নিজস্ব প্রতিবেদক : শীতে মৌসুমেই রাক্ষুসী রূপ ধারণ করেছে কুশিয়ারা নদী। নদীতে পানি কমার সাথে সাথে ভাঙ্গন শুরু হয়েছে তীরবর্তী বিভিন্ন এলাকায়। বাড়িঘর যেমন তলিয়ে যাচ্ছে কুশিয়ারার তান্ডবে তেমনি বিলীন হচ্ছে নদী তীরবর্তী বিভিন্ন সড়ক। আর এতে করে সাধারণ মানুষের ভোগান্তি বাড়ছে। শুধু কুশিয়ারা নদী নয়, বালাগঞ্জে বড়ভাগা নদীতেও ভাঙ্গন শুরু হয়েছে। জগন্নাথপুরে কুশিয়ারার ভাঙ্গনে সড়ক বিলীন হওয়ায় আশারকান্দি ও পাইলগাঁও ইউনিয়নের প্রায় ১০টি গ্রামের লোকজন ভোগান্তিতে পড়েছেন।
বালাগঞ্জে কুশিয়ার নদীর অব্যাহত ভাঙনে নদী পারের আতংকিত বাসিন্দারা এখন নির্ঘুম রাত কাটাচ্ছেন। দেড় মাসের ব্যবধানে কয়েক দফা ভাঙনে দুই শতাধিক পরিবারের বসত বাড়িসহ বিভিন্ন স্থাপনা ও ফসলী জমি সর্বগ্রাসী কুশিয়ারার পেটে চলে গেছে। ক্ষতিগ্রস্থদের মধ্যে অনেকেরই মাথা গোঁজারও ঠাঁই মিলছেনা। ফলে আশ্রয়হীন এসব পরিবারের মধ্যে মানবিক বিপর্যয় দেখা দিয়েছে।
ক্ষতিগ্রস্থ নি:স্ব অসহায় এসব পরিবারগুলোকে জরুরী ভিত্তিতে সরকারি ও বেসরকারি সহায়তা প্রদানের জন্য জোর দাবি জানানো হয়েছে। তবে নদী ভাঙন অব্যাহত থাকলেও পানি উন্নয়ন বোর্ডের কোনো কর্মকর্তা ভাঙন কবলিত এলাকায় যেতে দেখা যায়নি।
সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, গত এক সপ্তাহ আগ থেকে এ পর্যন্ত বালাগঞ্জ উপজেলার পূর্ব পৈলনপুর ইউনিয়নের হামছাপুর গ্রামের শাহ আলমের বাড়ি থেকে হামছাপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় পর্যন্ত অর্ধশতাধিক পরিবারের ভিটেমাটি ও ফসলী জমি রাক্ষুসী কুশিয়ারার পেটে চলে যায়। দীর্ঘ কয়েক যুগ ধরে এই হামছাপুর গ্রামের বাসিন্দারা প্রতি বছরই নদী ভাঙনের শিকার হয়ে আসছেন।
হামছাপুর গ্রামের ক্ষতিগ্রস্থ লোকজনের মধ্যে দেড়টন চাল ও শীতের কম্বল বিতরণ করার কথা নিশ্চিত করেছেন উপজেলা নির্বাহী কর্তকর্তা প্রদীপ সিংহ। এর আগে গত বছরের ১২ ডিসেম্বর উপজেলার পূর্ব গৌরীপুর ইউনিয়নের আটটি গ্রামের প্রায় অর্ধ শতাধিক পরিবারের বসত ভিটা ভাঙন আক্রান্ত হয়। ক্ষতিগ্রস্থ গ্রামগুলো হলো-সাদেকপুর, কায়েস্থঘাট দক্ষিণ
গ্রাম, বিনোদপুর, কায়েস্থঘাট মাঝপাড়া, হাড়িয়ারগাঁও-কায়েস্থঘাট চক ও নতুন সুনামপুর।
