• শুক্রবার, ২২ নভেম্বর ২০২৪, ০১:৪৮ পূর্বাহ্ন

পড়োবাড়ি সদৃশ্য পৃথিবীতে ভূত হয়ে মানুষ ঘুরে বেড়ায়

আপডেটঃ : সোমবার, ১৬ অক্টোবর, ২০১৭

নোবেল পুরস্কার পাওয়ার আগে কাজুও ইশিগুরো দুটো কারণে খ্যাতিমান ছিলেন। প্রথমত, তার ‘দ্য রিমেইন্স অব দ্য ডে’ উপন্যাসটি বুকার পুরস্কার পেয়েছিল। ওই উপন্যাস নিয়ে যে চলচ্চিত্রটি নির্মিত হয় সেটিও জনপ্রিয়তা পায়। বুকার, ইংল্যান্ডের একটা গৌরবজনক সাহিত্য পুরস্কার। ইশিগুরোর উপন্যাস সাধারণভাবে বললে, সুনিয়ন্ত্রিত, সূক্ষ্ম, পরিশীলিত উঁচু মানের উপন্যাস। তার উপন্যাসের প্রধান চরিত্রগুলো কিংবা নায়কেরা প্রায়ই যে জীবন যাপন করছে বা বেছে নিয়েছে, তার জন্য আত্মসংকটে ভোগে। তারা এমন এক আবেগিক অভিযানে লিপ্ত থাকে, যে অভিযানের লক্ষ্য হচ্ছে সত্যকে খুঁজে পাওয়া আর জীবনের অর্থকে বুঝতে পারা। কিন্তু পরিশেষে দেখা যায় তাদের মোহভঙ্গ হচ্ছে, তীব্র বেদনাবোধ, হতাশ্বাস আর যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে জীবনকে নিরর্থক ভাবছে।

আত্মজৈবনিক ঐতিহাসিক পটভূমি : ১৯৫৪ সালের ৮ নভেম্বর জাপানের নাগাসাকি শহরে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। এর ঠিক এক দশক আগে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ১৯৪৫ সালে যে দুটি শহরে মার্কিনীরা বোমা ফেলে, নাগাসাকি তার একটি। এর প্রতিক্রিয়ায় তিনি লিখেছেন ‘অ্যান আর্টিস্ট অব দ্য ফ্লোটিং ওয়ার্ল্ড’ উপন্যাসটি। ইশিগুরো তার বাবা-মায়ের সঙ্গে এরপর ১৯৬০ সালে ইংল্যান্ডের সারের গিলফোর্ডে চলে আসেন। তার বাবা ছিলেন একজন সমুদ্রবিদ, অস্থায়ীভাবে ব্রিটিশ সরকারের হয়ে কাজ করতেন। ইংল্যান্ডে পুরোপুরি স্থায়ী হওয়ার আগ পর্যন্ত তার এই চাকরি বারবার নবায়িত করে নিয়ে ইংল্যান্ডে থেকে গেছেন।

ইশিগুরো পড়াশোনা করেছেন কেন্ট বিশ্ববিদ্যালয়ে আর তার বিষয় ছিল মার্কিন সাহিত্য। এরপর কিছুদিন সোসাল ওয়ার্কার হিসেবে কাজ করলেও ইস্ট অ্যাংলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্রিয়েটিভ রাইটিং বা সৃজনশীল সাহিত্য নিয়ে পড়াশোনা করার পর সৃজনশীল সাহিত্য রচনাতেই মনোনিবেশ করেন। লিখতে শুরু করেন উপন্যাস।

অপসৃয়মান স্মৃতি : ইশিগুরোই বলেছেন, প্রথম দিকে তার আগ্রহ ছিল ক্ষীণ হয়ে আসা জাপানি স্মৃতিকে উপন্যাসের বিষয়বস্তু করে তোলা। প্রথম দুটি উপন্যাস : ‘আ পেল ভিউ অব দি হিল্স’ আর ‘অ্যান আর্টিস্ট অব দ্য ফ্লোটিং ওয়ার্ল্ড’ প্রকাশিত হয় সালমান রুশদির ‘মিডনাইট’স চিলড্রেন’ উপন্যাসটি বুকার পুরস্কার (১৯৮১) পাওয়ার এক বছর পর। এর এক দশক পরে ১৯৯১ সালে ‘মিসিসিপি রিভিউয়ে’র সঙ্গে একটি সাক্ষাৎকারে সেই স্মৃতিচারণ করে বলেছেন, ‘রুশদি বুকার পাওয়ার পর অনেকে ব্রিটেনে আর কোনো রুশদি আছেন কিনা তার খোঁজ করছিল।’ এই কথাটা যে তিনি নিজেকে ইঙ্গিত করে বলেছিলেন তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

