• সোমবার, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ১১:৪৯ অপরাহ্ন

আইসিটি আইন প্রণয়নে প্রয়োজন দূরদর্শিতা

আপডেটঃ : বৃহস্পতিবার, ১৯ জুলাই, ২০১৮

দেশের অন্যান্য খাতের মতো আইসিটি খাত উন্নয়নের একটি উল্লেখযোগ্য সূচক। প্রতিনিয়ত নতুন নতুন প্রযুক্তি আসছে। দেশ উন্নতির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত সাইবার অপরাধের ৯০ শতাংশ ব্যবহারকারীর অজ্ঞতার কারণে সংঘটিত হয়। ২০০৬ সালে যখন আইনটি পাস হয় তখনই বলা হচ্ছিল, আইনটি সময়োপযোগী নয়। ইতোমধ্যে প্রায় এক যুগ পেরিয়ে গেছে এবং আইনটিতে বিভিন্ন পরিবর্তন এসেছে, কিন্তু এই আইনটিতে এখন পর্যন্ত বেশ কিছু অসংগতি রয়ে গেছে বলে মনে করেন অনেকে।
তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) আইনের বিতর্কিত বিভিন্ন ধারা বাতিল করে নতুন একটি আইন ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, ২০১৮-এর খসড়া হয়েছে। এছাড়া আইনের অধীনে জাতীয় তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি নীতিমালা ২০১৮ ও জাতীয় ডিজিটাল কমার্স নীতিমালা ২০১৮ এর খসড়া তৈরি করা হয়েছে।
কিন্তু ঘুরে-ফিরে সেই বিতর্কিত ধারার বিষয়বস্তুগুলো ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে রাখা হয়েছে। গত জানুয়ারি মাসে প্রস্তাবিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের খসড়া মন্ত্রিসভায় অনুমোদিত হওয়ার পর এটি ঘিরে বিতর্ক ও সমালোচনা হয়। এই পরিপ্রেক্ষিতে সরকার আপত্তি ওঠা কিছু ধারা বাদ দেওয়ার আশ্বাস দিয়েছিল। কিন্তু পরবর্তীকালে জাতীয় সংসদে আইনটি উত্থাপনের পর দেখা যায়, তেমন কোনো পরিবর্তন আনা হয়নি। উপরন্তু, ডিজিটাল গুপ্তচরবৃত্তি-বিষয়ক ৩২ ধারার মতো আরও কঠিন একটি ধারা জুড়ে দেওয়া হয়েছে। সংসদে বিরোধী দল বিলটিতে আপত্তি জানানোর ফলে আবার এটি সংসদীয় কমিটিতে পাঠানো হয়।
আইনের কিছু অসঙ্গতি নিম্নে তুলে ধরছি:
১) অর্থনৈতিক জালিয়াতি এবং আর্থিক অপরাধ:
তথ্য ও প্রযুক্তি ব্যবহার করে জালিয়াতির মাধ্যমে বিভিন্ন ব্যাংকে অ্যাকাউন্ট খোলা, একাধিক ছদ্মনাম ও ঠিকানা এবং ভুয়া জন্মতারিখ ব্যবহার করা, একটি ব্যাংকে একাধিক অ্যাকাউন্ট খোলা ও পরে সেই ব্যাংক থেকে অনলাইনে লেনদেনের মাধ্যমে টাকা সরিয়ে তা আরেক ব্যাংকে জমা করা এবং সেই টাকা কৌশলে তুলে নিয়ে যাওয়া ইত্যাদি বিষয়গুলো সরাসরি এই আইনে আসেনি, বরং ৫৬ ধারায় কম্পিউটার সিস্টেমের হ্যাকিং সংক্রান্ত ধারায় পরোক্ষভাবে এসেছে।
নতুন আইনের ১৫ ধারায় বলা হয়েছে, বাংলাদেশের অখণ্ডতা, সংহতি, জননিরাপত্তা বা সার্বভৌমত্ব বিপন্ন করার জন্য জনসাধারণ বা জনসাধারণের কোনো অংশের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টির মাধ্যমে সরকার বা কোনো কোম্পানি বা কোনো ব্যক্তিকে কাজ করতে বা কাজ থেকে বিরত রাখতে বাধ্য করার উদ্দেশে কোনো কম্পিউটার, কম্পিউটার প্রোগ্রাম, কম্পিউটার সিস্টেম বা কম্পিউটার নেটওয়ার্ক বা ডিভাইস, ডিজিটাল সিস্টেম বা ডিজিটাল নেটওয়ার্কে প্রবেশাধিকার ব্যাহত করে, তাহলে তিনি ডিজিটাল সন্ত্রাসী কাজের জন্য অপরাধী হবেন। আর এই অপরাধে তিনি অনধিক ১৪ বছর কারাদণ্ড অথবা অনধিক এক কোটি টাকা অর্থদণ্ড অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হতে পারেন।
২)  শাস্তির মেয়াদ:
