দশ কারণে দেশে চালের দাম অস্বাভাবিক বেড়েছে। সম্প্রতি জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থার এক গোপন প্রতিবেদনে এসব কারণ চিহ্নিত করা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে- ক্ষমতাশালী একটি সিন্ডিকেট চক্রের স্বল্প সময়ের ব্যবসায় অধিক মুনাফা লাভের মনোভাব। পরিকল্পিতভাবে দাম বাড়াতে ব্যবসায়ীদের নানা অপপ্রচার। এছাড়া কৃষকপর্যায়ে পর্যাপ্ত ধান মজুদ না থাকা। সরকারি মজুদ নিরাপত্তাবলয়ের নিচে নেমে যাওয়া। এ খাতে অবাধে ব্যাংক ঋণ ছাড় এবং সুদের হার বেশি হওয়া। বাজারে টিসিবির শক্তিশালী প্রভাব না থাকা। মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য। হাওরে ফসলের ক্ষতি এবং আকস্মিক বন্যা ও অতিবৃষ্টি। পূর্বাভাস অনুযায়ী, সঠিক সময়ে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে দায়িত্বশীলদের দীর্ঘসূত্রতা এবং খাদ্য নিরাপত্তামূলক বিভিন্ন কর্মসূচি বন্ধ থাকাও চালে সংকট তৈরি করেছে।
বলা হচ্ছে, ব্যবসায়ীদের পুঁজি বিনিয়োগসহ অন্যান্য মজুদদারি খরচ যোগ করা হলেও কোনোভাবেই চালের মূল্য ১৫ থেকে ১৮ টাকা পর্যন্ত বৃদ্ধি গ্রহণযোগ্য নয়। মূল্য বৃদ্ধির নেপথ্যে থাকা সিন্ডিকেটে দেশের বিভিন্ন জেলার অর্ধশতাধিক শীর্ষ মিলার এবং কৃষিপণ্যের বাজারজাতকারী কিছু কর্পোরেট ব্র্যান্ড ব্যবসায়ী রয়েছেন। অসাধু এসব মিল মালিকের নাম-ঠিকানা দিয়ে এরই মধ্যে গোয়েন্দা প্রতিবেদনটি সরকারের দায়িত্বশীল সব মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে।
ধান-চাল উৎপাদননির্ভর এলাকাগুলোর দায়িত্বশীল কিছু ব্যবসায়ীও যুগান্তরের কাছে দাবি করেন, চাল সংকটের নেপথ্যে রয়েছে ক্ষমতাশালী সিন্ডিকেট। রাজনৈতিকভাবে এরা বেশ ক্ষমতাশালী। তাদের অনেক অর্থও আছে। এরা ব্যাংক, স্থানীয় প্রশাসন এবং সরকারে প্রভাব বিস্তারের সুযোগ রাখে। বিপুল অঙ্কের ব্যাংক ঋণ নিয়ে মৌসুম এলেই নামমাত্র দামে কৃষকের কাছ থেকে কিনে নেন সব ধান। আর মৌসুম ফুরালেই কৃত্রিম সংকট তৈরি করেন। অবৈধ মুনাফা লুটে নেয়াই এর অন্যতম উদ্দেশ্য। সিন্ডিকেটের এ কারসাজিতে সরকার বিভ্রত হচ্ছে। কিন্তু সরকারেরই দায়িত্বশীল কিছু কর্মকর্তার এ সিন্ডিকেটে যোগসাজশ থাকায় বরাবরই এরা থেকে যাচ্ছে ধরাছোঁয়ার বাইরে।
এসব অভিযোগের ভিত্তি আরও জোরালো হয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদের বক্তব্যে। তিনি সম্প্রতি সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছেন, কারসাজি করে চালের দাম বাড়িয়ে ভোক্তার পকেট থেকে কয়েক হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগটি এবার দুদক তদন্ত করে দেখবে। তিনি জানান, এ চাল সিন্ডিকেটে মিল মালিক, বড় ব্যবসায়ী এবং সরকারি কিছু কর্মকর্তার যোগাসাজশ থাকার অভিযোগ এসেছে দুদকের কাছে। এখন অধিকতর তদন্ত করে এ চক্রের সবাইকে আইনের আওতায় আনা হবে।
চালের দাম অস্বাভাবিক বৃদ্ধির পেছনে ব্যবসায়ীদের মজুদ কারসাজি রয়েছে বলে জানিয়েছেন বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ। তিনি যুগান্তরকে বলেছেন, কৃত্রিম সংকট তৈরি করে বাড়ানো হয়েছে দাম। সরকারকে বিভ্রত করতেই পরিকল্পিতভাবে সরকারবিরোধী একটি চক্র কাজটি করেছে। তিনি বলেন, বিষয়টি সরকারের নজরে আসার পরপরই তা রুখতে প্রতিদিন বিভিন্ন জায়গায় অভিযান চালানো হচ্ছে। এতে যেসব জায়গায় অবৈধ মজুদ ধরা পড়ছে, তা সঙ্গে সঙ্গে বাজেয়াপ্ত করা হচ্ছে। পাশাপাশি তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, দেশে চালের কোনো সংকট নেই। কারণ হাওর অঞ্চলে বন্যার কারণে ধানের উৎপাদনে যে ক্ষতি হয়েছে, তা পুষিয়ে নিতে সরকারি আমদানির পাশাপাশি বেসরকারি পর্যায়ে আমদানি উন্মুক্ত করে দেয়া হয়েছে। বিনা মার্জিনে আমদানি এলসির সুযোগ দেয়া হচ্ছে। প্রতিদিন দেশে ঢুকছে ওই চাল। বেসরকারিভাবে মিলার, মোকাম ও বাজার পর্যায়ের অভ্যন্তরীণ মজুদ তো রয়েছেই। সব জায়গাতেই চাল পাওয়া যাচ্ছে। যত খুশি কেনা যাচ্ছে। কিন্তু দাম বেশি রাখা হচ্ছে। এটা একটা কারসাজি।
প্রতিবেদনে চালের মূল্য বৃদ্ধি রোধে গোয়েন্দা সংস্থার পক্ষ থেকে সরকারকে সাতটি সুপারিশ করা হয়েছে। ওই সুপারিশে বলা হয়েছে, প্রাধমিক এবং কার্যকর পদক্ষেপ হতে পারে সারা দেশে ওএমএস পদ্ধতিতে খোলা বাজারে চাল বিক্রি করা। পাশাপাশি ভিজিএফ, ভিজিডি ও টিআর কর্মসূচি চালু করা। এতে চালের বাজার নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। দ্বিতীয়ত, চিহ্নিত মিল মালিক ও চাল ব্যবসায়ীদের অযৌক্তিক মুনাফা লাভের ধারা থেকে ফিরিয়ে আনতে ব্যবস্থা গ্রহণ। তৃতীয়ত, চাতাল খাতে অবাধ ব্যাংক ঋণ মনিটরিং ও ছাড়কৃত ঋণে সুদ সহনীয় রাখা। চতুর্থত, খাদ্য পণ্য ব্যবসায়ীরা যাতে ব্যাংক ঋণ নিয়ে নির্দিষ্ট সময়ের বেশি খাদ্যশস্য গুদামজাত করতে না পারে, সেজন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে মজুদবিরোধী আইন কার্যকর। পঞ্চমত, বাজার মনিটরিং বৃদ্ধি। ষষ্ঠত, ধানি জমিতে তামাক চাষ বন্ধে প্রয়োজনীয় নীতিমালা প্রণয়ন। সপ্তমত, কৃষককে ধান উৎপাদনে উৎসাহিত করতে ফলন মৌসুমে ধানের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করা।
গোয়েন্দা প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, সরকারি মজুদের স্বল্পতা ও কৃষকের ধান কম সংরক্ষণ করার সুযোগ নিচ্ছে ব্যবসায়ীরা। চলতি বছর বোরো মৌসুমে ধান ও চালের মূল্য স্বাভাবিক ছিল। কিন্তু কৃষকের কাছ থেকে চাতাল ও মিল মালিকরা কম দামে ধান কিনে সাপ্লাই চেইনে কঠোর নিয়ন্ত্রণ নিয়ে এখন বেশি দামে বিক্রি করছে। ফলে বাজারে এদের একক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তবে হাওর অঞ্চলে বন্যা, সারা দেশে দু’দফা বন্যা ও অতিবৃষ্টির কারণে আমন ফসলের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। এতে আগামী নভেম্বর-ডিসেম্বরে আমনের প্রত্যাশিত ফলন মিলবে না- এমন অপপ্রচার চালানো হয়েছে। এক্ষেত্রে চলতি বছর সরকারের কাছে ধান-চালের পর্যাপ্ত মজুদ নেই- এমন তথ্য জেনে যাওয়ায় চক্রটি আরও লাগামহীন হয়ে পড়েছে। ব্যবসায়ী মহল এসব অপপ্রচারকে পুঁজি করে বাজার নিয়ন্ত্রণে নিয়ে মূল্য বৃদ্ধিতে সক্রিয় হয়ে উঠেছে।
অন্যদিকে বেশিরভাগ কৃষক ধার করে ধান উৎপাদন করেন। ধার পরিশোধে সব ধান একসঙ্গে বিক্রি করে দেন। ফলে ফেব্রুয়ারি-এপ্রিলে কৃষকের হাতে ধানের মজুদ না থাকায় মজুদদার ও মিল মালিকরা কারসাজি করে দাম বাড়ায়। এছাড়া বাজারে ট্রেডিং কর্পোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) শক্তিশালী প্রভাব নেই। ফলে বাজার সব সময় ব্যবসায়ীদের নিয়ন্ত্রণ ও ইচ্ছায় পরিচালিত হচ্ছে। এতে ৯৩-৯৫ শতাংশ ভোক্তার সুরক্ষা দেয়া সম্ভব হচ্ছে না। ধানের মোকাম থেকে ভোক্তা পর্যায়ে চাল পৌঁছতে ৪-৫ হাত বদল হয়। প্রতিবার হাত বদলেই বাড়ে চালের দাম। উৎপাদক থেকে ভোক্তা পর্যন্ত চাল পৌঁছতে দাম ৫-৬ টাকা বাড়ে। ঢাকার বড় ব্যবসায়ীরাও চালের বাজার নিয়ন্ত্রণে বড় ভূমিকা রাখছে। এছাড়া পরিবহন খরচ, বিভিন্ন চাঁদা, বিদ্যুৎ বিল বৃদ্ধি চালের দাম বাড়ানোয় প্রভাব রাখছে।
অটো মেজর অ্যান্ড হাস্কিং মিল মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক কেএম লায়েক আলী যুগান্তরকে বলেন, অটো রাইস মিলাররা বড় পরিসরে ব্যবসা করেন। এ ধরনের ব্যবসার উপকরণই হচ্ছে ধান ও চাল। মিলে এর মজুদ থাকবেই। এটিকে কৃত্রিম সংকট বলতে তিনি নারাজ। তিনি বলেন, মিলারদের মজুদ ক্ষমতা সরকার অনুমোদিত। উৎপাদন সক্ষমতা বিবেচনায় মিলাররা ধানের ৫ গুণ এবং চালে ২ গুণ মজুদ করতে পারেন। এর অতিরিক্ত মজুদ কেউ করে থাকলে সেটা অবশ্যই অবৈধ। এটা করলে আমরা তাদের পক্ষে নেই। তবে এটা বলতেই হচ্ছে, এখন বাজারে যে ক্রাইসিস (সংকট), সেটা ধানের কারণেই হয়েছে। ধান সরবরাহ বাড়লে এবং দাম কমলে চালের সরবরাহ এবং দাম দুটিই কমবে।
নওগাঁ জেলা ধান-চাল আড়তদার সমিতির সভাপতি নিরোধ চন্দ্র সাহা যুগান্তরকে বলেন, মিল সচল রাখতে সবাই সক্ষমতা বুঝে মজুদ করছে। তবে কেউ কেউ সক্ষমতার অতিরিক্ত বেশি মজুদ করছে না, এটা আমরা জোর দিয়ে বলতে পারব না। কারণ ব্যবসায়িক তথ্য স্পর্শকাতর। কেউ কারও তথ্য প্রকাশ করতে চায় না। তাই এ ধরনের তথ্য থাকলে সেটা সরকারের বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার কাছে থাকতে পারে।
রাইস মিল ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সহসভাপতি কাওসার আলম খান বলেন, ধান না থাকলে চাল আসবে কোথা থেকে। আবার যাদের কাছে ধান আছে তাদের কেনা দাম বেশি হওয়ায় মিলারদের কিনতেও হচ্ছে বেশি দামে। তাই চালের দামও বেশি রাখতে হচ্ছে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এখন পাইকারি বাজারে ৪০ টাকার নিচে চাল পাওয়ার আশা করা ঠিক নয়।