আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে ৯ কোটি ভোটারের হাতে উন্নতমানের স্মার্ট জাতীয় পরিচয়পত্র তুলে দেওয়ার কথা থাকলেও এ পর্যন্ত মাত্র ৩২ লাখ ২১ হাজার ৬০৩ জন কার্ড পেয়েছেন। অথচ নির্বাচন কমিশনের হাতে ১ কোটি ৯২ স্মার্ট প্রস্তুত রয়েছে। কিন্তু বিভিন্ন ধরনের সংকটের কারণে ভোটারদের হাতে সেই কার্ড তুলে দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। বিশেষ করে ফিঙ্গার প্রিন্ট ও আইরিশ মেশিন না থাকা, ফ্রান্সের কোম্পানির ব্যর্থতা এবং পর্যাপ্ত জনবল না থাকার কারণে যথা সময়ে কার্ড পাচ্ছেন না ভোটাররা।
এ বিষয়ে জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন অনুবিভাগের (এনআইডি) মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সাইদুল ইসলাম ইত্তেফাককে বলেন, আমরা সাধ্যমতো নাগরিকদের হাতে স্মার্টকার্ড তুলে দেওয়ার সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি। শিগগিরি দুই হাজার ফিঙ্গার প্রিন্ট ও দুই হাজার আইরিশ মেশিন ক্রয়ের প্রক্রিয়া শুরু করা হয়েছে। এছাড়াও জনবল সংকট রয়েছে।
গত বছরের ২ অক্টোবর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা স্মার্টকার্ড বিতরণ কার্যক্রম উদ্বোধন করেন। পরদিন ৩ অক্টোবর থেকে রাজধানী ঢাকা ও বিলুপ্ত ছিটমহলবাসীদের মাঝে কার্ড বিতরণ শুরু হয়। ১১ অক্টোবর পর্যন্ত ঢাকার বিতরণ কার্যক্রম চলে। রাজধানীর বাইরে গত ১৬ মার্চ চট্টগ্রাম ও গত ২ এপ্রিল রাজশাহী মহানগরীতে কার্ড বিতরণ শুরু হয়েছে। এরপর পর্যায়ক্রমে অন্য ৫টি বিভাগীয় শহরে বিতরণ শুরু হয়েছে। তারপর জেলা, উপজেলা/পৌরসভা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে কার্ড বিতরণ হবে। এক বছরের মধ্যে স্মার্টকার্ড বিতরণে তেমন অগ্রগতি নেই বললেই চলে।
ইসি তথ্যমতে, গত ৯ অক্টোবর পর্যন্ত ২৫ লাখ ২৩ হাজার ৩৫ জন, কুড়িগ্রামে ৯২ হাজার ৬৮২ জন, চট্টগ্রামে ২ লাখ ৮৮ হাজার ৩১২ জন, রাজশাহীতে ১ লাখ ৭২ হাজার ৭০৮ জন, বরিশালে ৭৬ হাজার ১৫৬জন, ৬৮ হাজার ৭০৭ জন স্মার্টকার্ড হাতে পেয়েছেন। ৭ কোটি ৩৩ লাখ ব্ল্যাঙ্ক স্মার্টকার্ডের মধ্যে পারসোনালাইজেশন সম্পন্ন হয়েছে ১ কোটি ৯২ লাখ কার্ড।
গত ২৭ আগস্ট থেকে নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় স্মার্টকার্ড উত্পাদন শুরু করেছে ইসি। প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণভান্ডারে স্থাপিত ১০টি (প্রতিটি মেশিনের দাম ১শ কোটি টাকা) মেশিনে কার্ড উত্পাদন করা হচ্ছে। মেশিনগুলো থেকে প্রতিমাসে ৬ লাখ কার্ড উত্পাদন করা হচ্ছে। কিন্তু যত কার্ড উত্পাদন হচ্ছে ততো বিতরণ করা সম্ভব হচ্ছে না। এ কারণে ত্রাণভান্ডারে কার্ডের স্তূপ জমেছে। উত্পাদন কার্যক্রম ত্বরানিত করতে সশস্ত্র বাহিনীর সহায়তা চেয়েছে ইসি। কমিশনের নিজস্ব উদ্যোগে স্মার্টকার্ড উত্পাদন-পার্সোনালাইজেশনের কাজে সহায়তার জন্য অর্ধ শতাধিক কর্মকর্তা চেয়ে সম্প্রতি সশস্ত্র বাহিনী বিভাগের প্রিন্সিপাল স্টাফ অফিসারের কাছে চিঠি পাঠানো হয়।