আন্তর্জাতিক খ্যাতি : এরই সূত্র ধরে লক্ষ করলে দেখা যাবে, ইশিগুরো আন্তর্জাতিক খ্যাতি অর্জন করেছেন। সেই খ্যাতি আসে একেবারেই সুনিশ্চিত একটা ব্রিটিশ চরিত্রকে নিয়ে লেখা উপন্যাসকে কেন্দ্র করে। উপন্যাসটির নাম ‘দ্য রিমেইন্স অব দ্য ডে’। চরিত্রটি একজন খানসামার চরিত্র, যিনি সারাজীবন তার প্রভুর প্রতি অনুগত ছিলেন। উপন্যাসটিতে যে ফরম বা আঙ্গিক তিনি গ্রহণ করেছেন সেটি দিনলিপি বা ডায়রির। ওই একই নামে ১৯৯৩ সালে একটি চলচ্চিত্র নির্মিত হয়, যার সূত্র ধরে তিনি জনপ্রিয় লেখক হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেন। এরপর তার সাফল্য আসে ‘হোয়েন উই ওয়্যার অরফ্যান্স’ উপন্যাসটি বুকার পুরস্কারের শর্টলিস্টে অন্তর্ভুক্ত হলে। ‘নেভার লেট মি গো’ (২০০৫) উপন্যাসটিতে তিনি এমন এক ভঙ্গুর ক্ষয়ে যাওয়া জায়গাকে পটভূমি হিসেবে গ্রহণ করেছেন, সঙ্গে মিশিয়ে দিয়েছেন কল্পবিজ্ঞানের নানা অনুষঙ্গ, ফলে এটি একটি উল্লেখযোগ্য উপন্যাস হিসেবে আলোচনার বিষয় হয়ে ওঠে।

অনিশ্চিত অবিশ্বস্ত ন্যারেটিভ : ইশিগুরো একটা জিনিস বেশ পছন্দ করেন। ন্যারেটিভকে অনিশ্চিত আর অবিশ্বস্ত করে তোলার প্রতি তার ঝোঁক প্রবল। সাধারণত যে প্রচলিত রীতিতে ঔপন্যাসিকেরা সরলভাবে গল্পের বর্ণনা দেন, যেখানে গল্পের একটা পরম্পরা থাকে, লজিক ধরে এগোয়, ইশিগুরো গল্পকে সেভাবে এগিয়ে নেন না। জোসেফ কনরাড বা ফোর্ড ম্যাডক্স ফোর্ড এমন গল্প বলেন যা পাঠকের কাছে বিশ্বস্ত মনে হয়। কিন্তু ইশিগুরোর আখ্যানগুলো এরকম বিশ্বাসযোগ্য নয়। ‘আ পেল ভিউ অব হিল্স’-এর কথাই ধরা যাক। এই উপন্যাসে ইশিগুরোর উত্তম পুরুষের গল্পকথক বা বর্ণনাকারী শুধু তার নিজের উদ্দেশ্যকেই অতিরঞ্জিত করে তুলে ধরেনি, তার কাজগুলোও অতিরঞ্জিত, এমনকি অন্য চরিত্রগুলোকেও তিনি এভাবেই গড়ে তুলেছেন।

ইশিগুরো শেষের দিকে যে উপন্যাসগুলো লিখেছেন, সেখানে তার চ্যালেঞ্জটা ছিল এরকম যে, পাঠককে বিস্ময় আর ঘোরের মধ্যে নিয়ে আসা। বিভিন্ন টুকরো টুকরো ঘটনা এবং চরিত্রের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়াকে এমনভাবে উল্টা-পাল্টা করে ব্যবহার করেছেন যে তৈরি হয়েছে এই ধরনের অবিশ্বস্ততা, অনিশ্চয়তা। তার কৃতিত্ব হচ্ছে সরল নয়, বর্ণনার দিক থেকে উপন্যাসগুলোকে করে তুলেছেন বহুস্তরি, বহুমাত্রিক। একই উপন্যাসে বর্ণনার বহু স্তর, ফলে পাঠক যেমন বিস্মিত হবে, তেমনি বিমুগ্ধ। ‘অ্যান আর্টিস্ট অব দ্য ফ্লোটিং ওয়ার্ল্ড’-এ যুদ্ধ-পূর্বকালে মূল চরিত্রটি যে ভুল করে তার সূত্র ধরে স্মৃতিচারণাকে বর্ণনার ভঙ্গি হিসেবে গ্রহণ করেছেন। কিন্তু পরে দেখা গেল এরকম কিছু বাস্তবে ঘটেইনি। ‘দ্য রিমেইন্স অব দ্য ডে’তে উপন্যাসের ঘটনা বর্ণনা করছে, যে চরিত্রটি তিনি দুটি সমান্তরাল স্মৃতির সঙ্গে যুক্ত করে উপন্যাসের বর্ণনাকে দুটি স্তরে এগিয়ে নিয়েছেন। এই যে দ্বিবিধ স্তর, এর একটিতে দেখা যাবে চরিত্রটি একটা রোমান্টিক সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েছিল, আরেকটিতে সে রাজনৈতিক ঘটনার সঙ্গে যুক্ত। এই দুই স্মৃতি দুই ধরনের বর্ণনার স্তর তৈরি করে উপন্যাসটির চৌদ্দ বছরের সময়সীমাকে এগিয়ে নিয়েছে। ‘দ্য আনকনসোল্ড’ উপন্যাসে তিনি মানুষের শারীরিক স্বাভাবিকত্বকেই অগ্রাহ্য করে বর্ণনার এই অবিশ্বস্ততাকে আরও তীক্ষè করে তুলেছেন। চরিত্রগুলো যখন অতীতে থেকেছে তখন এক ধরনের বর্ণনা পাওয়া যায়, আবার যখন বর্তমানে আসছে তখন বর্ণনা যাচ্ছে বদলে। ব্যাপারটা এমন যে, বাইরের পৃথিবীই বদলে দিয়েছে বর্ণনা ও কাহিনী। এই যে মনোজাগতিক চরিত্র নির্মাণ, সেই নির্মাণের রয়েছে বহুস্তর, পাঠকের কাছে যা অভিনব কিন্তু আকর্ষক বলে মনে হবে।

সমালোচকদের চোখে : লেখালেখির প্রায় শুরুতেই ইশিগুরো খ্যাতিমান হয়ে উঠেছিলেন। ইশিগুরোর প্রতিটি উপন্যাস প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে সমালোচকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। তিনি যে একজন গুরুত্বপূর্ণ ঔপন্যাসিক, সমালোচকেরা সেটা সহজেই শনাক্ত করেছিলেন। কয়েকটি উপন্যাস পুরস্কারও অর্জন করেছে। ‘আ পেল ভিউ অব হিল্স’ রয়্যাল সোসাইটি অব লিটেরেচারের উইনফ্রেড অ্যাওয়ার্ড (১৯৮৩) পায়। ‘অ্যান আর্টিস্ট অব দ্য ফ্লোটিং ওয়ার্ল্ড’ জিতে নেয় হোয়াইটব্রিড লিটের‌্যারি অ্যাওয়ার্ড (১৯৮৬)। এরপর ‘দ্য রিমেইন্স অব দ্য ডে বুকার পুরস্কার অর্জন করে। সমালোচকদের প্রায় সবাই ইশিগুরোর চমৎকার সংহত ভাষাশৈলী আর গল্প বলার নিয়ন্ত্রিত রীতির প্রশংসা করেছেন।

