• বৃহস্পতিবার, ২৮ নভেম্বর ২০২৪, ০৪:২৪ পূর্বাহ্ন

ওয়াসার নিয়োগে দুর্নীতির প্রমাণ, মামলায় ফাঁসতে পারেন এমডি তাকসিম

নিউজ ডেস্ক
আপডেটঃ : বুধবার, ২৪ মে, ২০২৩

ঢাকা ওয়াসার অর্গানোগ্রামে পরিচালক (উন্নয়ন) ও পরিচালক (কারিগর) হিসেবে কোনো পদ ছিল না। অথচ সেই পদ সৃষ্টি করে চুক্তিভিত্তিক নিজের পছন্দের ব্যক্তিদের নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। নিয়োগপ্রাপ্তরা হলেন- পরিচালক (উন্নয়ন) মো. আবুল কাসেম ও পরিচালক (কারিগর) একেএম সহিদ উদ্দিন।

২০১৮ সালের ৪ এপ্রিল থেকে ২০২২ সালের আগস্ট পর্যন্ত বেতন-ভাতা বাবদ তাদের ১ কোটি ৯৮ লাখ ৬৫ হাজার টাকা দেওয়া হয়েছে।

ঢাকা ওয়াসার আলোচিত ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) প্রকৌশলী তাকসিম এ খানসহ বোর্ডের ১০ সদস্য ক্ষমতার অপব্যবহার করে ওই নিয়োগ দিয়েছেন বলে দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে।

অবৈধ নিয়োগ দিয়ে তারা দুর্নীতি প্রতিরোধ আইন ১৯৪৭ এর ৫(২) ধারা ও দণ্ডবিধির ১০৯ ধারায় শাস্তিযোগ্য অপরাধ করেছেন উল্লেখ করে ঢাকা ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) প্রকৌশলী তাকসিম এ খান ও পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যানসহ ১০ জনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করার সুপারিশ করে কমিশনে অনুসন্ধান প্রতিবেদন দাখিল করা হয়েছে। দুদকের ঊর্ধ্বতন একটি সূত্র প্রতিবেদন দাখিলের বিষয়টি নিশ্চিত করেছে।

শুধু প্রতিবেদন দাখিল নয়, সংস্থাটির উপপরিচালক ও অনুসন্ধান কর্মকর্তারা সৈয়দ নজরুল ইসলামের দাখিল করা সুপারিশের সঙ্গে একমত পোষণ করেছে দুদকের আইন অনুবিভাগ। যদিও এ বিষয়ে দুদকের লিগ্যাল শাখার কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি।

 

অন্যদিকে ওয়াসার দুর্নীতির বিষয়ে জানতে চাইলে দুদক কমিশনার (অনুসন্ধান) মো. মোজাম্মেল হক খান ঢাকা পোস্টকে বলেন, কমিশনে এ বিষয়ে প্রতিবেদন জমা হয়েছে। কমিশন ওই প্রতিবেদন পর্যালোচনা করবে। তবে ওয়াসার নিয়োগ দুর্নীতির বিষয়ে প্রাথমিক সত্যতা মিলেছে। কমিশন পুরো প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবে।

অনুসন্ধান প্রতিবেদন সূত্রে জানা যায়, ঢাকা ওয়াসার পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান ও সদস্যরা পরস্পর যোগসাজস করে ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে অর্গানোগ্রাম বহির্ভূত ও ঢাকা ওয়াসায় বৈধ কোনো পদ সৃষ্টি না করে এবং নিয়োগ সংক্রান্ত নীতিমালা ও প্রচলিত বিধি-বিধান অনুসরণ না করে নিজেদের পছন্দের দুজন ব্যক্তিকে চুক্তি ভিত্তিক নিয়োগ প্রদান করেছে।

ওয়াসার ২৫২তম বোর্ডসভায় তাদের নিয়োগ দেওয়া হয়। উক্ত বোর্ডসভার চেয়ারম্যান ছিলেন অধ্যাপক প্রকৌশলী মো. হাবিবুর রহমান। বোর্ডের ৮ জন সদস্য হলেন- অতিরিক্ত সচিব (অবসর) সুধাংশু শেখর বিশ্বাস, এফসিএ ভাইস প্রেসিডেন্ট মু. মাহমুদ হোসেন, বাংলাদেশ ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউটের প্রতিনিধি প্রকৌশলী মো. নুরুজ্জামান, বাংলাদেশ ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউটের সভাপতি প্রকৌশলী একেএম হামিদ, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের সংরক্ষিত আসন-১২ এর তৎকালীন কাউন্সিলর আলোয়া সারোয়ার ডেইজি, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ২৬ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর মো. হাসিবুর রহমান মানিক এবং ঢাকা ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) প্রকৌশলী তাকসিম এ খান। তারাই মূলত এ অবৈধ নিয়োগের পক্ষে মতামত প্রদান করেছেন। তারা অবৈধ নিয়োগ দিয়ে দুর্নীতি প্রতিরোধ আইন ১৯৪৭ এর ৫(২) ধারায় শাস্তিযোগ্য অপরাধ করেছেন। এই কারণে মামলায় বোর্ডের চেয়ারম্যান, প্রকৌশলী তাকসিম খানসহ ৭ জন সদস্য ও চাকরি গ্রহণকারী দুজনসহ মোট ১০ জনকে আসামি করার সুপারিশ করা হয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে পরস্পর যোগসাজশে অবৈধভাবে নিয়োগ দিয়ে সুবিধাভোগী হিসেবে ১ কোটি ৯৮ লাখ ৬৫ হাজার টাকা আত্মসাতের অভিযোগ আনা হয়েছে।