চলমান আইডেন্টিফিকেশন সিস্টেম ফর ইনহ্যান্স একসেস টু সার্ভিসেস (আইডিইএ) প্রকল্পটির মেয়াদ আগামী ডিসেম্বরে শেষ হচ্ছে। এই প্রকল্পের অধীন ৯ কোটি ভোটারকে স্মার্টকার্ড দেওয়ার জন্য আর্থিক সহযোগিতা করছে বিশ্বব্যাংক। ২০১১ সালের জুলাইয়ে ৯ কোটি ভোটারকে স্মার্ট জাতীয় পরিচয়পত্র দেওয়ার চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। পাঁচবছর ব্যাপী প্রকল্পটির মেয়াদ শেষ হওয়ার কথা ছিল ২০১৬ সালের জুনে। তবে জাতীয় পরিচয়পত্র স্মার্টকার্ড প্রদান ও বিতরণ প্রকল্পের কার্যক্রম ধীরগতি থাকায় মেয়াদ ১৮ মাস বাড়িয়ে ২০১৭ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত করা হয়েছে। এরপরও কাজে গতি ফিরেনি। প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানোর অনুরোধ করা হলেও গত ৬ সেপ্টেম্বর বিশ্বব্যাংক প্রকল্পের মেয়াদ না বাড়ানোর সিদ্ধান্ত কথা জানিয়েছে দিয়েছে নির্বাচন কমিশনকে।
এদিকে, ডিসেম্বরে ৯ কোটি ভোটারের হাতে স্মার্টকার্ড তুলে দেওয়ার চুক্তি স্বাক্ষরিত হলেও বর্তমানে দেশে ভোটার সংখ্যা ১০ কোটি ১৮ লাখ। চলমান হালনাগাদে আরো ৩০ লাখ নতুন ভোটার যুক্ত হবে। সব মিলিয়ে আগামী ৩১ জানুয়ারির পর ভোটার সংখ্যা হবে সাড়ে ১০ কোটির মতো। ফলে ৯ কোটির বাইরে আরো দেড় কোটি ভোটারের হাতেও স্মার্টকার্ড তুলে দিতে হবে কমিশনের। এজন্য আগামীতে সরকারি খরচে নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় দেওয়া হবে স্মার্টকার্ড। এ কারণে গত ১৯ সেপ্টেম্বর ‘ভোটার তালিকা প্রস্তুত এবং জাতীয় পরিচিতি সেবা প্রদানে টেকসই অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্প’ অনুমোদন করেছে কমিশন। প্রকল্প বাস্তবায়নের সময় ধরা হয়েছে ২০১৮ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ২০২২ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত। প্রকল্পের প্রাক্কলিত ব্যয় মোট ১ হাজার ৬১২ কোটি ৪৩ লাখ টাকা।
স্মার্টকার্ডের পরিবর্তে ম্যানুয়াল কার্ড
যে ৩২ লাখ নাগরিক এখন পর্যন্ত স্মার্টকার্ড পেয়েছেন, তাদের কার্ড হারিয়ে গেলে বা কোনো সংশোধনের প্রয়োজন পড়লে তিনি আর স্মার্টকার্ড পাবেন না। বরং সংশ্লিষ্ট নাগরিককে দেওয়া হবে পূর্বের মতো লেমিনেটিং করা ম্যানুয়াল কার্ড। এর কারণ হিসাবে এনআইডি জানিয়েছে, প্রতিটি নাগরিকের জন্য আপাতত একটি স্মার্টকার্ড বরাদ্দ রয়েছে। ফলে এই মুহূর্তে একের অধিক কাউকে কার্ড দেওয়া সম্ভব হবে না। তবে ২০১৮ সালের পর এই সংকট থাকবে না বলে দাবি এনআইডি মহাপরিচালকের।
ধীরগতির জন্য দায়ী ফ্রান্সের কোম্পানি
স্মার্টকার্ড বিতরণের জন্য ফ্রান্সের কোম্পানি অবার্থুর টেকনোলজিসকে দায়ী করছে নির্বাচন কমিশন। কেননা ওই কোম্পানিটি চুক্তি অনুযায়ী যথাসময়ে ব্ল্যাঙ্ক স্মার্টকার্ড সরবরাহ করতে পারেনি। ২০১৫ সালের ১৪ জানুয়ারি স্মার্টকার্ড সরবরাহকারী ফ্রান্সের প্রতিষ্ঠান ওবার্থুর টেকনোলজিসের (ওটি) সঙ্গে ১০২ মিলিয়ন মার্কিন ডলার (৮১৬ কোটি টাকার) চুক্তি করে ইসি। চুক্তি অনুযায়ী ২০১৬ সালের ৩০ জুনের মধ্যে ৯ কোটি ভোটারের জন্য স্মার্ট কার্ড উপজেলা পর্যায়ে পৌঁছে দেওয়ার কথা ছিল। নির্ধারিত সময়ে তাতে ব্যর্থ হওয়ার পর ওই চুক্তির মেয়াদ এক বছর বাড়িয়ে ২০১৭ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত করা হয়। কিন্তু জুন পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানটি উল্লেখ করার মতো অগ্রগতি দেখাতে পারেনি। ফলে ওই কোম্পানির চুক্তি বাড়ানোর আবেদন বাতিল করে নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় কার্যক্রম শুরু করে ইসি।