পাসপোর্ট নাগরিক অধিকার, নিঃস্বার্থ সেবাই অঙ্গীকার—স্লোগানটি অত্যন্ত চমত্কার। কিন্তু পাসপোর্ট সেবা পাইতে যে হয়রানির চিত্র পত্রপত্রিকায় বিভিন্ন সময় প্রকাশ হইয়াছে, তাহাতে এই নাগরিক অধিকার এবং ইহার নিঃস্বার্থ সেবার কথাটি খুব তাত্পর্যহীন হইয়া পড়ে। সত্য বটে, রাজধানী ঢাকার আগারগাঁও পাসপোর্ট অফিসের চিত্র অতীতের তুলনায় সন্তোষজনক। যদিও এখনো নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে পাসপোর্ট পাইতে হয়রানির শিকার হইবার খবর প্রকাশিত হয় প্রায়শই। নির্দিষ্ট তারিখে পাসপোর্ট প্রস্তুত না হইলে সেই তথ্য পাসপোর্ট সেবাগ্রহীতাকে আগেই মোবাইলে মেসেজের মাধ্যমে জানানো যাইতে পারে, যাহাতে তাহাকে অযথা পাসপোর্ট অফিসে গিয়া শূন্যহাতে ফিরিয়া আসিতে না হয়। সময়বিশেষে যে সকল কারণে সেবাগ্রহীতারা বেশি হয়রানির শিকার হন, সেই ব্যাপারে তাহাদের সচেতন করিতে পাসপোর্ট অফিসে সচেতনতামূলক বড় বড় ব্যানার স্টিকার লাগানো যাইতে পারে। কিন্তু হয়রানির চিত্র দেখিয়া মনে হইতে পারে যে পাসপোর্ট সেবাগ্রহীতাদের যেন আর কোনো কাজ নাই পাসপোর্ট অফিসে নিত্যদিন ঘোরাঘুরি করা ছাড়া। সুতরাং সামান্য অজুহাতে তাহাদের যেন ফিরাইয়া দেওয়া যাইতেই পারে।
পাসপোর্ট সেবায় হয়রানি লইয়া গত বত্সর প্রকাশিত ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)-এর একটি গবেষণা প্রতিবেদন হইতে জানা যায়, পাসপোর্ট সেবাগ্রহীতাদের ৫৫ দশমিক ২ শতাংশ বিভিন্ন দুর্নীতি ও অনিয়মের শিকার হইয়াছেন। প্রতিটি নূতন পাসপোর্টের জন্য একজন আবেদনকারীকে গড়ে ২ হাজার ২২১ টাকা ঘুষ দিতে হয়, যাহার মধ্যে ৭৫ দশমিক ৩ শতাংশ আবেদনকারীকে ভেরিফিকেশনের জন্য পুলিশের বিশেষ শাখাকে (এসবি) ঘুষ প্রদান করিতে হয় গড়ে ৭৯৭ টাকা। পুলিশ ভেরিফিকেশনের নামে অহেতুক আবেদনপত্রের ত্রুটি বাহির করিবার চেষ্টা, জঙ্গি কার্যক্রম ও অন্য রাজনৈতিক দলের সহিত সম্পৃক্ততার ভয় দেখাইয়া বিভিন্ন স্থানে ডাকিয়া ঘুষ দাবি এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে বিকাশের মাধ্যমে টাকা পাঠাইতে বলা হয়। জানা যায়, ঢাকার বাহিরে এই দুর্নীতি আরো বেশি হইয়া থাকে। ইতোপূর্বে এই মর্মে সংবাদ প্রকাশিত হইয়াছে যে, রাজশাহী পাসপোর্ট অফিসে কয়েকদিন ঘোরাঘুরি করিয়াও আবেদন ফরমই জমা দিতে পারিতেছেন না কেহ কেহ। চট্টগ্রামে বিভাগীয় ও আঞ্চলিক নামে দুইটি পাসপোর্ট অফিস থাকিলেও দালাল ছাড়া ফরম জমা দিতে গেলে নানা ছলচাতুরিতে তাহা বাতিল করা হয়। খুলনার বিভাগীয় পাসপোর্ট অফিসেও বিরাজ করিতেছে একই অবস্থা।
বলিবার অপেক্ষা রাখে না যে, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষও এই ব্যাপারে অবগত আছেন। সুতরাং ইহার লাগাম টানিয়া না ধরিলে দুর্নীতি একঅর্থে উত্সাহিত হয়। ২০১৪ সালের আগস্ট মাসে গণভবনে বসিয়া ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে দেশের ৩৩টি আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসে যন্ত্রে পাঠযোগ্য (মেশিন রিডেবল) পাসপোর্ট দেওয়ার কার্যক্রম উদ্বোধনের সময় সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের উদ্দেশে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বলিয়াছিলেন, ‘সকলে যেন সঠিকভাবে পাসপোর্ট পায়। কেহ যেন হয়রানির শিকার না হয়।’ তাহার পর প্রায় চার বত্সর পার হইলেও পাসপোর্ট সেবাগ্রহীতাদের হয়রানি এখনো সহনশীল পর্যায়ে আসে নাই। আমরা চাই না এই হয়রানি লইয়া আর একটিও সম্পাদকীয় লিখিতে।