ক্ষতিগ্রস্থদের মধ্যে হাড়িয়ারগাঁও গ্রামের ১০টি পরিবারসহ অন্যান্য গ্রামগুলোর ২০টি পরিবার গৃহহীন বাকি পরিবারগুলোর বসতভিটার বৃহদাংশ রাক্ষুসী কুশিয়ারার তলদেশে চলে যায়। হাড়িয়ারগাঁও গ্রামের গৃহহীনদের মধ্যে, বিলাল মিয়া, ছমির আলী, নিয়াজ আলী, জিতু মিয়া, রশিয়া বেগম, আব্দুস সুবহান, জফির মিয়া, খবির মিয়া, হেলাল মিয়া ও সিরাজ মিয়ার পরিবার রয়েছে। ক্ষতিগ্রস্থ পরিবারের লোকজনসহ স্থানীয়দের সাথে কথা বলে জানা
গেছে, কুশিয়ারা নদীর পানি কমার সাথে-সাথেই আক্রান্ত এলাকায় ফাটল দেখা দিয়ে ভাঙন শুরু হয়।
এদিকে, কুশিয়ারার পর এবার বড়ভাগার নদীর তীরবর্তী বাসিন্দারা ভাঙনের শিকার হয়েছেন। এক সময়ের খরস্রোত বড়ভাগা এখন মৃতপ্রায়। কিন্তু একদিকে নদীর তলদেশ ভরাট হচ্ছে আর অন্য দিকে তীরবর্তী এলাকায় নতুন করে ভাঙন দেখা দিয়েছে। কুশিয়ারার মত বগভাগা নদী পারের বাসিন্দারা ভাঙন আতঙ্কে রয়েছেন।
গত মঙ্গলবার সন্ধ্যার দিকে আকষ্মিক ভাবে ভূমিকম্পের ন্যায় ঝাঁকুনী দিয়ে বালাগঞ্জ ইউনিয়নের কাশিপুর গ্রামে বড়ভাগা নদীর তীববর্তী ২০ থেকে ২৫টি পরিবারের বসত ভিটা ধসে পড়ে। কাশিপুর গ্রামের বাসিন্দা ক্ষতিগ্রস্থ তজমুল আলীর বর্ণনায়, হঠাৎ করে ভূমিকম্পের মতো ঝাঁকুনী দেখে তিনি আতকে ওঠেন। নিজের ঘর থেকে তড়িৎ গতিতে বেরিয়ে পরিবারের লোকজনকে নিয়ে নিরাপদ দূরত্বে চলে যান।
একই গ্রামের বাসিন্দা তুরন মিয়ার আক্ষেপ- চোখের সামনেই ভিটেমাটি নদীগর্ভে চলে গেলেও কিছুই করার থাকলো না তাঁর।
বড়ভাগা নদীর ভাঙনে কাশিপুর গ্রামের ক্ষতিগ্রস্থর মধ্যে-ইসকন্দর মিয়া, আহাদ মিয়া, নুর মিয়া, মখলিছ মিয়া, তখলিছ মিয়া, আখলিছ মিয়া, এলাইছ মিয়া, সিরাজ মিয়া, জাহেদ মিয়া, রুবেল মিয়া, তজমুল আলী, শাওন মিয়া, লোকমান মিয়া, জব্বার মিয়া, জলিল মিয়া, চঞ্চল মিয়া, মালিক মিয়া ও লায়েক মিয়ার পরিবারসহ গ্রামের আরো কয়েকটি পরিবার রয়েছে। স্বল্প পরিমাণের ভূমির ভিটামাটি হারিয়ে ক্ষতিগ্রস্থ পরিবারগুলো দিশেহারা হয়ে
পড়েছেন।
বালাগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা প্রদীপ সিংহ বলেন, ভাঙন আক্রান্ত গ্রামগুলো পরিদর্শন করে ক্ষতিগ্রস্থ পরিবারের লোকজনের সাথে কথা বলেছি। ক্ষতিগ্রস্থ পরিবারগুলোর একটি তালিকা প্রস্তুত করা হয়েছে। তাদেরকে দ্রুত পূর্নবাসনের জন্য উর্ধ্বতন কতৃপক্ষকে অবহিত করা হয়েছে।
