মানুষের স্বভাবজাত বৈশিষ্ট্য হলো নিজেকে অন্যের থেকে শ্রেষ্ঠ ভাবা। তবে কখনো কখনো এটি বড় বাড়াবাড়ি পর্যায়ে চলে যায়। অনেক সময় অনেক কাছের মানুষের সঙ্গেও দূরত্ব সৃষ্টি হয়।
আর কিছু মানুষ আচরণে ঔদ্ধত্যপূর্ণ হন, তাদের অনেকের মুখের ভাষা খুবই কর্কশ। আর অহংকারে সব সময় নিজেকে মুইকি হনুরে ভাবতে থাকে। মিথ্যে আস্ফাালন ও নিজেকে প্রকাশ করার অযাচিত বাহাদুরি দেখায়। তাদের কারো কারো মধ্যে আবার মানববিদ্বেষও দেখা যায়। সঙ্গে দম্ভও। অনেক উচ্চ শিক্ষিত মানুষকে অনেক সময় এরূপটি করতে দেখা যায়। যা একেবারে অনুচিত। সত্য কথা বলতে কি বিশাল এই পৃথিবীতে মানুষের দম্ভ বা অহংকার করার কিছুই নেই।
আমরা যদি আমাদের মাথার উপরে অবস্থিত ছাদের ন্যায় বিশাল ঐ আকাশের দিকে তাকাই তাহলে কি শিক্ষা পাই? অবশ্যই বিনয়ের শিক্ষা পাই। তাই কবি সুনির্মল বসু বলেছেন, “আকাশ আমায় শিক্ষা দেয় উদার হতে ভাইরে/কর্মী হবার মন্ত্র আমি বায়ুর কাছে পাইরে” আর যদি ফলবান বৃক্ষের দিকে তাকাই তবুও আমরা বিনয়ের শিক্ষা পাই। যে বৃক্ষ অঙ্কুরোদগমের পর থেকে শত প্রতিকূলতা পেরিয়ে বেড়ে ওঠে মানুষের কল্যাণে নিজেকে অকাতরে বিলিয়ে দেয়। আর ফলসহ বিনয়ের সঙ্গে নিজেকে নুইয়ে দেয়। আর এসব মনুষ্যবিদ্বেষ এবং সবকিছুকে ঘৃণা করার প্রবণতার সবচেয়ে ক্ষতিকর প্রভাব হলো যারা এরূপ করে থাকেন তারা দিন দিন বন্ধু হারাতে থাকেন। আর তাদের কাছ থেকে অন্য মানুষরাও দিন দিন দূরে সরে যান।
এই পৃথিবীতে কেউই একলা চলতে পারে না। মানুষের জীবন চলার জন্য সঙ্গী তথা বন্ধুর প্রয়োজন আছে। ডেল কার্নেগি তার “বন্ধুও প্রতিপত্তিলাভ” বইয়ে বলেছেন, জীবনে বন্ধু বানান না হয় একলা চলতে হবে।
কারো বন্ধু হতে হলে বা কাউকে আপন করে পেতে হলে তার মন জয় করতে হয়। আর মানুষের মন জয় করা যায় ভালোবাসা এবং বিনয়ের মাধ্যমে। কবি বলেছেন—
“বড় যদি হতে চাও/ছোট হও তবে”। এখানে ছোট হওয়া বলতে কবি বিনয়ী হওয়া বুঝিয়েছেন। পৃথিবীতে যে সব মনীষী মানুষের মন জয় করে তাদের শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা কুড়িয়েছেন তারা তাদের চরিত্র তথা আচার-ব্যবহারে এবং কথাবার্তায় বিনয়ী হওয়ার মাধ্যমেই তা পেরেছিলেন। যার ফলে তারা মানুষের মন জয় করে ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে আছে যেমন: ভারতের জাতির জনক ও অহিংসবাদী নেতা মহাত্মা গান্ধী। যিনি হিন্দু নিম্নবর্ণের হরিজন সম্প্রদায়ের অধিকার আদায়েও আন্দোলন করেছিলেন। যদিও তিনি হরিজন সম্প্রদায়ের ছিলেন না। তিনি যদি ভারতের মানুষদের ভালোবেসে তাদের আপন করে না নিতেন তাহলে কে বা কারা তার কথা শুনতো? এবং তার একটি আঙুলের ইশারায় লক্ষ লক্ষ জনতা রাস্তায় নেমে পড়তো, তাদের জীবনকে বাজি রেখে।
