ভৌত বিশ্বতত্ত্ব অনুযায়ী, কোনো ধারাবাহিক প্রক্রিয়ার পরিবর্তে এই মহাবিশ্বের উৎপত্তি হয়েছিল একটি বিশেষ মুহূর্তে। মহা বিস্ফোরণের মাধ্যমে সুপ্রাচীন বিন্দু থেকে মহাবিশ্ব তৈরির এই প্রক্রিয়াকেই সাধারণত ‘বিগ ব্যাং’ বলা হয়ে থাকে। ধারণা করা হয়, আজ থেকে প্রায় ১৩৭৫ কোটি বছর আগে প্রাচীনতম একটি বিন্দুর অতি শক্তিশালী বিস্ফোরণের মাধ্যমেই মহাবিশ্বের সৃষ্টি হয়েছিল। ঐ সময়ে এই মহাবিশ্ব একটি অতি ঘন এবং উত্তপ্ত অবস্থায় ছিল। আর মহাবিশ্ব সৃষ্টির প্রথম ১৮ কোটি বছর ধরে পুরো মহাবিশ্ব নিকষ অন্ধকারে ঢাকা ছিল। এই কারণে এই সময়টা ‘ডার্ক এজ’ বা ‘অন্ধকার যুগ’ হিসেবে পরিচিত।
এবার যুক্তরাষ্ট্রের অ্যারিজোনা স্টেট ইউনিভার্সিটির একদল জ্যোতির্বিজ্ঞানী বলেছেন তারা মহাবিশ্বের প্রথম আলোর উৎসর সন্ধান পেয়েছেন। জ্যোতির্বিজ্ঞানী জুড বাউমেন বলেন, মহাবিশ্বে সৃষ্ট প্রথম নক্ষত্র থেকে নিঃসৃত আলোর উপস্থিতির প্রমাণ পেয়েছেন তারা। গবেষণার উদ্ধৃতি দিয়ে ‘ন্যাচার’ জার্নালে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মহাবিশ্বের প্রথম দিকের কিছু হাইড্রোজেন কণায় প্রাপ্ত বিকিরণ থেকে আলোর উৎসর এই ‘ফিঙ্গার প্রিন্ট’ খুঁজে পেয়েছেন বিজ্ঞানীরা। তবে প্রথম নক্ষত্র ঠিক কতদিন আগে তৈরি হয়েছিল সে বিষয়ে কোনো ধারণা দিতে না পারলেও মহাবিশ্বের প্রথম আলোর উৎসর সন্ধান পাওয়ার ঘটনায় দারুণ উচ্ছ্বসিত গবেষকরা।
এই আলোর উৎসর সন্ধানের মধ্য দিয়েই মূলত ‘বেবি স্টার’ বা নক্ষত্রের জন্মরহস্য উদঘাটনে আরো একধাপ এগিয়ে গেল বিজ্ঞানীরা। অস্ট্রেলিয়ার কমনওয়েলথ সাইন্টিফিক এন্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল রিসার্চ অরগানাইজেশনের (সিএসআইআরও) জ্যোতির্বিজ্ঞানী কেইথ ব্যানিস্টার বলেন, বেবি স্টার জন্মের রহস্য উদঘাটন করতে পারাটা সত্যিই খুব রোমাঞ্চকর বিষয়। তবে আমরা যেহেতু সত্যি সত্যি সেই সময়কার নক্ষত্রের জন্ম দেখতে পারব না তাই আমাদের সেই সময়ের গ্যাসের ওপর আলোর যে প্রভাব হয়েছিল তার ওপরই নির্ভর করতে হবে।