এদিকে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি)র জগন্নাথপুর-শিবগঞ্জ-ফেচী-বেগমপুর সড়কের পাইলগাঁও ইউনিয়নের জালালপুর ভাঙ্গাবাড়ি এলাকায় প্রায় ১ হাজার ফুট সড়ক কুশিয়ারা নদী গর্ভে বিলীন হয়ে যাওয়ায় যাতায়াত সমস্যায় দূর্ভোগে পড়েছেন উপজেলার দক্ষিণাঞ্চলের আশারকান্দি ও পাইলগাঁও ইউনিয়নের প্রায় ১০টি গ্রামের বাসিন্দারা।
গত বছরের বর্ষা মৌসুমের শুরুতেই অতি বৃষ্টি ও পাহাড়ী ঢলে কুশিয়ারা নদীর পানি বিপদ সীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হওয়ায় প্রবল স্রোত আর ঢেউয়ের কারণে বেগমপুর সড়কটির প্রায় ১ হাজার ফুট সড়ক নদী গর্ভে বিলীন হয়ে যায়। শুস্ক মৌসুমে কুশিয়ারা নদীতে পানির স্রোত কম থাকলেও ভাঙ্গন অব্যাহত রয়েছে।
সরেজমিন জগন্নাথপুর-শিবগঞ্জ-ফেচী-বেগমপুর সড়কটির ভাঙ্গন কবলিত এলাকা দেখতে গিয়ে কুশিয়ারা নদীর তীরবর্তী অধিকাংশ বাসিন্দারা তাদের নদী গর্ভে বিলীন হয়ে যাওয়া বাড়ি-ঘর, আবাদি জমির বর্ণনা দিতে গিয়ে অনেককেই অঝোর ধারায় দু’চোখ বেয়ে অশ্রু ঝরতে থাকে।
আশারকান্দি ইউনিয়নের উত্তর কালনীরচর গ্রামের বাসিন্দা মো. দুলাল মিয়া বলেন, কুশিয়ারা নদীর ভাঙ্গনের চিত্র ভয়াবহ। এটা বর্ণনা করার ভাষা নেই, ইতোমধ্যে বিলীন হয়ে গেছে বাপ-দাদার রেখে যাওয়া ভিটে মাটি।
এছাড়াও ফেচীর বাজারসহ পাইলগাঁও ও আশারকান্দি ইউনিয়নের অসংখ্য হাট-বাজার, বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্টান, মসজিদ, ঘর-বাড়িসহ সড়ক পথ। গত বর্ষায় কয়েক দফা পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় নদী গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে উপজেলার দক্ষিাঞ্চলের জনসাধারণের যাতায়াতের একমাত্র সড়ক পথটি। নদী ভাঙ্গনের কবল থেকে বাড়ি-ঘরসহ সড়ক পথ রক্ষায় প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য সরকারের প্রতি জোর দাবী জানিয়েছেন।
স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডির) জগন্নাথপুর উপজেলা প্রকৌশলী অফিস সূত্রে জানা যায়, জগন্নাথপুর পৌরসভার সীমান্ত থেকে শিবগঞ্জ-পাইলগাঁও হয়ে বেগমপুর পর্যন্ত ১৫.৩৯০ কিলোমিটার সড়কের মধ্যে ২.২০ কিলোমিটার সড়ক কুশিয়ারা নদী গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে এবং গত বন্যায় ১.৭০ কিলোমিটার ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। এছাড়া নদী গর্ভে বিলীন হওয়ায় সড়কের অংশটুকু নতুনভাবে স্থান পরিবর্তন করে নির্মাণে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে।