরিবর্তন আনা হবে, নির্বাচনের সময়কার সার্বিক পরিস্থিতির আলোকে এ ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবেন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তবে দলটির দায়িত্বশীল নেতারা জানালেন, আগামী নির্বাচনে বিএনপি আসুক বা না আসুক এইচএম এরশাদের জাতীয় পার্টিকে (জাপা) নিয়ে জোট বাঁধার কোনো পরিকল্পনা আওয়ামী লীগের নেই।
এই প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য, স্বাস্থ্যমন্ত্রী ও ১৪ দলের মুখপাত্র মোহাম্ম নাসিম গতকাল রবিবার ইত্তেফাকের সঙ্গে আলাপকালে বলেন, ‘আমাদের বিশ্বাস-বিএনপি নির্বাচনে আসবেই, নির্বাচনে না আসার কোনো বিকল্প নেই বিএনপির সামনে নেই। এরপরেও বিএনপি আসুক বা না আসুক এরশাদ সাহেব আলাদাই নির্বাচন করবেন। এরশাদ সাহেবের দলকে (জাপা) নিয়ে জোট গঠনের কথা আওয়ামী লীগ চিন্তা করছে না। তাছাড়া উনি (এরশাদ) নিজেও আগামীতে এককভাবে নির্বাচন করা কথা বলছেন।’
সাংবিধানিক সময়ের হিসাবে একাদশ সংসদ নির্বাচনের এখনও এক বছরেরও বেশি সময় অবশিষ্ট থাকলেও এনিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গণসহ বিভিন্ন মহলে আলোচনা শুরু হয়ে গেছে বহু আগে থেকেই। নির্বাচন কার অধীনে, কখন, কীভাবে হবে- তা নিয়েও প্রধান দলগুলোর মধ্যে বাহাসের শেষ নেই। এমনকি একক না জোটগত নির্বাচন, এনিয়েও দল-জোটের অভ্যন্তরে নড়াচড়া শুরু হয়েছে। বিএনপি নির্বাচনে অংশ নিলে জোটগতভাবেই নেবে, এমনটিই দলটির সিদ্ধান্ত। বর্তমান সংসদের প্রধান বিরোধী দল জাপা চেয়ারম্যান এইচএম এরশাদ বলেছেন, জাপা আগামী নির্বাচনে নিজেদের জোট- সম্মিলিত জাতীয় জোট (ইউএনএ) নিয়ে পৃথকভাবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবে। বিকল্পধারা সভাপতি অধ্যাপক একিউএম বদরুদ্দোজা চৌধুরী, গণফোরাম সভাপতি ড. কামাল হোসেন, জেএসডি সভাপতি আ.স.ম আবদুর রব, কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ সভাপতি বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী ও নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্নাসহ সমমনা কয়েকজন পৃথক একটি বলয় গড়ার লক্ষ্যে তত্পরতা শুরু করেছে। সিপিবি-বাসদ (খালেকুজ্জামান) ইতোমধ্যে আলাদা মঞ্চ গড়েছে। এর বাইরেও আরও কিছু রাজনৈতিক দল সমমনাদের নিয়ে পৃথক পৃথক মোর্চা বা জোট করছে। একাদশ সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে বিএনপি, এরশাদের জাপা এবং অন্যান্য দলগুলোর প্রায় সবাই যখন জোটবদ্ধ আছে, জোট গড়ছে বা জোটের পরিধি বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছে তখন আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪ দলের শরিকদের মধ্যেও এনিয়ে ভেতরে-ভেতরে কথা চালাচালি হচ্ছে। ১৪ দলের শরিকদের কেউ কেউ নিজেদের মধ্যেই বলাবলি করছেন আওয়ামী লীগ তাহলে কী করবে? একক না জোটগতভাবে নির্বাচনে লড়বে আওয়ামী লীগ? একাদশ নির্বাচনকে নিয়ে আওয়ামী লীগের চিন্তা-ভাবনা বোঝার চেষ্টা করছেন মিত্ররা।
এ ব্যাপারে আওয়ামী লীগের দায়িত্বশীল কয়েক নেতা জানান, নির্বাচনে বিএনপির আসা না আসার সিদ্ধান্তের উপরও অনেকটা নির্ভর করবে আওয়ামী লীগের চূড়ান্ত কৌশল। বিএনপি নির্বাচনে এলে এক ধরনের কৌশল, না এলে ভিন্ন চিন্তা-ভাবনাও হতে পারে। বিএনপি শেষ পর্যন্ত জোটগতভাবে নির্বাচনে প্রতিযোগী হলে আওয়ামী লীগও নিজেদের বিদ্যমান জোট নিয়েই লড়বে। বিএনপি ভোটের মাঠে খেলতে এলে ১৪ দল ঠিক রেখে জোটের পরিধি বৃদ্ধি করে বন্ধুবলয় বাড়ানোর পরিকল্পনাও রয়েছে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বের।
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের এ বিষয়ে সম্প্রতি এই প্রতিবেদকের সঙ্গে আলাপকালে বলেন, ‘আমাদের তো জোট আছে। আমরা তো জোট থেকে সরিনি। সারাবছর জোট করব, আর নির্বাচনের সময় করব না, একসঙ্গে নির্বাচন করব না-এমন সুবিধাবাদী দল তো আওয়ামী লীগ নয়। তারপরেও নির্বাচন এলে আবার কথা হবে, ১৪ দলের শরিকদের সঙ্গেও আলোচনা হবে, নতুন বন্ধুদের সঙ্গেও কথা হতে পারে। জোটের কি রূপ দাঁড়াবে-সেটি আগামী বছরের শুরুরদিকে হয়তো পরিস্কার হবে।’
আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ও কৃষিমন্ত্রী বেগম মতিয়া চৌধুরী কিছুদিন আগে ইত্তেফাককে বলেছেন, ‘আমার তো মনে হয়-বিএনপিকে নির্বাচনে আসতে হবে। বিএনপি নির্বাচনে আসলে ভালো কথা। আমরা তো জোট ভেঙ্গে দিইনি, বরং যথেষ্ট কেয়ার (যত্ন) নিয়ে আমরা একে অপরের হাত ধরে কাজ করে যাচ্ছি। তাছাড়া যারা স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি তাদের জন্য আওয়ামী লীগের জোটের দরজা খোলা, তাদের সঙ্গে সমঝোতা হতে পারে।’ তিনি আরও বলেন, ‘মূল আদর্শিক জায়গা তো হলো দেশের স্বাধীনতা প্রশ্নে। মূল জায়গাটিকে ঠিক রেখে বহু মত-পথের সমন্বয় ঘটাতে আওয়ামী লীগ সবসময়ই চেষ্টা করে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও বহুমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। আওয়ামী লীগের বাইরেও যারা বাংলাদেশের পক্ষে ভালো চিন্তা-ভাবনা করেন, তাদের সবাইকে নিয়েই তিনি (প্রধানমন্ত্রী) চলতে চান।’
১৪ দলের মুখপাত্র ও স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম ইত্তেফাকের সঙ্গে গতকাল আলাপকালে বলেন, ‘আমাদের এখন পর্যন্ত চিন্তা-ভাবনা হচ্ছে ১৪ দলের সঙ্গে জোটবদ্ধ নির্বাচন করা। ১৪ দল একটি আদর্শিক জোট। নির্বাচনের সময় হয়তো মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের ও সমমনা আরও কয়েকটি দলের সঙ্গে নির্বাচনি জোট গঠন করতে পারে আওয়ামী লীগ। অবশ্য যখন নির্বাচন আসবে তখনকার পরিবেশ-পরিস্থিতির আলোকে এ ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত দেবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।’
১৪ দলের অন্যতম শরিক ওয়ার্কার্স পার্টি সভাপতি, বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রী রাশেদ খান মেনন ইত্তেফাককে বলেন, ‘আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে আমাদেরকে জানানো হয়েছে-জোটের পরিধি কিছুটা বাড়তে পারে। আমরা তো জোটবদ্ধ নির্বাচনের পক্ষে, বাকিটা নির্ভর করবে আওয়ামী লীগের সিদ্ধান্তের উপর।’ ১৪ দলের আরেক শরিক জাতীয় পার্টি-জেপি’র সাধারণ সম্পাদক শেখ শহীদুল ইসলাম গতকাল ইত্তেফাককে বলেন, ‘বিষয়গুলো নিয়ে নিশ্চয়ই আওয়ামী লীগসহ ১৪ দলের মধ্যে আলোচনা হবে।’ একই বিষয়ে ১৪ দলের আরেক শরিক জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জাসদ (ইনু) সাধারণ সম্পাদক শিরীন আখতার জানান, জঙ্গি-সন্ত্রাসীদের নির্মূল করতে ১৪ দলকে আরও শক্তিশালী ও কার্যকর করা হবে। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের কিছু দল এখনও ১৪ দলের বাইরে রয়েছে, আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে তাদের সঙ্গে আলোচনা হতে পারে।