উপাধ্যক্ষ, আনোয়ার খান মডার্ন মেডিকেল কলেজ
অধ্যাপক ডা. হোসনে আরা তাহিন চারু
অবসরপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ, ঢাকা মেডিকেল কলেজ
প্রত্যেক বছর অক্টোবর মাস বা পিংক অক্টোবর বিশ্বব্যাপী স্তন ক্যান্সার সচেতনতা দিবস হিসেবে পালিত হয়ে আসছে। একটু সচেতন হলে, দ্রুত এবং আগে এ রোগ নির্ণয় হলে স্তন ক্যান্সার জনন এবং এর জটিলতা ও মৃত্যুঝুঁকি অনেকাংশে প্রতিরোধ করা সম্ভব। বাংলাদেশে যদিও সঠিক কোনো পরিসংখ্যান নেই তথাপি প্রাপ্ত গবেষণালব্ধ ফলাফল থেকে জানা যায়, বছরে প্রায় ৪৪ হাজার মহিলা স্তন ক্যান্সারে আক্রান্ত হচ্ছেন এবং এর মধ্যে ১০-১৪০০০ মৃত্যু মুখে পতিত হচ্ছেন।
যদি কোনো মহিলা ৯০ বছর বয়স পর্যন্ত বাঁচেন তাহলে তার স্তন ক্যান্সার হওয়ার আশংকা ৮ ভাগের ১ ভাগ। বিশ্বব্যাপী মহিলাদের প্রায় ২৫-২৬% ক্যান্সারে আক্রান্ত হয় এবং এর মধ্যে ১৩-১৫% মৃত্যু মুখে পতিত হয়।
স্তন ক্যান্সারে কারা ঝুঁকিপূর্ণ
* বয়স- ৫০ বছরের ঊর্ধ্বে স্তন ক্যান্সার বেশি হয়। ২৫ বছরের নিচে স্তন ক্যান্সার হয় না বললেই চলে।
* প্রথম মহিলাদের মাসিক : ১১ বছর বয়সে মাসিক হলে স্তন ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ে। একইভাবে বেশি বয়সে মেনোপজ হলে বা রজস্রাব বন্ধ হলে স্তন ক্যান্সারের প্রকোপ বাড়ে।
* প্রথম সন্তান হওয়ার বয়স : ৩৫ বছর বয়সের পরে প্রথম সন্তান জন্ম দিলে স্তন ক্যান্সারের আশংকা যারা ২০ বছর বয়সে প্রথম সন্তান জন্ম দেন তাদের তুলনায় বেশি হয়।
* যাদের পরিবারে অন্যান্য মহিলা সদস্য, মা, খালা, বোনের স্তন ক্যান্সারের ইতিহাস থাকলে তাদের স্তন ক্যান্সার হওয়ার আশংকা বেশি।
* জেনেটিক মিউটেশন যেমন- BRCA1, BRCA2 জীন মিউটেশন হলে স্তন ক্যান্সার বেশি হয়।
* বংশগোত্র : সাদা মহিলাদের কালোদের তুলনায় স্তন ক্যান্সার বেশি হয়।
* যে মা সন্তানদের ঠিকমতো বুকের দুধ খাওয়ান তাদের অবিবাহিত, যারা বাচ্চাদের বুকের দুধ খাওয়ান না তাদের তুলনায় স্তন ক্যান্সার বেশি হয়।
* যাদের স্তনে পূর্বে কোনো বায়োপসি হয়েছে, অন্য কোন প্রলিফারেটিভ লেসিওন হয়েছে তাদের স্তন ক্যান্সার বেশি হয়।
* মেদস্থূলতা, বেশি মদ্যপান, কায়িক পরিশ্রম কম হলে স্তন ক্যান্সারের প্রকোপ ১-২ গুণ বৃদ্ধি পায়।
* যে কোনো ধরনের রেডিয়েশান বুকে স্তন ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়।
* এক স্তনে ক্যান্সার হলে অন্য স্তনে ক্যান্সার হওয়ার আশংকা বেশি থাকে।
স্তন ক্যান্সারের লক্ষণ
* স্তনের যে কোনো স্থানে চাকা, দলা, গোটা হওয়া, টিউমার, প্রদাহ হলে। জেনে রাখবেন বেশির ভাগ চাকা, দলা বা গোটা বেনাইন বা ক্যান্সার নয়।
* স্তনে ব্যথা।
* স্তনের চামড়ার, বোটার চারপাশের চামড়া কুচকে যাওয়া, রং এর পরিবর্তন, দানা দানা হওয়া।
* স্তনের বোঁটা ভেতরের দিকে ঢুকে যাওয়া।