এছাড়া সব শ্রেণির মানুষকে যারা আপন করে নিয়েছেন তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন পন্ডিত ও সমাজ সংস্কারক ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগর। তার সময়ে ভারতে নিম্ন জাতের হিন্দুদেরকে উচ্চজাতের ব্রাহ্মণরা স্পর্শ করতো না। কিন্তু বিদ্যাসাগর সর্বপ্রথম নিম্নবর্ণের এক হিন্দু কিশোরীর মাথায় নিজ হাতে তেল দিয়ে এ জাতভেদের প্রথা ভাঙেন।
এছাড়া ম্যাসিডোনীয় কন্যা মহিয়সী নারী ‘মাদার তেরেসা’র কথা আমরা সকলেই জানি। যিনি তার সারাজীবন উত্সর্গ করেছিলেন কলকাতার দুস্থ, ছিন্নমূল মানুষের সেবা করে, যারা ফুটপাতে, ওভারব্রিজের ওপরে না খেয়ে পড়ে থাকত। যাদের পরণে পোশাক ছিল না, থাকার জায়গা ছিল না তাদের এ করুণ অবস্থা অবলোকন করে ধর্মপ্রচার করতে আসা মাদার তেরেসার মাতৃহূদয় কেঁদে ওঠে। তিনি এসব লোকেদের মৌলিক চাহিদা পূরণের লক্ষ্যে Missionary of Charity নামক দাতব্য সংস্থা প্রতিষ্ঠা করেন। আর তিনি তার কাজের স্বীকৃতি স্বরূপ ১৯৫০ সালে শান্তিতে নোবেল পেয়েছেন। আর তার যে কর্ম নোবেল পুরস্কারকেও ছাড়িয়ে গেছে তা হলো মানুষের প্রতি তার ভালোবাসা। তিনি বিশ্ববাসীকে দেখিয়ে গেছেন কিভাবে মানুষকে ভালোবেসে আপন করে বুকে টেনে নিতে হয়।
ইতিহাসে আরেক মহিয়সী নারীর নাম প্রিন্সেস ডায়ানা। তিনি রাজবধূ ছিলেন বলেই আজ ইতিহাসে স্মরণীয় নন। এর পূর্বে ইংল্যান্ডের রাজবংশের ইতিহাসে অনেক রাজবধূই গত হয়েছেন। যারা ইতিহাসের ধারাবাহিকতা হিসেবে শুধু রয়ে গেছেন। কিন্তু ডায়ানাকে কেন মানুষ বিশেষভাবে মনে রেখেছে? কারণ, তিনিই প্রথম ইংল্যান্ডের রাজবংশের প্রথা ভেঙে সমাজের নিম্নশ্রেণির মানুষদের সঙ্গে মিশেছেন এবং সমাজের অবহেলিত ও নিপীড়িত মানুষের পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন। তাদেরকে আপন করে নিয়েছেন এবং তাদের কল্যাণার্থে কাজ করে গেছেন।
আর যারা এর উল্টোটা করেছেন, মানে অহংকার করেছেন তাদের পতনও ঘটেছে। প্রবাদে আছে “অহংকারই পতনের মূল”। যেমন পবিত্র কুরআনে বর্ণিত আছে সকল ফেরেশতাদের সর্দার হয়ে আজাযিল ফেরেশতা অংহকারবশত নিজেকে শ্রেষ্ঠ ভাবায় আল্লাহ তাকে শয়তানে রূপান্তর করে দিলেন। এ ঘটনা থেকে মানুষজনের শিক্ষা নেওয়া উচিত।
সুতরাং অহংকারী নয়, বিনয়ী হোন, কেননা বিনয়ী হয়ে মানুষকে আপন করে নিতে পারাটাও একটা আর্ট। যা সবাই পারে না। আর একটা কথা কেবল ভালোবাসা দিয়েই মানুষের মন জয় করা যায়। ঘৃণা বা অবহেলা দিয়ে নয়। তাই ভালোবাসা আর বিনয় অর্থাত্ চরিত্র দিয়ে এ বিশ্বকে জয় করুন।