ফরিদপুর প্রতিনিধি॥
জালিয়াতি করে বন বিভাগের জমি দখল করার কাজে খালেদা জিয়ার উপদেষ্টা পরিষদের সাবেক সদস্য মোসাদ্দেক আলী ফালুকে সহায়তার অভিযোগে দুদকের হাতে আটক ফরিদপুরের আলফাডাঙ্গা নিবাসী বাগেরহাট জেলা সাব রেজিষ্টার ফজলুর রহমানকে নিয়ে গোটা ফরিদপুর জেলাজুড়ে তোলপাড় শুরু হয়েছে। গত সোমবার দুদকের হাতে আটকের পর একের পর এক বেরিয়ে আসছে দুর্নীতির মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা কামানোর বিষয়টি। দেশের বিভিন্ন স্থানে নামে বেনামে ফজলুল রহমানের রয়েছে কোটি কোটি টাকার সম্পদ। তার সম্পদের পরিমান দেখে যে কেউ আতকে উঠবেন। একজন দরিদ্র পরিবারের সন্তান হয়ে শুধুমাত্র মানুষের কাছ থেকে ঘুষ নিয়েই পাহাড়সম সম্পদ করেছেন। আলফাডাঙ্গা উপজেলার গোপালপুর ইউনিয়নে প্রাসাদসম একটি বাড়ী করছেন গত তিন বছর ধরে। বাড়ীর কাজ এখনো চলছে। স্থানীয়রা জানান, অজোপাঁড়া গাঁয়ে এমন প্রাসাদ যিনি তৈরী করছেন তিনি নিতান্তই সাধারন এক পরিবারের সন্তান। স্থানীয়রা বলছেন ফজলুর রহমান ‘আলাদিনের চেড়াগ’ হাতে পেয়েছেন। নতুবা অল্পদিনেই শত কোটি টাকার মালিক হওয়া কোনভাবেই সম্ভব নয়। ঘুষ-দুর্নীতির মাধ্যমে তিনি কোটি কোটি টাকা কামিয়ে নিজের নামে এবং তার পরিবারের অন্য সদস্যদের নামে দেশের বিভিন্ন জেলায় অঢেল সম্পদ করেছেন।
স্থানীয় এলাকাবাসী, প্রাপ্ত অভিযোগ ও খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বিএনপির সাবেক এমপি মোসাদ্দেক আলী ফালুর নামে ময়মনসিংয়ের ভালুকা থানার পালগাঁও মৌজায় ছয়টি দলিলের মাধ্যমে ৯ দশমিক ৬৪ একর জমি রেজিষ্ট্রি করে তা আত্মসাৎ করেন। এ ঘটনায় ভালুকা থানায় গত রবিবার ৬টি মামলা দায়ের করেন দুদকের ময়মনসিংহ সমন্বিত জেলা কার্যালয়ের উপ-পরিচালক মোঃ জাহাঙ্গীর আলম। গত ১৮ অক্টোবর এসব মামলা দায়েরের অনুমোদন দেয় দুদক। দুদক সূত্রে জানাগেছে, তৎকালীন ভালুকা উপজেলা সাব রেজিস্ট্রার ফজলুর রহমান আইন ও বিধি বিধান অনুসরণ না করে অবৈধ সুবিধা নিয়ে দালাল চক্রের যোগসাজশে ছয়টি দলিলে রেজিস্ট্রি করে সরকারি সম্পত্তি ফালুকে হস্তান্তর করেন।
এদিকে, সাব রেজিষ্টার ফজলুর রহমানকে আটকের পর তার নিজ এলাকা ফরিদপুরের আলফাডাঙ্গার গোপালপুর গ্রামের মানুষের মাঝে তুমুল আলোচনা-সমালোচনার সৃষ্টি হয়। স্থানীয় অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন, দিনের পর দিন ঘুষ-দুর্নীতির মাধ্যমে কোটি কোটি টাকার সম্পদ গড়ে তোলা হলেও প্রশাসন তার বিরুদ্ধে কেন ব্যবস্থা নেয়নি। অবিলম্বে দুর্নীতিবাজ ফজলুর রহমানের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহনের পাশাপাশি অবৈধ উপায়ে আয়কৃত সম্পদ বাজেয়াপ্ত করার দাবীও জানান তারা। অনুসন্ধানে জানাগেছে, আলফাডাঙ্গা বাজারের দক্ষিন পাশে বাকাইল রোডে তার জমি রয়েছে ৯ শতাংশ । আলফাডাঙ্গা বাজারে আকরাম চেয়ারম্যানের বাড়ীর পাশে ৩ শতাংশ জমি রয়েছে। বুড়াইচ ইউনিয়নের কোটরাকান্দি মৌজায় ফসলি জমি কেনা আছে ছেলে ফয়সাল রহমান, পিয়াস রহমান, মিজানুর রহমান, ফজলার রহমানের বোন মিনার নামে জমি কেনা আছে। ওই এলাকায় সাড়ে সাত একর জমি কেনা আছে। গোপালপুর ইউনিয়নের টেগরডাঙ্গা, কাতলাসুর, পবনবেগ, কুচিয়াগ্রাম গ্রামের বিভিন্ন জায়গায় ৩০ একর ফসলি