অন্য একজনের অনুমতি ব্যতীত একটি ছবি ব্যবহার করার শাস্তি ও একটি ব্যাংক একাউন্ট হ্যাক করে শত কোটি টাকা আত্মসাত্ করার শাস্তির মাত্রা একই রাখা হয়েছে। সংবিধানের ৩৯ ধারায় মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও নিশ্চয়তা দেওয়া হয়েছে এবং বলা হয়েছে— এমন আইন করা যাবে না, যাতে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা খর্ব হয়। কিন্তু এ আইনের একটি ভয়ঙ্কর দিক হলো, কেউ যদি দোষী সাব্যস্ত হয়, তাহলে সর্বনিম্ন শাস্তি ৭ বছর। আগে মামলা করতে হলে কর্তৃপক্ষের অনুমোদন প্রয়োজন হতো এবং সাজার মেয়াদ ছিল ১০ বছর। এখন কর্তৃপক্ষের অনুমোদন লাগবে না। সর্বনিম্ন সাজার মেয়াদ ৭ বছর এবং সর্বোচ্চ ১৪ বছর। ধারা ৫৪, ৫৬, ৫৭, ৬১-এর যেকোনো একটি ধারায় অপরাধ হলে সর্বনিম্ন সাজা সাত বছর এবং সর্বোচ্চ ১৪ বছর।
৩) আইনের অপব্যবহার করার সুযোগ:
এই আইনের অধীনে কোনো অপরাধ সংঘটিত হলে তা যদি অন্য কোনো আইনের অধীনেও অপরাধ হিসেবে গণ্য হয় তখন কোন আইনে সাজা হবে, এটা ঠিক করবে পুলিশ। যার  ফলে পুলিশ তার ইচ্ছেমতো আইনের অপব্যবহার করার সুযোগ পাবে।
৪) আইনটি কতটুকু নারীবান্ধব:
বাংলাদেশে সমগ্র ইন্টারনেট ব্যবহারকারী নারীদের মধ্যে প্রায় ৭৩ ভাগ নারী হয়রানির শিকার হচ্ছেন এবং এক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি ভোগান্তিতে পড়েন ভুক্তভোগী নারী বিচারপ্রার্থীরা। সাইবার ক্রাইম ট্রাইব্যুনালের বেশির ভাগ মামলাই নারী-সংক্রান্ত।
ছবি ফটোশপ করে পর্নো তৈরি করা বা  অশ্লীল ভিডিও এবং ছবি প্রচারের মাধ্যমে মানহানি করার মতো ঘটনার জন্য ৫৭ ধারায় প্রতিকারের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু প্রতিনিয়ত ইনবক্সে হয়রানি আর ভীতিকর মেসেজের মাধ্যমে একজন নারীকে হয়রানি করা হলে এই আইনে প্রত্যক্ষভাবে কোনো প্রতিকারের বিধান নেই। এর প্রতিকার পেতে তাকে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০ ও বাংলাদেশ দণ্ডবিধি ইত্যাদি আইনের আশ্রয় নিতে হচ্ছে।
কেউ যদি ফেসবুকে অশ্লীল গালি দেয়, একজন নারী কি তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারবেন? কেউ যদি তার তথ্য-উপাত্ত নিয়ে ফেসবুক আইডি খোলে এবং তার মানহানি করে, তখন তিনি কোন আইনের অধীনে মামলা করবেন? যদি ব্যক্তিগতভাবে আক্রমণ করে, তখন কী করণীয়? এই বিষয়গুলো আরো সুস্পষ্টভাবে আইনে আসতে হবে। এসব ক্ষেত্রে  থানা থেকে তাকে পর্নোগ্রাফি নিয়ন্ত্রণ আইন, ২০১২ অথবা অন্যান্য আইনের অধীনে মামলা করতে বলা হয় এবং পরবর্তীকালে মামলাটি দুর্বল হয়ে পড়ে।
৫) স্বাধীনভাবে মতপ্রকাশে বাধা দান:
আইসিটি আইনের ৫৭ ধারায় বলা আছে, কোনো ব্যক্তি যদি ইচ্ছাকৃতভাবে ওয়েবসাইটে বা অন্য কোনো ইলেকট্রোনিক মাধ্যমে এমন কিছু প্রকাশ বা সম্প্রচার করেন, যা মিথ্যা অশ্লীল বা যা দেখলে বা পড়লে নীতিভ্রষ্ট বা অসত্ হতে উদ্বুদ্ধ হতে পারেন এবং যার কারণে একজনের মানহানি ঘটে অথবা আইন-শৃঙ্খলার অবনতি ঘটে বা ঘটার সম্ভাবনা সৃষ্টি হয় এবং রাষ্ট্র ও ব্যক্তির ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়; অথবা ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করতে পারে এবং যদি এ ধরনের তথ্য দিয়ে ব্যক্তি এবং সংগঠনের বিরুদ্ধে উসকানি দেওয়া হয়, তাহলে এই কাজ হবে একটি অপরাধ। কোনো ব্যক্তি এ ধরনের অপরাধ করলে তিনি সর্বোচ্চ ১৪ বছর; সর্বনিম্ন ৭ বছর কারাদণ্ডে দণ্ডিত হবেন এবং সর্বোচ্চ এক কোটি টাকা অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হবেন।