* স্তনের বোঁটা দিয়ে কোনো রক্ত, রস, পুঁজ বের হওয়া, বগলের নিচে কোনো ফোলা, দলা, চাকা।
* ছড়িয়ে পড়া স্তন ক্যান্সার এর জন্য (সাধারণতঃ ফুসফুস, লিভার, হাড়, মস্তিস্কে) আক্রান্ত অর্গান এর উপর লক্ষণ নির্ভর করে। যেমন ফুসফুসে আক্রান্ত হলে শ্বাসকষ্ট, বুক ব্যথা, কফ, রক্ত মিশ্রিত কফ, হাড়ে আক্রান্ত হলে হাড় ব্যথা, হাড় ভাঙা। লিভার আক্রান্ত হলে জন্ডিস, লিভার ফেইলর, মস্তিষ্ক আক্রান্ত হলে হঠাৎ অজ্ঞান হওয়া, মূর্ছা যাওয়া, খিচুনি, মাথাব্যথা, চোখে ঝাপসা দেখা ইত্যাদি।
* লিম্ফনোড আক্রান্ত হলে লিম্ফনোড বড় হওয়া বা ফুলে যাওয়া।
* তাছাড়াও সব ধরনের ক্যান্সারের মতো ওজন কমা, রক্ত স্বল্পতা, অবসাদগ্রস্ত, অরুচি, ক্ষুধামন্দা।
রোগ নির্ণয়
* স্তন ক্যান্সারের প্রধান রোগ নির্ণায়ক হল নিজে নিজে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে স্তন পরীক্ষা। প্রথম এক স্তন পরে অন্য স্তন, বগলের নিচেসহ। হাল্কাভাবে হাতের তালু দিয়ে স্তন চাপ দিয়ে অনুভব করতে হবে কোন চাকা, দলা, গোটা আছে কিনা। এরপর চামড়া, বোঁটা, রং এর পরিবর্তন, দানা, বোঁটা কুচকানো, ভেতরের দিকে ঢুকানো কিনা ইত্যাদি লক্ষ করতে হবে।
* চিকিৎসকের পরামর্শ মতো ম্যামোগ্রাফী, এফএনএসি করতে হবে।
* প্রাথমিক রোগ নির্ণয় এর পর বায়োপসি করতে হবে ক্যান্সারের স্টেজিং, গ্রেডিং এর জন্য।
* সিটি স্ক্যান, এমআরআই ক্যান্সার কতটুকু ছড়িয়ে পড়েছে তা দেখার জন্য করা হয়।
* রক্ত রুটিন হেমোগ্লোবিন, টিসি, ডিসি, ইএসআর।
* বোঁটার রক্ত, রস, পুঁজ বের হলে সাইটোলজি পরীক্ষা।
* জেনেটিক টেস্ট যেমন BRCA1, BRCA2 পরীক্ষা করা।
* বিশেষ পরীক্ষা যেমন HER 2
চিকিৎসা
* সার্জারি প্রধান চিকিৎসা, এর মাধ্যমে গোটা, চাকা, দলা আশপাশের কিছু ভালো টিস্যু সহকারে কেটে আনা হয়।
* অ্যাডভান্স ক্যান্সারের জন্য রোগীকে সার্জারি, স্তন কেটে ফেলা, বগলের নিচের ফ্যাট লিম্ফনোড কেটে ফেলা।
* রেডিওথেরাপি ও কেমোথেরাপি।
* হরমোন থেরাপি যাদের ঊজ/চজ পজিটিভ হবে।
* ইমিনোথেরাপি
* HER 2 পজিটিভ হলে হারসেপটিন/ট্রাস্টুজমার দিয়ে চিকিৎসা
প্রতিরোধ
* ধূমপান, মদ্যপান পরিহার।
* বেশি বয়সে বাচ্চা জন্মদান না করা।
* এস্ট্রোজেন গ্রহণ না করা, হরমোন রিপ্লেশমেন্ট থেরাপি, জন্ম নিয়ন্ত্রণ বড়ি কম গ্রহণ বা পরিহার, বাচ্চাকে ঠিকমতো বুকের দুধ খাওয়ান।
* যাদের পরিবারে বেশি স্তন ক্যান্সার আছে তাদের নিয়মিত চেকআপ এবং ফলোআপ।
* FNAC পজিটিভ হলে স্তন কেটে ফেলা।
* ৩৫ বছরের পর প্রতি বছর ম্যামোগ্রাফি করা।
* স্তনে কোনো চাকা, দলা, গোটা, বগলের নিচে কোন দলা, গোটা, চাকা থাকলে FNAC করা, বায়োপসি করা।
* কায়িক শ্রম বাড়ানো।
* রেডিয়েশান থেকে মুক্ত থাকা।
* স্তনের বোঁটা ভেতরের দিকে ঢুকে গেলে, কুঁচকে গেলে, বোঁটার চারদিকে কমলার চামড়ার মতো ছোট ছোট গর্ত হলে বা রং এর পরিবর্তন হলে এর থেকে কোন ডিসচার্জ হলে অতি শিগগির চিকিৎসকের পরামর্শ গ্রহণ করুন।