আ পেল ভিউ অব হিল্স : ‘আ পেল ভিউ অব হিল্স’ সম্পর্কে বলতে গিয়ে স্পেকটেটর পত্রিকার ফ্র্যান্সিস কিং লিখেছেন, জাপানি পটভূমিতে লেখা হলেও তিনি বিস্তৃতভাবে যেখানে ব্যাখ্যার প্রয়োজন নেই সেখানে বিস্তার দেননি। অনেকে আবার টাইমস লিটেরেরি সাপ্লিমেন্টের সমালোচক পল বেইলির সঙ্গে একমত হয়ে বলেছেন, ইশিগুরোর উপন্যাসে বর্ণনার অনেকগুলো স্তর ও ইমেজ থাকে, যা পাঠকের নানা ধরনের অনুভূতিকে স্পর্শ করতে পারে। নিউ সোসাইটি পত্রিকার জনাথন স্পেন্স লিখেছেন, ‘এটি একটি চমকপ্রদ গভীর ভাবনামূলক উপন্যাস, পাঠককে সচেতনার একটি স্তর থেকে আরেকটি স্তরে নিয়ে যায়।’ লস এঞ্জেলেস টাইমসের রোজমেরি রবার্টসও মনে করেন ইশিগুরোর আছে নিয়ন্ত্রিত গদ্যশৈলী। বিশ্লেষণ নয় এই গদ্যের ধরনটা হচ্ছে ইঙ্গিতগর্ভ, সাংকেতিক, রহস্যময়। অতীতের জাপান আর বর্তমানের ইংল্যান্ড- রূপক-প্রতীকের অদৃশ্য বিমিশ্রণে এমন একটা গদ্যশৈলীর দৃষ্টান্ত হয়ে উঠেছে যা নিঃসন্দেহে অনন্য। উপন্যাসের ইতিবাচক ভাবার্পণও উল্লেখ করার মতো। জীবনে অনেক বিরূপতা থাকবে, কিন্তু জীবন কখনও থেমে থাকে না। এই ইতিবাচক ভাবনার জন্যও সমালোচকরা উপন্যাসটির প্রশংসা করেছেন।

দ্য রিমেইন্স অব দ্য ডে : ইশিগুরোর এই উপন্যাসটি বহুল প্রশংসিত একটি অসাধারণ উপন্যাস। টাইমস লিটেরেরি সাপ্লিমেন্টেই গ্যালেন স্ট্রসন লিখেছেন, এটি একটা দারুণ শক্তিশালী কিন্তু সূক্ষ্ম উপন্যাস। কাহিনীর বুননটা দারুণ এবং কৌতুককর। ‘এটা একটা দুর্দান্ত মৌলিক উপন্যাস, চমৎকার এর নির্মিতি… এর ভাষাই উপন্যাসটির পটভূমি নির্মাণ করে দিয়েছে, যার ফলে ঔপন্যাসিক এতে সহমর্মিতার সবটুকু ঢেলে দিতে পেরেছেন। ভাষাটাও দারুণ।’ উপন্যাসটির কাহিনী বিষাদময়, চমৎকার তার নির্মিতি। কমেডির ভাবাবহের মধ্য দিয়ে ট্রাজেডিই উপজীব্য হয়েছে উপন্যাসটিতে। স্টিভেন্স চরিত্রটির বর্ণনাতেই নানা স্তরের ন্যারেটিভের ভেতর দিয়ে এগুতে হবে পাঠককে, যার সৌন্দর্যে বিমুগ্ধ হতে হতে ছুঁয়ে দেবেন জীবনের অর্থহীনতা আর বিমর্ষতাকে। এই উপন্যাসটিতেই আগে যেমনটা উল্লেখ করেছি, ন্যারেটিভের নানা স্তর রয়েছে, যে শৈলীর জন্য ইশিগুরো খ্যাতি অর্জন করেন। স্টিভেন্স নামের যে খানসামার চরিত্রটিকে ঘিরে এই উপন্যাসটি লেখা হয়েছে, সেই স্টিভেন্সের আবেগকে গোপন রেখেই তার জীবনের কথা চমৎকারভাবে বলে গেছেন ইশিগুরো। ইশিগুরোর শূন্য ফাঁপা মানুষদের মধ্যে স্টিভেন্স আরও শূন্য ফাঁপা একজন মানুষ। সূক্ষ্ম পরিমিতিবোধ, গভীর বিষাদ, দুঃসহ একাকিত্ব উপন্যাসটিকে সমকালের শ্রেষ্ঠ উপন্যাস করে তুলেছে নিঃসন্দেহে। সালমান রুশদিও বলেছেন, এটি একটি অসাধারণ উপন্যাস। মৃত্যু, পরিবর্তন, যন্ত্রণা আর অমঙ্গলবোধের কথা চমৎকারভাবে ফুটে উঠেছে। নোবেল পুরস্কার কমিটির প্রতিনিধির কণ্ঠেও শোনা গেছে এই কথারই প্রতিধ্বনি।

দ্য আনকনসোল্ড : ইশিগুরোর প্রতিটি উপন্যাসে কেন্দ্রীয় চরিত্রটিই কাহিনীর বর্ণনা দেয়। তার উপন্যাসের বর্ণনাকারী প্রকারন্তরে লেখক নিজেই। উত্তর পুরুষের জবানিতে কাহিনী বলে যায়। সেই সঙ্গে কিছু চরিত্র আছে যারা সেই বর্ণনার পাঠক, যেমন এতসুকো, ওনো, স্টিভেন্স; তারা তাদের বলা তাদেরই জীবনের গল্পকে অনুধাবন করতে চেষ্টা করে। নিজেরাই তাদের জীবনের ব্যাখ্যা দেয়। ‘দ্য আনকনসোল্ড উপন্যাসের রাইডার এরকমই একটা চরিত্র যাকে এই দুই ভূমিকাতেই দেখা যাবে – ‘লেখক’ ও ‘পাঠক’।

‘দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস বুক রিভিউ’তে তার ‘দ্য আনকনসোল্ড’ উপন্যাসটি সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে লুই মেনান্ড বলেছিলেন, ইশিগুরো সুগভীর মনোবাস্তবতা আর উজ্জ্বল অনন্য ভাষাশৈলীর জন্য ইংরেজি সাহিত্যের অন্যতম প্রধান লেখক। তার চরিত্রগুলো অনুভূতিহীন, কিন্তু পাঠকের অনুভূতিকে ঠিকই উস্কে দেন তিনি। সেই অনুভূতিটি হচ্ছে প্রেমের, ভালোবাসার। তিনি মানুষের সেই একক অনুভূকেই জাগিয়ে দিতে চান যাকে আমরা বলি প্রেম। মানুষের প্রেমময় হওয়া উচিত, কিন্তু নিজেরই কারণে এই অনুভূতিকে সে ধরে রাখতে পারে না, অব্যাহতভাবে ধ্বংস করে ফেলে। মেনান্ডের মতে ইশিগুরো একজন মৌলিক উল্লেখযোগ্য প্রতিভাধর ঔপন্যাসিক। আমাদের মনস্তাত্ত্বিক স্বপ্ন-বাসনা আর বিভ্রমের গভীর প্রকাশ ঘটেছে তার উপন্যাসে। প্রথাগত উপন্যাস রচনার ধারা থেকে সরে এসেছেন এবং এখানেই তার উৎকর্ষ আর শ্রেষ্ঠত্ব।

মেনান্ড যে-কথাটি গুরুত্বের সঙ্গে বলতে চেয়েছেন তা হল, তার উপন্যাস জটিল, মনোময়। শৈলীর দিক থেকে নির্দিষ্ট একটা ধারায় অগ্রসর হলেও ভীষণ গতিশীল। ইশিগুরোর প্রথম তিনটি উপন্যাসের চরিত্রগুলো তার নির্মিত বিশেষ চরিত্র, কিন্তু তারা যেভাবে পরিণামের দিকে এগিয়ে যায়, সেটাই মানবিক। একের পর এক তার চরিত্রগুলো যেন আয়নার সামনে এসে দাঁড়ায় আর নিজের জীবনকে দেখতে থাকে। বুঝতে পারে হয়তো সবকিছু ঠিক মতো চলছে, কিন্তু তার জন্য মানুষকে নিরন্তর সংগ্রাম করতে হচ্ছে।

এই উপন্যাসের কাহিনীটি এরকম : একটা অচেনা শহরে এসে পড়েছে প্রধান চরিত্র রাইডার। যার সঙ্গে বা যে পরিবারের সঙ্গে সে পরিচিত হচ্ছে, দেখছে, পরিবারটি ভেঙে পড়ছে।