জমি কেনা আছে। এগুলো তার মামাতো ভাই নুরুজ্জামান, ভাই কুতুবউদ্দিন, ছেলে ফয়সাল রহমান, পিয়াস রহমান, মিজানুর রহমান, ফজলার রহমানের বোন মিনা, খালাত ভাই আবুল কাশেমের নামে কেনা। কুচিয়াগ্রামের উত্তরপাড়ায় তিনতলা বাড়ি করেছেন ফজলুর রহমান। বিলাসবহুল প্রাসাদ। আনুমানিক খরচ করেছেন ৫ কোটি টাকা। কুচিয়াগ্রাম জয় বাংলা হাটের ওপর মসজিদ এবং মাদরাসা করেছেন প্রায় এক কোটি টাকা ব্যয়ে। বাগেরহাটের সদর উপজেলার রাধাবল্লব গ্রামে ৩০ একর জমি নিয়ে চিংড়ির একাধিক ঘের করেছেন। ওখানে প্রতি শতাংশ জমির মূল্য ৫০ থেকে ৬০ হাজার টাকা। রাধাবল্লব এলাকাতে তিনি বাড়ি এবং জুটমিল করছেন। জুটমিল করছেন আনুমানিক ৭ একর জমি নিয়ে। মাটি ভরাট করা হয়েছে। বর্তমানে নির্মাণ কাজ চলছে। ওখানে বর্তমানে একটি টিনসেডের বিশাল ঘর তুলেছেন। নাম দিয়েছেন বাগান বাড়ি। বাগেরহাট সদরেও তার জমি আছে। বাগেরহাটের জমিগুলো মামাতো ভাই নুরুজ্জামান ও মনিরুজ্জামানের নামে কেনা। পিরোজপুর সদরে লুৎফর মিয়ার ইটের ভাটার ভেতরে তার নামে জমি আছে। এছাড়া ঘেরও আছে ওই এলাকায়। ওখানে সব মিলিয়ে তিন একর জমির মালিক তিনি। পিরোজপুরের জমি মামাতো ভাই নুরুজ্জামান ও মনিরুজ্জামানের নামে কেনা। বরিশালের অনেক জায়গাতে জমি কেনা আছে তার। কক্সবাজারে আছে তিনটি ফ্ল্যাট। এছাড়া হোটেল কক্সটুডেতে একটি ফ্লোরের মালিক তিনি। কক্সবাজারে বেশকিছু জমিও কেনা আছে। এই সম্পত্তিগুলো নুরুজ্জামান ও মনিরুজ্জামানের নামে কেনা। এসব সম্পত্তির দেখাশোনা করে কক্সবাজারের সাব রেজিস্ট্রি অফিসের নাইটগার্ড বাবলা। সেই এসব সম্পত্তি দেখাশোনা করেন। কুয়াকাটার রাঙাবালি উপজেলায় একশ একর জমি কিনেছেন ফজলার রহমান। সরকারি বন, পাহাড়ের পাশে। কুয়াকাটায় একটি বাড়িও করেছেন তিনি। কুয়াকাটার সম্পত্তিগুলো নুরুজ্জামান ও মনিরুজ্জানের নামেই কেনা। নুরুজ্জামান একসময় সেনাবাহিনীর সৈনিক ছিলেন। আরো প্রায় ২০ আগে তিনি অবসরে গেছেন। মনিরুজ্জামান পেশায় ইঞ্জিনিয়ার। একটি বেসরকারি কোম্পানিতে কাজ করতেন। এখন বেকার। তবে বাগেরহাটের জুট মিল দেখা শোনা করছেন। খুলনা শহরের সোনাডাঙ্গা স্ট্যান্ডের পাশে চার বিঘা জমি কিনেছেন তিনি। এই জমিগুলো তিনি এবং তার স্ত্রীর নামে কেনা। আনুমানিক প্রতি শতাংশের মূল্য ৫০ লাখের কাছাকাছি। ফরিদপুর জেলায় যেসব সম্পত্তি করেছেন তার মধ্যে রয়েছে শহরের রাজবাড়ী রাস্তাার মোড় থেকে (ঢাকার দিকে যেতে) কিছুটা দুরে ৪০/ ৫০ শতাংশ জমি।যার আনুমানিক বাজার মূল্য প্রতি শতাংশ এক লাখ টাকার বেশি। ফরিদপুর শহরের অন্যান্য জায়গাতেও জমি আছে। ফরিদপুরের সম্পত্তিগুলো দেখাশোনা করে মাসুদ নামে এক ব্যক্তি। তিনি বর্তমানে বোয়ালমারী সাব রেজিস্ট্রি অফিসে কমরত আছেন। এছাড়া ঢাকায় ধানমন্ডির ৪/এ-তে ফ্ল্যাট আছে তার। মামাতো ভাই বিপুলের নামে কেনা। ঢাকার এলিফ্যান্ট রোডে শেলটেকের বিল্ডিংয়ে ফ্ল্যাট আছে ফ্ল্যাট, নম্বর ৪ জি। তাছাড়া সাভার, গাজীপুর এবং চট্টগ্রাম রোডে শানারপাড় এলাকাতে ১২ কাঠা জমি কিনেছেন তিনি। নতুন অনুমোদিত ৩০০ ফিট বিশ্বরোডের পাশে। জমিটি তিনি অথবা তার প্রয়াত স্ত্রী পাপিয়ার নামে। ঢাকার মধুমতি মডেল টাউন এলাকায় তার জমি আছে। কেরাণীগঞ্জ এবং ময়মনসিংহের ভালুকাতেও বিপুল ভূসম্পত্তি কেনা আছে তার।