লেখক: শাহীনুর রেজা
কারার ঐ লৌহ কপাট
ভেঙ্গে ফেল্ র্ক রে লোপাট রক্ত-জমাট
শিকল-পূজার পাষাণ-বেদী!
উদ্দীপনামূলক এই গানটি বাঙালি কবি, বাংলা ভাষার কবি, বাংলাদেশের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম রচিত ও সুরারোপিত। ১৯২২ সালে ‘বাঙলার কথা’ নামে একটি সাপ্তাহিক পত্রিকায় গানটির বাণী মুদ্রিত হয়। পত্রিকাটির সম্পাদক ছিলেন দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ ও সহকারী সম্পাদক হেমন্ত কুমার সরকার। ১৯২১ সালের ১০ ডিসেম্বর চিত্তরঞ্জনকে গ্রেফতার করে জেলে পাঠিয়ে দেওয়া হলে তাঁর স্ত্রী বাসন্তী দেবী পত্রিকা সম্পাদনার ভার নেন। তিনি এই সময়ে ‘বাঙলার কথা’য় ছাপাবার জন্য কাজী নজরুল ইসলামকে একটি কবিতা দিতে অনুরোধ করতে দাশ পরিবারের সুকুমার রঞ্জন দাশকে পাঠান।
স্মৃতিকথায় মুজফ্ফর আহমদ জানিয়েছেন যে, সুকুমার রঞ্জন দাশ নজরুলের সঙ্গে কোথায় দেখা করেছিলেন তালতলা না কলেজ স্ট্রিটে সেটা আর তাঁর মনে নেই। তবে সে সময় তিনি উপস্থিত ছিলেন। সুকুমার রঞ্জন আর তিনি বসে আস্তে আস্তে গল্প করছেন, আর কাছেই বসে নজরুল অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে কবিতা লিখে চলছেন। কবিতার শিরোনাম হলো ‘ভাঙার গান’। অনেকে মনে করেন ‘ভাঙার গান’ হুগলী জেলে লেখা হয়েছিল এটা ঠিক নয়। তবে জেলখানায় গানটি গাওয়ার সময় বন্দিরা ভিষণ ক্ষেপে গিয়েছিল। কারণ ‘যত সব বন্দিশালায় আগুন জ¦ালা’ বলায় বন্দিরা ভেবেছিল তাদের শালা বলে গালি দেওয়া হয়েছে। অবশ্য ভুল ভাঙতে দেরি হয়নি। গানটি সরকার কর্তৃক নিষিদ্ধ হয়েছিল।
‘ভাঙার গান’ শিরোনামের এ গানটি ২০ জানুযারি ১৯২২ সালে ‘বাঙালার কথা’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। গানটি পরবর্তীতে গিরীন চক্রবর্তীর সুর ও কণ্ঠে দুটি কোম্পানি থেকে রেকর্ড হয়। প্রথমটি জুন ১৯৪৯ সালে কলম্বিয়া থেকে, রেকর্ড নং-জিই৭৫০৬ এবং দ্বিতীয়টি জানুয়ারি ১৯৫০ সালে এইচএমভি থেকে, রেকর্ড নং-এন ৩১১৫২।
এইচএমভি’র রেকর্ডকৃত গানটি ১৯৫০ সালে ‘চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুন্ঠন’ এবং ১৯৬৯-৭০ সালে কালজয়ী চলচ্চিত্রকার জহীর রায়হানের ‘জীবন থেকে নেওয়া’ সিনেমায় ব্যবহৃত হয়। গানটি নজরুলের ‘ভাঙার গান’ কাব্যগ্রন্থে অন্তর্ভূক্ত।
দেখা যাচ্ছে, ‘কারার ঐ লৌহকপাট’ গানটি কবি লিখেছেন ১৯২১ সালের শেষে, পরের বছরের শুরুতেই ১৯২২ সালে তা পত্রিকায় ছাপা হয় কবিতা হিসেবে। এরপর কোন এক সময় নজরুল এতে সুর দেন এবং তাঁর জেল জীবনে (২৩.১১.১৯২২ ১৫.১২.২০২৩) বিভিন্ন কয়েদীদের সাথে কণ্ঠ দেন। কিন্তু এ সুরটির কোন রেকর্ড পাওয়া যায় না। ১৯৪২ সালে অসুস্থ হবার পরে গানটি আরো আড়ালে চলে যায়। নিতাই ঘটকের পরিচালনায় গিরীন চক্রবর্তী পুনরায় গানটিতে সুর দিয়ে দুই কোম্পানি থেকে রেকর্ড প্রকাশ করেন এবং সিনেমায় ব্যবহৃত হয়। গিরীন চক্রবর্তীর সুরটিই বর্তমানে প্রতিষ্ঠিত ও প্রচলিত। আর এই প্রতিষ্ঠিত সুরের বিকৃতিই সারা বিশ^র নজরুল ভক্তদের কষ্ট দিয়েছে।
সম্প্রতি বলিউডের পরিচালক রাজা কৃষ্ণ মেননের ‘পিপ্পা’ সিনেমায় অস্কারজয়ী সুরকার ও সংগীত পরিচালক এ আর রহমান কাজী নজরুল ইসলামের জাগরনীমূলক ‘কারার ঐ লৌহ কপাট’ গানটির সুর বিকৃতি করে উপস্থাপন করেছেন। মূল গানটি ছিল দ্রুত দাদরায় রিদমিক্ আর রহমানকৃত সুরটি বিয়ের গীতের মত।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে আলোচিত ‘গরিবপুর যুদ্ধ’ নিয়ে ‘পিপ্পা’ সিনেমার গল্প। যশোরের কপোতাক্ষের তীরে সেক্টর কমান্ডার জেনারেল মঞ্জুরের অধিনায়কত্বে এই যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এতে ভারতীয় বাহিনীর ক্যাপ্টেন বি.এম.মেহতা উপ-অধিনায়ক ছিলেন। যুদ্ধটি হয়েছিল নভেম্বর ১৯৭১-এ।
ঠিক এ কারনেই ‘কারার ঐ লৌহ কপাট’ গানটি পরিচালক বেছে নিয়েছিলেন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ অবলম্বনে সিনেমা অথচ সে দেশের জাতীয় কবির উদ্দীপনামূলক গান থাকবে না তা কি হয়!
