৯০টি আসন নিয়ে জম্মু ও কাশ্মীরের বিধানসভা। প্রথম দফায় বুধবার ২৪ আসনে ভোটগ্রহণ চলছে। সকাল ৭টা থেকে ভোটগ্রহণ শুরু হয়। এক দশক পরে আবার বিধানসভা ভোট হচ্ছে। তবে ২০১৪-র মতো পূর্ণ রাজ্য নয়, ৩৭০ ধারা বাতিলের ফলে বিশেষ মর্যাদা খোয়ানোর পাশাপাশি রাজ্যের তকমাও হারিয়েছে জম্মু ও কাশ্মীর। ফলে বিগত ১০ বছরে অনেক কিছু পালটে গিয়েছে উপত্যকার রাজনীতিতে। কাগজে-কলমে কাশ্মীরের জামায়াতে ইসলামী অবশ্য এখনো একটি নিষিদ্ধ সংগঠন। তবে সংগঠনটির বেশ কয়েকজন শীর্ষস্থানীয় নেতা বা তাদের পরিবারের সদস্যরা অন্তত ১০-১২টি আসন থেকে প্রার্থী হয়েছেন। তারা ওই অঞ্চলের পুরনো দুটি রাজনৈতিক দলকে পেছনে ফেলে দিতে পারে কি না, সে দিকে সবাই সাগ্রহে তাকিয়ে আছেন।
বিবিসির খবরে বলা হয়েছে, গত মে মাসে ভারতে সাধারণ নির্বাচনের সময় দক্ষিণ কাশ্মীরের পুলওয়ামা জেলাতে নিষিদ্ধ ঘোষিত জামায়াতে ইসলামীর একজন প্রথম সারির নেতা বুথে গিয়ে ভোট দিচ্ছেন, এই ছবি সারা উপত্যকায় হইচই ফেলে দিয়েছিল। কারণটা আর কিছুই না, যে সংগঠনটি ৩০ বছরেরও বেশি সময় ধরে ভারতের যেকোনো নির্বাচন বয়কট করে আসছে – সেই জামায়াত অবশেষে দেশের মূল ধারার রাজনীতিতে ফিরতে চাইছে কি না, ওই ছবিটি সেই প্রশ্নই তুলে দিয়েছিল।
সেই নির্বাচনের পর চার মাস পরে এখন দেখা যাচ্ছে, জামায়াতে ইসলামীর নেতারা সরাসরি এখন কাশ্মীরের ভোটে অংশ নিচ্ছেন ও বিভিন্ন আসনে লড়ছেন– আর তাতে পুরো অঞ্চলের ‘রাজনৈতিক ডায়নামিক্স’টাই আমূল বদলে গেছে।
কাগজে-কলমে কাশ্মীরের জামায়াত অবশ্য এখনো একটি নিষিদ্ধ সংগঠন। তাই তাদের পক্ষে সরাসরি দলীয় প্রতীকে নির্বাচনে অংশ নেওয়া সম্ভবও ছিল না। তবে জামায়াতের বেশ কয়েকজন শীর্ষস্থানীয় নেতা বা তাদের পরিবারের সদস্যরা অন্তত ১০-১২টি আসন থেকে প্রার্থী হয়েছেন, কাশ্মীরের একজন বিতর্কিত ও জনপ্রিয় রাজনীতিবিদ ইঞ্জিনিয়ার রশিদের দল তাদের সমর্থনও করছে।
এই তথাকথিত ‘জামায়াত-ইঞ্জিনিয়ার’ জোট কাশ্মীরের পুরনো দুটি প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দল– আবদুল্লাহ পরিবারের নেতৃত্বাধীন ন্যাশনাল কনফারেন্স (এনসি) ও মুফতি পরিবারের নেতৃত্বাধীন পিপলস ডেমোক্র্যাটিক পার্টি (পিডিপি)-কেও পেছনে ফেলে দিতে পারে কি না, সে দিকে সবাই সাগ্রহে তাকিয়ে আছেন।
ন্যাশনাল কনফারেন্স আবার ভারতের প্রধান বিরোধী দল কংগ্রেসের সঙ্গে জোট ও আসন সমঝোতা করে ভোটে লড়ছে। পিডিপি ও বিজেপি (যারা ২০১৪র পর রফা করে একসঙ্গে সরকার গড়েছিল) অবশ্য এককভাবেই প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
এমনিতে জম্মু ও কাশ্মীরে এবারে বিধানসভা নির্বাচন হচ্ছে পাক্কা ১০ বছরেরও বেশি সময় পরে – এর মধ্যে ওই অঞ্চলটি ভারতের একটি পূর্ণ অঙ্গরাজ্যের মর্যাদা হারিয়েছে, লাদাখ অঞ্চলটিও রাজ্য থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে।
পাঁচ বছর আগে সংবিধানের ৩৭০ ধারা রদ করার মধ্যে দিয়ে জম্মু ও কাশ্মীরের বিশেষ স্বীকৃতিও বিলুপ্ত করা হয়েছে। নরেন্দ্র মোদি সরকারের সেই বিতর্কিত পদক্ষেপের পর এই প্রথম ওই অঞ্চলে বিধানসভার ভোট অনুষ্ঠিত হচ্ছে।
বুধবার জম্মু ও কাশ্মীর বিধানসভার সেই ভোটে প্রথম দফার ভোটগ্রহণ সম্পন্ন হবে। ৯০ আসনের বিধানসভায় ভোট নেওয়া হবে মোট তিনটি পর্বে, আজকের প্রথম দফার পর দ্বিতীয় ও তৃতীয় দফার ভোটগ্রহণ হবে যথাক্রমে ২৫ সেপ্টেম্বর ও ১ অক্টোবর।
এরপর ৪ অক্টোবর পুরো অঞ্চলের ভোটগণনা হবে একই সঙ্গে। জম্মু ও কাশ্মীরের সঙ্গে একই দিনে ভোটগণনা হবে হরিয়ানার বিধানসভা নির্বাচনেরও।
কাশ্মীরের জামায়াতে ইসলামী কারা?
