হাসান একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে শেষবর্ষে পড়ছেন। তার ইচ্ছা, পড়াশোনা শেষ করে ভালো একটি চাকরি করবেন, বিয়ে করবেন মনের মানুষটিকে, যার সঙ্গে তার দীর্ঘদিনের প্রেম। একদিন হুট করে প্রেমিকার সঙ্গে কথা কাটাকাটি থেকে সম্পর্ক ভেঙে গেল। মানসিকভাবে অবসাদগ্রস্ত হয়ে পড়লেন হাসান। কিছুদিন পর রুমে ফ্যানের সঙ্গে ঝোলানো মরদেহ পাওয়া গেল তার। তিনি আত্মহত্যা করেছেন।
হাসনা উচ্চমাধ্যমিকের শিক্ষার্থী। প্রতিদিনই কলেজে যাওয়া-আসার পথে বখাটেরা তাকে উত্যক্ত করে। তাদের প্রস্তাবে সাড়া না দেওয়ায় ক্ষতি করার হুমকি দেয়। তিনি এ বিষয়ে কাউকে কিছু জানান না। কিন্তু দিনের পর দিন এ হয়রানি সহ্য করতে না পেরে একসময় আত্মহত্যার পথ বেছে নেন।
ঘটনা দুটি কাল্পনিক। প্রায় প্রতিদিনই পত্রপত্রিকার পাতায় চোখে পড়ে এমন তরুণ-তরুণীদের আত্মহত্যার খবর। ‘আত্মহত্যা’ যেন হয়ে উঠেছে নীরব ঘাতক। আশঙ্কাজনকভাবে বাড়ছে আত্মহত্যাকারীদের সংখ্যা, বাড়ছে আত্মহত্যা করার প্রবণতা। এ প্রসঙ্গে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আত্মহত্যার ঘটনা বেড়ে যাওয়ার কারণ সামাজিক ও নৈতিক অবক্ষয়, প্রেমে ব্যর্থতা ও পারিবারিক অশান্তি। এসব কারণে প্রথমে বিষণ্নতা ও মানসিক চাপ তৈরি হয়। পরে সেই বিষণ্নতাই ঠেলে দেয় আত্মহত্যার মুখে। কিছু তরুণ বোঝেন না, জীবনে নানা ঘাত-প্রতিঘাত আসতেই পারে। সেসবকে আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে মোকাবিলা করাই জীবন। কিন্তু তারা আত্মহত্যাকেই সবকিছুর সমাধান ভেবে নেন। জীবন সবার কাছেই তো আনন্দময়। যদি আনন্দময় না হতো তাহলে কি মানুষ বেঁচে থাকার জন্য এত কিছু করত? আর জীবনে দুঃখ, কষ্ট, হতাশা থাকলেও প্রত্যেক মানুষের মধ্যেই বেঁচে থাকার প্রতি তীব্র আকাঙ্ক্ষা কাজ করে। আর এজন্যই প্রতিটি মানুষের কাছে জীবন আনন্দময়। দৈনন্দিনের একঘেয়েমিকে পাশ কাটিয়ে একটু ভিন্নভাবে জীবনযাপনে নতুনত্বের স্বাদ মেলে। প্রতিনিয়ত নিজেকে পরিবর্তন করা, নতুন সাজে উপস্থাপন করাই তারুণ্যের ধর্ম। আত্মহত্যা কোনোভাবেই কোনো সমস্যার সমাধান হতে পারে না।
সম্প্রতি ফেসবুকে ভাইরাল হয়েছে ব্লু হোয়েল। গেমটি তরুণদের মাঝে আত্মহত্যার প্রবণতা বাড়িয়ে দিচ্ছে। অনেকেই কৌতূহলের বশে অনলাইনে তন্ন তন্ন করে খুঁজছেন গেমটি। সাইবার দুনিয়ায় নিপীড়নের নতুন মাত্রা যুক্ত করেছে ব্লু হোয়েল। তরুণদের দুর্বলতা, বিশেষ করে একাকীত্বের সুযোগ নিয়ে ব্লু হোয়েল গেমটি আত্মহত্যার প্ররোচনা দেয়। এখন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নিউজফিডজুড়ে ব্লু হোয়েল নামের গেমটি নিয়ে খুব আলোচনা চলছে। ব্লু হোয়েল নিয়ে কেউ ট্রল করছেন, কেউবা স্ট্যাটাস দিচ্ছেন। এগুলো নিয়ে ভুয়া বার্তাও ছড়াচ্ছে।
এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, বাংলাদেশে আত্মহত্যাকারীর সংখ্যা বছরে দশ হাজার। আর যারা আত্মহত্যার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়, এমন মানুষের সংখ্যা এরও অনেকগুণ বেশি। এদের মধ্যে কিশোরী বা তরুণীদের আত্মহত্যার কারণ হিসেবে চিহ্নিত হয় প্রেমে ব্যর্থ বা প্রতারিত হওয়া এবং যৌন হয়রানির শিকার হওয়া। মোবাইল ফোন ও ইন্টারনেটের বহুল ব্যবহারও এমন ঘটনা ঘটাতে ভূমিকা রাখছে। পরীক্ষায় অকৃতকার্য হওয়ার পর পরিবারের তীব্র ভর্ত্সনা সইতে না পেরে আত্মহত্যা করছে অনেক কিশোর-কিশোরী বা তরুণ-তরুণী। অভাব-অনটনের কারণেও অনেক পরিবারে আত্মহত্যার ঘটনা ঘটে। এদের আত্মহত্যা করার ধরনেও ভিন্নতা রয়েছে। কেউ বিষ খেয়ে বা গলায় ফাঁস দিয়ে, কেউ ছাদ থেকে ঝাঁপ দিয়ে বা রেললাইনে চলন্ত ট্রেনের নিচে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করে। সম্প্রতি কিছু আত্মহত্যার ঘটনা উঠে এসেছে পত্রিকার পাতায়। বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতক শেষবর্ষে পড়ুয়া একজন শিক্ষার্থী যখন আত্মহত্যা করেন, তখন তা অনেক প্রশ্নের জন্ম দেয়। অনুসন্ধানে কারণ হিসেবে জানা যায়, প্রেমে ব্যর্থ হয়ে তিনি আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছেন। কেবল প্রেমে ব্যর্থতা থেকে যখন একজন মেধাবী তরুণ তার পরিবার ও অন্য সবার কথা ভুলে গিয়ে আত্মহত্যা করেন, তখন তা প্রমাণ করে তিনি অন্যদের থেকে কতটা বিচ্ছিন্ন ছিলেন। যারা বিষণ্নতার জন্য অন্যদের থেকে বিচ্ছিন্ন থাকেন, তাদের বেশিরভাগই নিজেকে ধ্বংস করার জন্য উপায় খুঁজতে থাকেন। তবে সময়মতো কাউন্সিলিং করলে এ সমস্যা থেকে বেরিয়ে আসা যায়। এদেশের সামাজিক প্রেক্ষাপটে সাধারণত বিষণ্নতাকে কোনো রোগ হিসেবে গণ্য করা হয় না। ফলে যিনি বিষণ্নতায় ভোগেন, তিনি অনেকটা একঘরে হয়ে পড়েন। মানসিক চিকিত্সকরা বলেন, বর্তমান সময়ের কিশোর ও তরুণরা নানাবিধ কারণে বিষণ্নতায় ভোগে। সচেতনতার অভাবেই মূল্যবান অনেক জীবন ঝরে পড়ে। স্কুল পর্যায় থেকে শুরু করে সব উচ্চশিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সাইকোলজিক্যাল কাউন্সিলর বা মনোবিদের পদ তৈরি করতে হবে, যিনি শিক্ষার্থীদের মানসিক সমস্যা বা অবসাদ দূর করতে পরামর্শ দিয়ে সাহায্য করবেন। আত্মহত্যার প্রবণতা থেকে রেহাই পেতে আত্মবিশ্বাসী হতে হবে। যেকোনো সমস্যার মোকাবিলায় কখনই আশাহত হওয়া যাবে না। পাশাপাশি অভিভাবক ও চারপাশের মানুষদেরকেও সচেতন হতে হবে। কাউকে বিষণ্ন হতে দেখলে তার পাশে থাকতে হবে, অনুপ্রেরণা জোগাতে হবে। তবেই সম্ভব ‘আত্মহত্যা’র মতো ঘাতককে মোকাবিলা করা।