অনুসন্ধান প্রতিবেদন সূত্রে আরও জানা যায়, ২০০৯ সালে ঢাকা ওয়াসার এমডি হিসেবে নিয়োগ পান প্রকৌশলী তাকসিম এ খান। এরপর ধাপে ধাপে সময় বাড়িয়ে এখনও বহাল আছেন তিনি। বিতর্কিত তাকসিম এ খানের পুনঃনিয়োগের ক্ষেত্রেও বিধি অমান্য করার অভিযোগ ছিল। ওয়াসার এমডি প্রকৌশলী তাকসিম এ খানসহ অন্যদের বিরুদ্ধে সংস্থাটির পদ্মা জশলদিয়া প্রকল্পে প্রায় ১ হাজার ১০০ কোটি টাকা, গন্ধরবপুর পানি শোধনাগার প্রকল্পে ১ হাজার কোটি টাকা, দাশেরকান্দি পয়ঃশোধনাগার প্রকল্পে ১ হাজার কোটি টাকা, গুলশান বারিধারা লেক দূষণ প্রকল্পে ৫০ কোটি টাকার অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগের অনুসন্ধান চলমান রয়েছে। এছাড়া প্রকল্প ব্যয় বাড়ানো, ঠিকাদার নিয়োগে সিন্ডিকেট, ঘুষ লেনদেন, পছন্দের লোককে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ, অপছন্দের লোককে ওএসডি করাসহ নানা অভিযোগ রয়েছে ওয়াসার এমডির বিরুদ্ধে।

এর আগে বিভিন্ন অনিয়ম, দুর্নীতি ও নিয়োগ বাণিজ্যের অভিযোগ খতিয়ে দেখতে সহিদ উদ্দিনকে ২০২২ সালের ১৯ অক্টোবর জিজ্ঞাসাবাদ করা হয় দুদকে। ওই সময় সহিদ উদ্দিন বলেছিলেন, নিয়োগ ও পদোন্নতি ওয়াসা কর্তৃপক্ষ দিয়েছে। আমি নিজে কিছুতে নেই। কে অভিযোগ দিয়েছে আমার জানা নেই।

একেএম সহিদ উদ্দিন

ওয়াসা ও দুদকের বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, ঢাকা ওয়াসার উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক এ কে এম সহিদ উদ্দিন মূলত ২০১৬ সালে প্রধান প্রকৌশলী হিসাবে অবসরে যান। অবসরে যাওয়ার পরপরই ওয়াসার কনসালটেন্ট হিসাবে কাজ শুরু করেন। মাসে দেড় লাখ টাকা বেতনে এক বছর ৪ মাস কনলাটেন্ট হিসাবে কাজ করেন সহিদ উদ্দিন। এরপর ২০১৮ সালের এপ্রিলে তাকে দুই বছরের চুক্তিতে পরিচালক (কারিগরী) হিসাবে নিয়োগ দেন এমডি তাকসিম এ খান। অথচ ঢাকা ওয়াসার অর্গানোগ্রামে এমন কোনো পদ নেই। মন্ত্রণালয় কিংবা যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া অবৈধভাবে নিয়োগ দেওয়া হয় তাকে। এরপর ধাপে ধাপে পদোন্নতি দিয়ে ডিএমডি বানানো হয় সহিদ উদ্দিনকে।

একই ধরনের অভিযোগ ছিল পরিচালক (উন্নয়ন) মো. আবুল কাশেমের বিরুদ্ধেও। অর্গানোগ্রামের বাইরে অবৈধভাবে পদ সৃষ্টি করার অভিযোগ যাচাই-বাছাই শেষে এমন নিয়োগকে অবৈধ ঘোষণা করেছিল স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়। নিয়োগ পাওয়ার চার মাস পর মন্ত্রণালয় থেকে এমন নির্দেশনা দেওয়ার পাশাপাশি বেতনভাতা বন্ধ করে দাপ্তরিক সকল কার্যক্রম থেকে বিরত রাখারও আদেশ দেওয়া হয়েছিল। ওই আদেশে ১৯৯৬ সালের পানি সরবরাহ ও পয়ঃনিষ্কাশন কর্তৃপক্ষ আইন এবং পানি সরবরাহ ও পয়ঃনিষ্কাশন কর্তৃপক্ষ (কর্মকর্তা/কর্মচারি) চাকরির প্রবিধানমালা-২০১০ এর সংশ্লিষ্ট ধারা পরিপন্থি ও বিধিসম্মত না হওয়ার কথা উল্লেখ করা হয়েছিল।

অন্যদিকে বোর্ড সদস্য ও ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের (ডিএনসিসি) সাবেক কাউন্সিলর আলেয়া সারোয়ার ডেইজিকে ২০২২ সালের ৬ ডিসেম্বর জিজ্ঞাসাবাদ করে দুদক। জিজ্ঞাসাবাদ শেষে তিনি বলেছিলেন, আমি যে অবস্থানে ছিলাম সেখান থেকে নিয়োগের ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট কোনো বিষয় ছিল না। আমি রাজনৈতিক ব্যাকগ্রাউন্ড সূত্রে ওয়াসার পরিচালনা পর্ষদের সদস্য ছিলাম। দায়িত্ব পালনকালে বরং আমি ওয়াসার পানির দাম বৃদ্ধির প্রতিবাদ করেছি। ওয়াসায় নিয়োগে দুর্নীতি হয়েছিল কি না আমার জানা নেই।


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এই ক্যাটাগরির আরো নিউজ