নাজমুল হোসেন শান্ত ব্যাট করছেন নেটে। তার ঠিক পেছনেই দাঁড়িয়ে শাহাদাৎ হোসেন দীপু।
তার অপলক দৃষ্টি শান্তর ব্যাটিংয়ে। শুধুই কি দীপু? এখন তো বাংলাদেশের ক্রিকেটেরই চোখ তার দিকে। নতুন পথের দিশা দেখাবেন শান্ত, গড়ে তুলবেন ভিন্ন এক সংস্কৃতি; এমন প্রত্যাশার পারদ। নেতৃত্বের স্বাদ আগেই পেয়েছেন, এখন তার কাছে হয়তো কিছুটা পুরোনোও। তবুও পাকাপাকিভাবে তিন ফরম্যাটের অধিনায়কত্ব পাওয়ার পর এবারই প্রথম টেস্টে নেতৃত্ব দেবেন শান্ত। তার আগে প্রশ্ন, শান্তর হাত ধরে কি সূচনা হবে বাংলাদেশের এক নতুন যুগেরও?
বয়সভিত্তিক পর্যায় থেকেই তাকে গড়ে তোলার চেষ্টা ছিল বিসিবির। প্রায় সব পর্যায়ে খেলে, অধিনায়কত্ব করে যতদিনে তিনি পা রাখেন আন্তর্জাতিক অঙ্গনে; পরিচিতি হন নতুন এক বাস্তবতারও। ট্রল, অবিশ্বাস আর তীব্র সমালোচনার তিরে বিদ্ধ হয়েছেন প্রতিনিয়ত।
মাঠে রান পাননি, বাইরে থেকে সমর্থন পাননি; শান্তর জন্য ভেঙে পড়াই ছিল স্বাভাবিক নিয়তি। তিনি তা মেনে নেননি। লড়েছেন, রান করেছেন, এরপর একটিও বাড়তি কথা বলেননি, কাউকে কিছু ফিরিয়ে দেওয়ার তাড়না তার ছিল না কখনোই; এখন তার হাতেই তিন ফরম্যাটের অধিনায়কত্ব।
‘পাণ্ডবদের’ গণ্ডির বাইরে বেরিয়ে প্রায় এক দশক পর কারো হাতে তিন ফরম্যাটের নেতৃত্ব এখন। এক্ষেত্রে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ছিলেন লিটন দাস। কিন্তু মাঠের ভেতরে, বাইরে মিলিয়ে তিনি শেষ অবধি দৌড়ে টিকে থাকতে পারেননি।
শান্ত এই দায়িত্ব পাওয়ার আগেই অবশ্য নেতৃত্বে টেস্ট অভিষেকের স্বাদ পেয়েছেন শান্ত। নিউজিল্যান্ডকে এ বছরই ঘরের মাঠে হারিয়েছে বাংলাদেশ, তখন ‘ভারপ্রাপ্ত’ অধিনায়ক ছিলেন শান্ত। ওই সময়টুকুতে দেশের ক্রিকেট ছিল নানা অস্থিরতায় ভরপুর; শান্ত তার দলকে রেখেছিলেন সবকিছুর বাইরে। শীতল ওই দলটা এনে দিয়েছিল বড় সাফল্য।
হয়তো তার লম্বা সময়ের জন্য নেতৃত্ব পাওয়াতে কাজে লেগেছে সেটি। শান্ত দলকে সত্যিকার অর্থেই ‘শান্ত’ রাখতে পারেন বলে বিশ্বাস ছড়িয়েছে। টেস্ট ক্রিকেটে বাংলাদেশের দীর্ঘদিনের ‘হেরে যাওয়ার’ ভাগ্য বদলে দিতে পারবেন শান্ত, হয়তো এমন আশাও।
শান্তর জন্য টেস্ট নেতৃত্বের সাফল্য ছুঁয়ে ফেলার উচ্চতা খুব একটা লম্বা নয়। ৩৪ টেস্টে অধিনায়কত্ব করে সবচেয়ে বেশি ৯ জয় মুশফিকুর রহিমের। তার সময়টুকুতে কিছু কিছু ফল এলেও বইতে হয়েছে ব্যর্থতার গ্লানি। এরপর তামিম ইকবাল একটি ও মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ ছয় টেস্টে নেতৃত্ব দেন। এর মধ্যে কেবল একটিতে জয় এসেছে।
মাঝে ব্যতিক্রম ছিলেন মুমিনুল হক। ‘অনাহুত অধিনায়কত্বের’ দায়িত্ব এই ব্যাটার আপন করে নিয়েছিলেন খুব। পেসারদের সুযোগ দিতে শুরু করেছিলেন, লম্বা সময়ের জন্য পরিকল্পনাও এঁটেছিলেন। কিন্তু সিনিয়র ক্রিকেটারদের অনুপস্থিতি নিয়ে এ ক্রিকেটারের আফসোস ছিল প্রায় নিয়মিত।
হুট করে মুমিনুলের ব্যাটে রান না আসায় চাপে পড়ে যান এই ব্যাটার। মাঝেমধ্যে মেজাজ হারানোর সঙ্গে অধিনায়কত্বও খোয়া যায় তার। এরপর সাকিব আল হাসান ফের নেতৃত্ব নেন; ওয়েস্ট ইন্ডিজ ও ভারতের কাছে দুই ম্যাচ করে হারার পর জয় পান আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে। এবার শান্তর হাতে এসেছে নেতৃত্ব।
অধিনায়ক হিসেবে তিনি ক্ষুরধার। তাকে নিয়ে দেশের ক্রিকেটের চেনা মুখ খালেদ মাহমুদ সুজনের মন্তব্য ছিল এমন, ‘অনেকের অনেক কিছুতে মনোযোগ থাকে, শান্তর শুধুই ক্রিকেটে। ’ টেস্টের জন্য এটুকু মনোযোগের খুব বেশি প্রয়োজন। বাড়তি কথা বলে ‘তর্ক’ বাড়ানোর অভ্যাস নেই। কথা বলায় সবসময়ই দেখান পরিমিতিবোধ।
এর সঙ্গে বাড়তি স্বস্তি এখন তার দলটা অনেকটাই স্থির। তরুণ মাহমুদুল হাসান জয়, দীপুরা দিচ্ছেন লম্বা সময় সঙ্গী হওয়ার বিশ্বাস। পেসারদের পাইপলাইনটা বেশ শক্তিশালী। অভিজ্ঞতা ফুরিয়ে গেলে এগিয়ে আসছেন নতুন কেউ।
তাইজুল ইসলাম, মেহেদী হাসান মিরাজের অভিজ্ঞতা সঙ্গে করে ২০ উইকেট নেওয়ার সামর্থ্য আছে এই বোলিং লাইন আপের; বাংলাদেশের বেশির ভাগ টেস্ট অধিনায়কই খুঁজে ফিরেছেন যেটি। সাকিব আল হাসান যখনই যোগ হবেন, সেটি হবে বাড়তি পাওয়া।
এর সঙ্গে তার জন্য মুশফিকুর রহিম, লিটন দাসদের অভিজ্ঞতা স্বস্তি এনে দিতে পারে যেকোনো কঠিন মুহূর্তে। চন্ডিকা হাথুরুসিংহের সঙ্গে রসায়ন জমলে, ডাগ আউট থেকেও অটুট থাকা সমর্থনই চলে আসার কথা তার জন্য।
এসবের সঙ্গে ব্যাট হাতে শান্তর পারফরম্যান্সটাও দরকার হবে খুব। সেটি এখন অবধি সঙ্গেই আছে তার। শেষ ছয় ইনিংসের তিনটিই সেঞ্চুরি ছুঁয়েছেন। এমন কিছু চালিয়ে গিয়ে শান্ত হতে পারেন ‘পারফরম্যান্সেও সামনের সারিতে থাকা নেতা। ’
দীর্ঘদিনের কঠিন ও বন্ধুর পথ পাড়ি দেওয়া। নানা উত্থান-পতন দেখেছেন কাছ থেকে। বিভিন্ন ধাপে পেরিয়েছেন অনেক লম্বা সব সিঁড়ি। টেস্ট নেতৃত্বে এসব অভিজ্ঞতা কাজে আসার কথা প্রতিনিয়ত। সবকিছু মিলিয়ে শান্তর হাত ধরে সাদা পোশাকে নতুন সূচনা খুব দূরের কিছু নয়। জরুরি কেবল বিশ্বাসটুকু। বাংলাদেশ কি তার ওপর বিশ্বাস রাখবে? উত্তরটা সময়ের কাছে তোলা থাকল।