২০১৩ সালে সংশোধনীর মাধ্যমে এই অপরাধগুলো আমলযোগ্য ও অজামিনযোগ্য করা হয়েছে। শাস্তির পরিমাণও বাড়ানো হয়েছে। কিন্তু সেই সঙ্গে এটির ব্যবহার বেড়ে গিয়েছে। এই আইনে মিথ্যা, অশ্লীল, নীতিভ্রষ্টতা, অসত্, মানহানি, আইনশৃঙ্খলার অবনতি, রাষ্ট্র ও ব্যক্তির ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন, ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত ও সংগঠনের বিরুদ্ধে উসকানি এই বিষয়গুলো অপরাধ বলে চিহ্নিত করা হলেও এগুলোর কোনো ব্যাখ্যা দেওয়া হয় নাই।
তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনের বিতর্কিত ৫৭ ধারার সঙ্গে নতুন আইনের ১৯ ধারার পার্থক্য হলো ৫৭ ধারার তুলনায় ১৯ ধারার শাস্তির পরিমাণ কম। ৫৭ ধারায় অপরাধ করলে ১৪ সর্বোচ্চ বা সর্বনিম্ন ৭ বছর এবং এক কোটি টাকা সর্বোচ্চ জরিমানা এবং অজামিনযোগ্য অপরাধ। কিন্তু ১৯ ধারায় অপরাধ করলে তা জামিনযোগ্য।
৬) একটি মাত্র সাইবার ট্রাইব্যুনাল:
তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনের অধীনে সংঘটিত অপরাধের দ্রুত ও কার্যকর বিচার নিশ্চিত করার জন্য বিভাগীয় শহরগুলোতে সাইবার ট্রাইব্যুনাল গঠন করার কথা। কিন্তু ২০১৩ সালের অক্টোবর মাসে ঢাকায় চালু হয় একমাত্র বাংলাদেশ সাইবার ট্রাইব্যুনাল এবং এখন পর্যন্ত আর কোনো ট্রাইব্যুনাল গঠিত হয়নি।
দেশের এই একটি মাত্র সাইবার ক্রাইম ট্রাইব্যুনালের কোনো নিজস্ব এজলাস নেই। যার ফলে ট্রাইব্যুনালের বিচার কাজ চলে পাশের বিশেষ জজ আদালত-১ ও ৪-এ। যেদিন বিশেষ জজ আদালত-১ ও ৪ ব্যস্ত থাকে, সেদিন সাইবার ট্রাইব্যুনালের বিচার কাজ স্থগিত রাখতে হয়। সারাদেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা বিচারপ্রার্থী ও আসামিপক্ষ চরম ভোগান্তির শিকার হন।
অনেক মামলাই ঢাকার বাইরের। ঢাকার বাইরে বিভাগীয় শহর থেকে ভুক্তভোগী ও তাদের স্বজনদের বিচারের আশায় দিনের পর দিন ঢাকায় আসতে হয়। যেদিন বিচার কাজ স্থগিত থাকে, সাক্ষ্য না দিয়েই চলে যান সাক্ষীরা। শুনানির  সময় বাদী, ভুক্তভোগী, সাক্ষীসহ আসামির স্বজনরা বসারও সুযোগ পান না। ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে হয় তাদের।
তথ্য ও প্রযুক্তি আমাদের জন্য একটি  আশীর্বাদ। কাজেই এই প্রযুক্তির ব্যবহার যাতে মানুষের কল্যাণে হয় সে ব্যাপারটি নিশ্চিত করার জন্য আইসিটির ক্ষেত্রে সময়োপযোগী আইন থাকা অত্যন্ত জরুরি। কিন্তু সেই আইনটিকে একই সঙ্গে আধুনিক ও সঠিক হতে হবে। আইনের বৈষম্য ও বিদ্যমান অসঙ্গতিগুলো দূর করতে হবে এবং সেই সঙ্গে সঠিক বিধিমালা প্রণয়নের মাধ্যমে আইনের প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। তথ্য ও প্রযুক্তির ইতিবাচক ও নেতিবাচক দুরকমের প্রভাব রয়েছে। ভবিষ্যতে আরও নতুন নতুন প্রযুক্তি আসবে। প্রযুক্তি মানুষকে সামাজিক, অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি এনে দেয় এবং সেই সঙ্গে এর অপপ্রয়োগ জনজীবনে চরম দুর্ভোগ বয়ে আনতে পারে।
তাই আশা করা যায়, আইনটি পাসের আগে সরকার দূরদর্শিতার পরিচয় দেবে এবং বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নেওয়ার মাধ্যমে সময়োপযোগী একটি আইন প্রণয়ন করবে।
লেখক : ব্যারিস্টার এট ল, লিংকন্স ইন। মানবাধিকার কর্মী এবং অ্যাডভোকেট, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এই ক্যাটাগরির আরো নিউজ