• সোমবার, ২০ মে ২০২৪, ০৩:৫৮ অপরাহ্ন

নজরুলের কয়েকটি ইসলামি গানের গীতি উৎস

নিউজ ডেস্ক
আপডেটঃ : সোমবার, ১১ সেপ্টেম্বর, ২০২৩
          শাহীনুর রেজা

আমাদের পাওয়া ২৪৬টি ইসলামি গানের মধ্যে ৫টি গানের গীতি উৎস খুঁজে পাওয়া গেল। তাই পাঠকদের উদ্দেশ্যে নিবেদন করা হলো-
১. ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ।   তুই আপনাকে আজ বিলিয়ে দে শোন্ আসমানি তাগিদ ॥ 
২. ইসলামের ঐ সওদা লয়ে এলো নবীন সওদাগর।   বদ্নসীব আয়, আয় গুনাহ্গার নূতন করে সওদা কর ॥
আব্বাসউদ্দীন আহমদ-এর ‘দিনলিপি ও আমার শিল্পী জীবনের কথা’ গ্রন্থের ‘ইসলামি গান, আমি ও কাজীদা’ শীর্ষক অধ্যায়ে আছেকাজীদার লেখা গান ইতিমধ্যে অনেকগুলো রেকর্ড করে ফেললাম। তাঁর লেখা ‘বেণুকার বনে কাঁদে বাতাস বিধূর’, ‘অনেক ছিল বলার যদি দুদিন আগে আসতে’, ‘গাঙে জোয়ার এলো ফিরে তুমি এলে কই’, ‘বন্ধু আজও মনে রে পড়ে আম কুড়ানো খেলা’ ইত্যাদি রেকর্ড করলাম।
একদিন কাজীদাকে বললাম, ‘কাজীদা, একটা কথা মনে হয়। এই যে পিয়ারু কাওয়াল, কাল্লু কাওয়ালএরা উর্দু কাওয়ালি গায়, এদের গানও শুনি অসম্ভব বিক্রি হয়, এই ধরনের বাংলায় ইসলামি গান দিলে হয় না! তারপর আপনি তো জানেন কীভাবে কাফের কুফর ইত্যাদি বলে বাংলার মুসলমান সমাজের কাছে আপনাকে অপাঙক্তেয় করে রাখার জন্য আদাজল খেয়ে লেগেছে একদল ধর্মান্ধ! আপনি যদি ইসলামি গান লেখেন, তাহলে মুসলমানের ঘরে-ঘরে আবার উঠবে আপনার জয়গান।’
কথাটা তাঁর মনে লাগল। তিনি বললেন, ‘আব্বাস, তুমি ভগবতী বাবুকে বলে তাঁর মত নাও, আমি ঠিক বলতে পারব না।’ আমি ভগবতী ভট্টাচার্য অর্থাৎ গ্রামোফোন কোম্পানির রিহার্সেল-ইনচার্জকে বললাম। তিনি তেলে-বেগুনে জ¦লে উঠলেন, ‘না না না, এসব গান চলবে না। ও হতে পারে না।’
মনের দুঃখ মনেই চেপে গেলাম। এর প্রায় ছয় মাস পরে। একদিন দুপুরে বৃষ্টি হচ্ছিল, আমি অফিস থেকে গ্রামোফোন কোম্পানির রিহার্সেল ঘরে গিয়েছি। দেখি, একটি ঘরে বৃদ্ধা আশ্চর্যময়ী আর বৃদ্ধ ভগবতীবাবু বেশ রসাল গল্প করছেন। আমি নমস্কার দিতেই বৃদ্ধ বললেন, ‘বসুন বসুন’। আমি বৃদ্ধের রসাপ্লুত মুখের দিকে চেয়ে ভাবলাম, এই উত্তম সুযোগ। বললাম, ‘যদি কিছু মনে না করেন তাহলে বলি। সেই যে বলেছিলাম ইসলামি গান দেওয়ার কথা, আচ্ছা, একটা এক্সপেরিমেন্টই করুন না, যদি বিক্রি না হয় আর নেবেন না, ক্ষতি কি?’ তিনি হেসে বললেন, ‘নেহাতই নাছোড়বান্দা আপনি, আচ্ছা আচ্ছা, করা যাবে।’
শুনলাম, পাশের ঘরে কাজীদা আছেন। আমি কাজীদাকে বললাম যে, ভগবতী বাবু রাজী হয়েছেন। তখন সেখানে ইন্দুবালা কাজীদার কাছে গান শিখছিলেন। কাজীদা বলে উঠলেন, ‘ইন্দু, তুমি বাড়ি যাও, আব্বাসের সঙ্গে কাজ আছে।’ ইন্দুবালা চলে গেলেন। এক ঠোঙা পান আর চা আনতে বললাম দশরথকে। তারপর দরজা বন্ধ করে আধঘণ্টার ভেতরই লিখে ফেললেন, ‘ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ।’ তখনই সুর সংযোগ করে শিখিয়ে দিলেন। পরের দিন ঠিক এই সময় আসতে বললেন। পরের দিন লিখলেন, ‘ইসলামের ঐ সওদা লয়ে এলো নবীন সওদাগর।’
গান দু’খানা লেখার ঠিক চারদিন পরই রেকর্ড করা হলো। কাজীদার আর ধৈর্য্য মানছিল না। তাঁর চোখে মুখে কী আনন্দই যে খেলে যাচ্ছিল! তখনকার দিনে যন্ত্র ব্যবহার হত শুধু হারমোনিয়াম আর তবলা। গান দু’খানা আমার তখন মুখস্থ হয়নি। তিনি নিজে যা লিখে দিয়েছিলেন, মাইকের পাশ দিয়ে হারমোনিয়ামের ওপর ঠিক আমার চোখ বরাবর হাত দিয়ে কাজীদা নিজেই সেই কাগজখানা ধরলেন, আমি গেয়ে চললাম। এই হলো আমার প্রথম ইসলামি রেকর্ড! দু’মাস পর ঈদুল ফিতর। শুনলাম, গান দু’খানা তখন বাজারে বের হবে। ঈদের বাজার করতে একদিন ধর্মতলার দিকে গিয়েছি। বি এন সেন অর্থাৎ সেনোলা রেকর্ড কোম্পানির বিভূতিদার সঙ্গে দেখা। তিনি বললেন, ‘আব্বাস! আমার দোকানে এসো।’ তিনি এক ফটোগ্রাফার ডেকে নিয়ে এসে বললেন, ‘এর ফটোটা নিন তো’। আমি তো অবাক! ‘ব্যাপার কী?’ তিনি বললেন, ‘তোমার একটা ফটো নিচ্ছি, ব্যস, আবার কি?
ঈদের বন্ধে বাড়ি গেলাম। বন্ধের সঙ্গে আরো কুড়ি-পঁচিশ দিন ছুটি নিয়েছিলাম। কলকাতা ফিরে এসে ট্রামে চড়ে অফিসে যাচ্ছি। ট্রামে একটি যুবক আমার পাশে গুনগুন করে গাইছে, ‘ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে।’ আমি একটু অবাক হলাম। এ গান কী করে শুনলো! অফিস ছুটির পর গড়ের মাঠে বেড়াতে গিয়েছি, মাঠে বসে একদল ছেলের মাঝে একটি ছেলে গেয়ে উঠলো, ‘ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে।’ তখন মনে হলো, এ গান তো ঈদের সময় বাজারে বের হওয়ার কথা। বিভূতিদার দোকানে গেলাম। আমাকে দেখে তিনি একদম জড়িয়ে ধরলেন। সন্দেশ, রসগোল্লা, চা এনে বললেন, ‘খাও।’ আমার গান দুটো এবং আর্ট পেপারে ছাপানো আমার বিরাট ছবির একটা বাণ্ডিল সামনে রেখে বললেন, ‘বন্ধু বান্ধবদের কাছে বিলি করে দিয়ো। আমি সত্তর-আশি বাজার ছাপিয়েছি, ঈদের দিন এসব বিতরণ করেছি। আর এই দেখো, দু’হাজার রেকর্ড এনেছি তোমার।’
আনন্দে-খুশিতে মন ভরে উঠলো। ছুটলাম কাজীদার বাড়ি। শুনলাম তিনি রিহার্সেল রুমে গেছেন। গেলাম সেখানে। দেখি, দাবা খেলায় তিনি মত্ত। দাবা খেলতে বসলে দুনিয়া ভুলে যান তিনি। আমার গলার স্বর শুনে একদম লাফিয়ে উঠে আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন, ‘আব্বাস, তোমার গান কী যে-’ আর বলতে দিলাম না, পা ছুঁয়ে তাঁর কদমবুসি করলাম। ভগবতীবাবুকে বললাম, ‘তাহলে এক্সপেরিমেন্টের ধোপে টিকে গেছি, কেমন?’ তিনি বললেন, ‘এবার তাহলে আরও কখানা এই ধরনের গান…..। খোদাকে দিলাম কোটি ধন্যবাদ।
গান দুটি ফেব্রুয়ারি ১৯৩২ সালে এইচ এম ভি থেকে রেকর্ড হয়। রেকর্ড নং এন ৪১১১। প্রথম গানটি কাহারবা তালে পিলু রাগে সুরবন্ধ এবং দ্বিতীয় গানটি কাহারবা তালে ভৈরবী রাগে সুরবদ্ধ। নজরুলের এই গান দুটি জুলফিকার গীতিগ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।
কাজী নজরুল ইসলাম রচিত ও সুরারোপিত ‘ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে’ ইসলামি গানটি প্রথম রচিত, জনপ্রিয় এবং ঐতিহাসিক গান। এই গানটি রচিত না হলে ইসলামি গানের ইতিহাস হয়তো অন্য রকম হতো।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, ঐ সময় কলকাতা ম্যাডান থিয়েটারের প্রধান নাট্যকার ও গীতিকার ছিলেন কাশ্মীরের জনাব আগা হাশার। তাঁর রচিত একটি বিখ্যাত গজল গান হচ্ছে ‘হাম জায়েঙ্গে ওয়াহাঁ খুশ দিলে দিওয়ানা যাহাঁহো।’ নজরুল এই গজল গানের