অবাঙালি এ আর রহমান না-হয় নজরুলের গানের প্রতিষ্ঠিত সুরকে গুরুত্ব দেননি, কিন্তু যারা গেয়েছেন তীর্থ চট্টোপাধ্যায়-এর সাথে রাহুল দত্ত, পীযুশ দাশ, শালিনী মুখোপাধ্যায়, দিলাশা চৌধুরী, শ্রয়ী পাল সহ একাধিক শিল্পী বাঙালী হয়ে আরেকজন বাঙালী সংগীতজ্ঞের গান ভিন্ন সুরে গাইলেন কিভাবে!
৭ নভেম্বর এ আর রহমানের নিজস্ব ইউটিউব চ্যানেলে ‘পিপ্পা’র ‘কারার ঐ লৌহ কপাট’ গানটি অবমুক্ত করা হয়। সাথে-সাথে দুই বাংলার নজরুল-জনসহ গোটা বিশে^র নজরুল প্রেমীদের কষ্টের হাহাকার শুরু হয়। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নিজেদের অভিব্যক্তি তুলে ধরে শিল্পী ও গবেষক সমাজ দুই বাংলাতে সোচ্চার হয়ে ওঠেন। সমস্ত দোষ ও দায়ভার পরে এ আর রহমানের উপর। এ আর রহমানের ভক্তরা ব্যথিত হৃদয়ে কমেন্ট করেন। পত্রিকাগুলোতে নেতিবাচক-সমালোচনামূলক নিবন্ধ মুদ্রিত হয়। তাঁর বিচার দাবী করেন সকলে।
এর মধ্যে খবর চাউর হতে থাকে রহমান কবি পরিবারের অনুমতি নিয়েই কাজটি করেন। ২০২১ সালে নজরুলের ছোট ছেলে কাজী অনিরুদ্ধের ছেলে কাজী অনির্বাণ ও তার মা কল্যাণী কাজী ‘পিপ্পা’ সিনেমা কর্তৃপক্ষের সাথে গানটি নিয়ে বড় অংকের টাকার মাধ্যমে লিখিত চুক্তিবদ্ধ হন। চলচ্চিত্রের ক্রেডিট লাইনে ‘বিশেষ ধন্যবাদ’ হিসেবে কবি পরিবারের নামও থাকবে। চুক্তিনামায় প্রথম সাক্ষী ছিলেন অনির্বাণ কাজী। এ ঘটনা কবি পরিবারের অন্য সদস্যবৃন্দ, বিশেষ করে বাংলাদেশে বসবাসকৃত সদস্যদের জানানো হয়নি।
চতুরপাশের তোরজোরে এ খবরের সত্যতা পাওয়া যায়। কাজী অনির্বাণ স্বীকার করেন মা গানটা ব্যবহারের অনুমতি দিয়েছিলেন সুর এবং কথা না বদলে রিক্রিয়েট করার জন্য। কিন্তু সেই সময় ওদের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, গানটা ওরা নিজেদের মত করে ব্যবহার করতে চায়। মা ওদের বলেছিল, গানটা তৈরী হয়ে গেলে একবার শোনাতে। কিন্তু ওরা কিছুই শোনাননি।
১০ নভেম্বর ছায়ানট (কলকাতা)-র সভাপতি হিসেবে সোমঋৃতা মল্লিক কাজী অনির্বাণকে কলকাতা প্রেসক্লাবে সাংবাদিক সম্মেলনের মাধ্যমে পুরো বিষয়টা নজরুল অনুরাগীদের সামনে তুলে ধরার জন্য আমন্ত্রণ জানালে তিনি আসতে চাননি। কালী পূজা, ভাই ফোঁটার ব্যস্ততা দেখিয়ে তিনি আসতে পারবেন না বলে জানিয়েছেন। চুক্তিপত্রের কপিটি সমঋৃতা মেইলে পাঠাতে অনুরোধ করলেও কোন উত্তর আসেনি। ডালমে কুস্ কালা হ্যায়।
বিশিষ্ট গীতিকার, সুরকার, সংগীত পরিচালক মিল্টন খন্দকার ১৩ নভেম্বর তাঁর ফেসবুকে একটি গুরুত্বপূর্ণ কথা লেখেন এ আর রহমানকে দোষ দেবার আগে খুঁজে বের করা উচিত কারা তাঁকে এ গানটি ‘পিপ্পা’ সিনেমায় ব্যবহারের অনুমতি দিয়েছিলেন।
এখন কী মনে হয়, ‘কারার ঐ লৌহ কপাট’ গানটির সুর বিকৃতির জন্য ‘পিপ্পা’ পরিবারের এ আর রহমান দায়ি? না কবি পরিবারের কাজী অনির্বাণ দায়ি?
লেখক : সাহিত্য ও সংগীত ব্যক্তিত্ব
ভারপাপ্ত সম্পাদক দৈনিক সংবাদ সংযোগ পত্রিকা
shahinurmusic70@gmail.com