জামায়াত এমন একটি সংগঠন, পাকিস্তান ও বাংলাদেশ-সহ দক্ষিণ এশিয়ার নানা প্রান্তেই যাদের সরব উপস্থিতি আছে। কাশ্মীরের জামায়াত অবশ্য আদর্শগত ও ঐতিহাসিকভাবে পাকিস্তানের জামায়াতেরই বেশি ঘনিষ্ঠ।
শ্রীনগর-ভিত্তিক সাংবাদিক ও গবেষক আকিব জাভেদ জানাচ্ছেন, কাশ্মীরেও জামায়াতের অন্তত পাঁচ হাজার সক্রিয় সদস্য আছেন, যারা ‘ফুলটাইমার’ বা সার্বক্ষণিক কর্মী হিসেবে সংগঠনের কাজকর্ম করেন।
বিভিন্ন স্কুল, কলেজ, হাসপাতাল ও ইসলামি চর্চাকেন্দ্র স্থাপনের মধ্যে দিয়ে তারা পুরো উপত্যকা জুড়েই বিরাট নেটওয়ার্ক গড়ে তুলেছেন। তবে জামায়াত অনুমোদিত প্রতিষ্ঠানগুলোতে সরকারি এজেন্সির হানা বা তল্লাশিও খুব নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা।
এহেন জামায়াত ১৯৮৭তে রাজ্য বিধানসভার ভোটে শেষবারের মতো লড়েছিল। পর্যবেক্ষকরা বলেন, সেই ভোটে তাদের ভালো ফল করার সম্ভাবনা থাকলেও কেন্দ্রের কংগ্রেস সরকারের মদতে নির্বাচনে ব্যাপক কারচুপি করে ফারুক আবদুল্লার ন্যাশনাল কনফারেন্সকে জিতিয়ে দেওয়া হয়েছিল।
এর কয়েক মাসের মধ্যেই কাশ্মীর উপত্যকা জুড়ে জঙ্গিবাদ ও বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন বাড়তে শুরু হয়। আর জামায়াত নির্বাচন বয়কট করে প্রধানত ধর্মীয় ও সামাজিক কর্মকাণ্ডে বেশি মনোযোগ দিতে থাকে।
২০১৯-এ পুলওয়ামাতে যে জঙ্গি হামলায় ৪০ জনের বেশি ভারতীয় আধা সামরিক সেনা নিহত হয়, তারপর কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জামায়াতকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে।
সরকারের পক্ষ থেকে তখন বলা হয়েছিল, জামায়াতের বিরুদ্ধে ‘সন্ত্রাসবাদে উসকানি দেওয়ার’ এবং বিচ্ছিন্নতাবাদে ইন্ধন জোগানোর লক্ষ্যে ‘ভারত-বিরোধী প্রোপাগান্ডায় যুক্ত থাকার’ প্রমাণ মিলেছে বলেই এই পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।
এ বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে সেই নিষেধাজ্ঞার মেয়াদ আরও পাঁচ বছরের জন্য বাড়ানো হয়। এর আগেও আবশ্য ১৯৭৫ ও ১৯৯০ সালে দু’দুবার জামায়াতকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছিল।
তবে আকিব জাভেদ বলছেন, নির্বাচনের আগে জামায়াতের শীর্ষ নেতারা এই নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার জন্য সরকারের কাছেও গোপনে দরবার করেছিলেন। ‘জম্মু ও কাশ্মীর আপনি পার্টি’র প্রেসিডেন্ট আলতাফ বুখারি এ জন্য মধ্যস্থতা করেছিলেন বলেও জানা যাচ্ছে।
শেষ পর্যন্ত সেই অনুরোধ রক্ষিত হয়নি, তবে তারপরেও জামায়াত নেতারা অনেকেই বিধানসভা ভোটে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে লড়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।