কিন্তু সে স্বপ্ন দেখে মানবিক সম্পর্কের আর তখনই তার স্বপ্নের মধ্যে যে মানবিক কাঠামো ছিল, তাতে বিপর্যয় দেখা দেয়। এই স্বপ্নের সে-ই নির্মাতা, সে-ই স্বপ্নকে আবার ভেঙে দেয়। নিজেই সৃষ্টি আবার নিজেই স্রষ্টা। উপন্যাসের এক জায়গায় সে যখন তার বাবা-মায়ের মধ্যে ঝগড়া লাগিয়ে দেয়, যা অনেক দম্পতির মধ্যে দেখা যায়, কেন তারা ঝগড়া করবে তার জন্য আবার তাদের সতর্কও করে দেয়। উপন্যাসের এই অংশে রাইডারই বলে, ‘আমি তোমাদের সাবধান করে দিচ্ছি, আমি কিন্তু তোমাদের ঝগড়াঝাটি থামিয়ে দেব! সাবধান করে দিচ্ছি।’ এ-এক অভিনব শৈলী। কথকই বলছে গল্পটি আবার কথকই গল্পকে নিয়ন্ত্রণ করছে। কথকই গল্প গড়ে তোলে আবার কথকই গল্প ঘুরিয়ে দেয় বা নিয়ন্ত্রণ করে, ভেঙে দেয়। অব্যাহতভাবে এরকম কাণ্ডই রাইডার করে চলে। কিন্তু এই স্বাপ্নিক মানুষটিও তার ক্রিয়াকর্ম আর স্বপ্নকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। রাইডার একজন বেহালাবাদক, সে যখন কাহিনী বর্ণনা করছে সেই বর্ণনাভঙ্গিও হয়ে উঠছে গীতিময়। যে শহরে তার স্বপ্নের বিচরণ, সেই শহরটাকে ‘কাফকীয়’ শহর বলে মনে হয়। রাইডার ক্রমাগত তার পরিচয় নির্মাণের চেষ্টা করে, প্রতিবার সেই নির্মাণ অনির্মিত থেকে যায়। অন্য মানুষের সঙ্গে অসংযোগ, বিচ্ছিন্নতা, দূরত্ব, ব্যর্থতাই কেন্দ্রীয় চরিত্র রাইডারের বৈশিষ্ট্য। এ এমন এক পৃথিবী যা ক্রমশ বদলে যাচ্ছে, মানুষ তার সঙ্গে খাপ খাওয়াতে পারছে না।

একজন সমালোচক ইশিগুরোর উপন্যাসের মূল ভাবনাকে ব্যাখ্যা করেছেন এইভাবে : প্রায় সবগুলো উপন্যাসকে ঘিরে, বিশেষ করে প্রথম দিকের উপন্যাসগুলোকে ঘিরে মার্কিন জীবনাচরণ ও জীবনভাবনাকে ক্রিটিকাল দৃষ্টিতে দেখেছেন ইশিগুরো। জীবন এখানে ক্ষয়িষ্ণু, ভঙ্গুর; সবকিছুই মুক্ত আর স্বাধীন। কিন্তু তার ন্যারেটর বা বর্ণনাকারীরা পূর্বতন রাজকীয় যুগের মূল্যবোধকে ধারণ করে বেঁচে থাকতে চায়। জেমিসীয় থিম বিশ শতকের প্রথম দিকের ঔপন্যাসিকদের প্রভাবিত করেছিল। আর সেটা হল নতুন আর পুরাতন পৃথিবীর দ্বন্দ্ব এখনও আছে। এই পৃথিবীতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র হচ্ছে প্রবল ক্ষমতাধর একটি রাষ্ট্র। এরই প্রভাবে গড়ে উঠেছে এক নতুন বিশ্বব্যবস্থা, যে বিশ্বব্যবস্থার মধ্যে ভূতসদৃশ্য কিছু চরিত্র বিচরণ করছে, যারা স্বপ্ন দেখে, পৃথিবীকে সুন্দর দেখতে চায়, কিন্তু সম্ভব হয় না। ভূত হয়েই তাই ইশিগুরোর প্রধান চরিত্রগুলো এই পৃথিবীতে বিচরণ করে, বাস্তবতার দ্বারা আক্রান্ত হয়ে পড়োবাড়ি সদৃশ্য পৃথিবীতে ঘুরে বেড়ায়, অবস্থান করে, নিঃশেষ হয়ে যায়। কিন্তু জীবন নিয়ে তাদের ইতিবাচক আত্ম-অনুসন্ধান শেষ হয়ে যায় না।


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এই ক্যাটাগরির আরো নিউজ