সিএসআইআরও পরিচালিত পশ্চিম অস্ট্রেলিয়ার দ্য মারচিশন রেডিও অ্যাস্ট্রোনোমি অবজারভেটরির রেডিও টেলিস্কোপের এক দীর্ঘ গবেষণা থেকে এই তথ্য পেয়েছেন গবেষকরা। জুড বাউমেন এবং তার দল নক্ষত্র থেকে প্রথম আলোর উৎসর সংকেত পেতে দীর্ঘ ১২ বছর ধরে গবেষণা করেছেন। যে এলাকায় বসে এই গবেষণা করা হয়েছে সেটি পুরোপুরি ‘তরঙ্গ মুক্ত’ রাখা হয়েছিল। কেইথ ব্যানিস্টার বলেন, বউমেনের দল যে তথ্য উদঘাটন করেছে তা প্রমাণ করতে হয়ত সময় লাগবে। তবে এই রহস্য উদঘাটনের ক্ষেত্রে তা যুগান্তকারী এক দিশা দিয়েছে। মহাবিশ্ব সৃষ্টির দীর্ঘ যাত্রার রহস্য উদঘাটনে এটি অন্য রকম এক সূত্র। এটি নিয়ে আরো অনেক কিছু করার রয়েছে।
মহাবিস্ফোরণের পরমুহূর্তে হাইড্রোজেন, হিলিয়াম এবং লিথিয়ামের মতো মৌল তৈরি হলেও কার্বন, নাইট্রোজেন, অক্সিজেন এবং লৌহ তৈরি হয়নি। আরো অনেক পরে কোনো না কোনো নাক্ষত্রিক বিস্ফোরণ বা সুপারনোভা থেকে তৈরি হয় নক্ষত্র। ধারণা করা হয়, মহাবিশ্ব সৃষ্টির ১৮ কোটি বছর থেকে ৭৫ কোটি বছরের মধ্যে তৈরি হয়েছিল এসব নক্ষত্র। আর এই নক্ষত্র থেকেই মহাবিশ্বে নি:সৃত হয়েছিল প্রথম আলোক রশ্মি।
মহাবিশ্ব সৃষ্টির পর এটি ছিল জ্বলন্ত এক নিউক্লিয় চুল্লি। তাপমাত্রা ছিল একশ কোটি ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডের চেয়েও বেশি। চারদিক পূর্ণ ছিল কেবল প্লাজমার ধোঁয়াশায়। প্রথমে কোয়ার্ক, ইলেকট্রন, প্রোটন ও নিউট্রনের মতো মৌলিক কণিকাগুলো তৈরি হয়। পরে প্রোটন আর নিউট্রন মিলে তৈরি হয় নিউক্লিয়াস, এরপরে যথাক্রমে হাইড্রোজেন, হিলিয়াম, লিথিয়ামের জন্ম। তবে মহাবিশ্বের উদ্ভবের প্রায় কয়েক লাখ বছর পর্যন্ত আমরা যাকে জড়পদার্থ বা ম্যাটার বলি সে রকম কিছুই তৈরি হয় নি।
প্রায় চার লাখ বছর পরে তাপমাত্রা খানিকটা কমে তিন হাজার ডিগ্রি কেলভিনে নেমে আসার পরই কেবল প্লাজমা থেকে স্থায়ী অণু গঠিত হওয়ার মতো পরিবেশ তৈরি হতে পেরেছে। এসময় মহাবিশ্বের কুয়াশার চাদর ধীরে ধীরে সরে গিয়ে ক্রমশ স্বচ্ছ হয়ে আসে, পথ তৈরি হয় ফোটন কণা চলাচলের। আর তার পরই কেবল তেজস্ক্রিয় রশ্মিসমূহের ওপর জড়-পদার্থের আধিপত্য শুরু হয়েছে। এরপর আরও প্রায় একশ কোটি বছর লেগেছে গ্যালাক্সি জাতীয় কিছু তৈরি হতে। আর আমাদের যে গ্যালাক্সি, যাকে আমরা আকাশগঙ্গা নামে ডাকি, সেখানে সূর্যের সৃষ্টি হয়েছে আজ থেকে প্রায় পাঁচশ কোটি বছর আগে। আর সূর্যের চারপাশে ঘূর্ণায়মান গ্যাসের চাকতি থেকে প্রায় ৪৫০-৪৬০ কোটি বছরের মধ্যে তৈরি হয়েছিল পৃথিবীসহ অন্যান্য গ্রহ-উপগ্রহগুলো।-সিএনএন