সুর ও ছন্দে রচনা করেন ‘ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে’ গান।

৩. ইয়া মোহাম্মদ বেহেশত্ হতে খোদায় পাওয়ার পথ দেখাও ,এই দুনিয়ার দুঃখ থেকে এবার আমায় নাজাত দাও ॥ 
৪.  আঁধার মনের মিনারে মোর হে মুয়াজ্জিন দাও আজান।  গাফেলতির ঘুম ভেঙে দাও হউক নিশি অবসান ॥
১৯৪০ খ্রিস্টাব্দের প্রথম দিকের কথা। সে সময় নদীয়া জেলার কাচড়াপাড়ায় ‘রেলওয়ে ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশন’ নামকরা সব বিচারকদের উপস্থিতিতে বার্ষিক সংগীত প্রতিযোগিতার আয়োজন করত। সে বছর সম্মানিত বিচারকের আসর অলংকৃত করেছিলেন কবি কাজী নজরুল ইসলাম। এ প্রতিযোগিতা এত জনপ্রিয় ছিল যে, দূর-দূরান্ত থেকে এসে ছেলেমেয়েরা তাতে অংশ নিত। মুর্শিদাবাদ জেলার বহরমপুর অঞ্চলের সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে পড়া ফুল মোহাম্মদ সেবার এ প্রতিযোগিতায় অংশ নেন।
প্রতিযোগীর সংখ্যা বেশি ছিল বলে প্রত্যেকের জন্য নির্ধারিত সময় ছিল মাত্র আড়াই থেকে পৌনে তিন মিনিট। এরপরও যাদের গাওয়া বিচারকরা মান সম্মত বলে মনে করছিলেন না, তাদেরকে আড়াই মিনিটের আগেই থামিয়ে দিচ্ছিলেন। সাংস্কৃতিক সপ্তাহের শেষ দিনে সর্বশেষ প্রতিযোগী ছিলেন ফুল মোহাম্মদ। স্বভাবতই বিচারকরা সবাই পরিশ্রান্ত এবং অবসন্ন। এই পরিবেশে আড়াই-পৌনে তিন মিনিটে খেয়াল পরিবেশন করার কথা কল্পনাই করা যায় না। তবুও ফুল মোহাম্মদ রাগ টোড়ি’র আলাপ শুরু করলেন। আলাপ শুনে কবি নজরুল বিচারকের আসন থেকে হাত ইশারায় প্রতিযোগীকে থামতে বললেন। ফুল মোহাম্মদ হতচকিত হয়ে গান থামালে, নজরুল বললেন, ‘তুমি যতটুকু সময় পার গাও’। রাগ টোড়ি পুরো গাওয়ার পর ফুল মোহাম্মদের মনে হলো কবি নজরুল যেন এতক্ষণ নিমগ্ন হয়ে রাগ শুনছিলেন। এই প্রতিযোগিতার ফলাফল ঘোষিত হলে দেখা গেল, বিচারকদের রায়ে তিনি প্রথম হয়েছেন। যাওয়ার সময় কবি নজরুল ফুল মোহাম্মদকে যে কোনো রোববারে মেগাফোন কোম্পানিতে যেতে বলেন। নজরুল তখন মেগাফোন কোম্পানির ট্রেনার। পরে এক রোববারে ফুল মোহাম্মদ কবি নজরুলের সাথে দেখা করেন। কবি তাকে একান্ত স্নেহ ভরে কাছে টেনে বসান এবং পুনরায় টোড়ি রাগ গাইতে বলেন। ফুল মোহাম্মদ হৃদয় উজাড় করে কবিকে টোড়ি রাগ গেয়ে শোনান। এরপর কবির আদেশে তিনি আরো দু’দুটি রাগ গেয়ে শোনান। কবি তরুণ ফুল মোহাম্মদের রাগ বিস্তার শুনে খুবই মুগ্ধ হন এবং তাঁকে উৎসাহ দেন।
কবি বললেন, তোমাকে দিয়ে গান রেকর্ড করাবো। এরপর কবি তাঁর বিখ্যাত গান ‘নিলাম্বরী শাড়ী পড়ি নীল যমুনায় কে যায়’ তাঁকে শিখিয়ে রেকর্ড করার জন্য একদিন রিহার্সেল দেন কিন্তু পরদিন কী মনে করে কবি বললেন, ‘না, তুমি মুসলমান ছেলে, তোমাকে দিয়ে প্রথম দুটো ইসলামি গান রেকর্ড করাবো।’ কবির কথা- বার্তায় মনে হলো ফুল মোহাম্মদকে দিয়ে রেকর্ড করানোর জন্য কবি দুটো ইসলামি গান রচনা করে এনেছেন। এরপর কবি নিজের তত্ত্বাবধানে শিখিয়ে ও রিহার্সেল দিয়ে ফুল মোহাম্মদকে দিয়ে দুটো ইসলামি গান রেকর্ড করান। এ দুটো নজরুলের জনপ্রিয় ইসলামি গান হলো
‘ইয়া মোহাম্মদ বেহেশত হতে’ ও ‘আঁধার মনের মিনারে মোর।’ জুলাই ১৯৪০ সালে দমদমের রেকর্ডিং স্টুডিওতে ফুল মোহাম্মদের কণ্ঠে রেকর্ড করে মেগাফোন কোম্পানি থেকে তা প্রকাশিত হয়। গান দুটির রেকর্ড নং মেগাফোন জে এন জি ৫৪৮৭।
পরে ‘নীলাম্বরী শাড়ী’ গানটি ধীরেন্দ্র মিত্রর (ফেলুবাবু) কণ্ঠে রেকর্ড হয়। ফুল মোহম্মদ বলেছেন, সাতচল্লিশের দেশ ভাগের সময় তিনি সপরিবারে বাংলাদেশে চলে আসেন। ওই সময়েই নজরুলের হস্তলিখিত ‘নীলাম্বরী শাড়ী’ গানের কপিটি তাঁর কাছ থেকে হারিয়ে যায়।
উল্লেখ্য রেকর্ডের গায়ে শিল্পীর নামের বানান ছিল ‘ফুল মহম্মদ’। শিল্পী পরে নিজের নাম লেখেন ‘ফুল মোহাম্মদ’-এ বানানে।
৫. হে নামাজী! আমার ঘরে নামাজ পড় আজ।   দিলাম তোমার চরণ-তলে হৃদয়-জায়নামাজ ॥  
এই গানটির গীতি উৎস সম্পর্কে অধ্যাপক ড. রফিকুল ইসলাম তাঁর এক বক্তৃতায় বলেনগ্রামোফোন কোম্পানির রিহার্সেল রুমে কাজী নজরুল ইসলাম, আব্বাসউদ্দীন আহমদসহ অন্যান্য শিল্পীরা মিলে গল্প-গুজব করছেন। এমন সময় আজানের সুর ভেসে এলে আব্বাসউদ্দীন বললেন, আপনারা বসুন, আমি নামাজ পড়ে আসি। কাজী নজরুল ইসলাম কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে হাতের কাছে থাকা কাগজ-কলমে খস্খস্ করে কি যেন লিখলেন। আব্বাসউদ্দীন নামাজ শেষে রুমে ফিরে এলে নজরুল বললেন, নে তোর জন্য একটা গান লিখেছি।
গানটি তখনি সুর সমেত আব্বাসউদ্দীনকে নজরুল শিখিয়ে দিলেন।
লেখক: গবেষক, সাহিত্য ও সংগীত ব্যক্তিত্ব 
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক : দৈনিক সংবাদ সংযোগ 

                                                                                                                                                                                                                                                                                      Email: shahinurmusic70@gmail.com


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এই ক্যাটাগরির আরো নিউজ