গত কয়েকদিন দেশজুড়ে বেশ ভারী বৃষ্টিপাত হয়েছে। বৃষ্টিপাতের কারণে বিভিন্ন জায়গায় যে পানি জমা হচ্ছে, সেগুলো এডিস মশার প্রজননকে আরও বাড়াবে।
ফলে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত ও মৃত্যুও বাড়বে বলে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মত।
জুন থেকে সেপ্টেম্বর মাস ডেঙ্গু রোগের মৌসুম হলেও বর্তমানে প্রায় বছর জুড়েই ডেঙ্গুরোগের প্রকোপ দেখা যাচ্ছে। বর্ষা মৌসুমের আগেই হানা দেওয়া ডেঙ্গুর প্রকোপ ক্রমান্বয়ে বেড়েই চলেছে। চলতি বছরে ডেঙ্গু আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা দেশে ইতিহাসে অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়েছে।
বর্তমানে বৃষ্টিপাতের কারণে ডেঙ্গু পরিস্থিতি কেমন হতে পারে জানতে চাইলে রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) উপদেষ্টা ও প্রতিষ্ঠানটির সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. মোস্তাক হোসেন বাংলানিউজকে বলেন, বৃষ্টি শেষ হওয়ার এক থেকে দেড় মাস পর্যন্ত ডেঙ্গু থাকবে। এ সময়ে ডেঙ্গু থাকলেও আক্রান্তের সংখ্যা হয়তো কিছুটা কমবে। বৃষ্টি শেষের দেড় মাস পর মৃত্যুও কমবে। গত বছর অক্টোবরেও বৃষ্টিপাত ছিল, ফলে নভেম্বর পর্যন্ত দেশে পূর্ণ মাত্রায় ডেঙ্গু ছিল। অক্টোবর মাস জুড়ে যদি বৃষ্টি থাকে তাহলে এ বছরও গত বছরের পুনরাবৃত্তি হতে পারে। অর্থাৎ নভেম্বরও উচ্চমাত্রায় ডেঙ্গুর রোগী পাওয়া যাবে। ডেঙ্গুতে মৃত্যুর সংখ্যা হয়তো ডিসেম্বরের মাঝামাঝি সময় থেকে কমতে পারে।
একই বিষয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের কীটতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক কবিরুল বাসার বলেন, বৃষ্টিপাতের কারণে বিভিন্ন জায়গায় যে পানি জমা হচ্ছে সেগুলো এডিস মশার প্রজননকে আরও বাড়াবে। ফলে ডেঙ্গুর সিজন আরও বেশি প্রলম্বিত হবে। বৃষ্টির কারণে অক্টোবর জুড়েই ডেঙ্গুর প্রকোপ থাকবে বলেই মনে হচ্ছে। বৃষ্টির পর প্রায় এক মাস ডেঙ্গুর প্রকোপ থাকে। আজকে অক্টোবর মাসের প্রথম সপ্তাহ, এরপর যদি আবারও বৃষ্টিপাত হয়, তাহলে ডেঙ্গুর প্রকোপ আরও বেশি দিন থাকবে।
তিনি বলেন, এই মুহূর্তে এডিস মশার ব্রিডিং সোর্স ম্যানেজমেন্ট, যেসব জায়গায় ও পাত্রে পানি জমে এডিস মশা জন্মায়, যেসব জায়গায় পানি অপসারণ করা খুবই জরুরি।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, গত কয়েক বছর ধরে অব্যাহতভাবে ডেঙ্গুর সংক্রমণ ঘটলেও, যথাযথ উদ্যোগ না নেওয়ায় ডেঙ্গু ভয়াবহ হয়ে উঠেছে। ইতোপূর্বে ডেঙ্গু রাজধানী কেন্দ্রিক থাকলেও বর্তমানে ডেঙ্গু সারাদেশে ছড়িয়ে পড়েছে।
কবে নাগাদ ডেঙ্গুর সংক্রমণ কমতে পারে জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার সাবেক পরিচালক ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. বে-নজির আহমেদ বলেন, যেহেতু এখনও দেশে প্রতিদিন প্রায় দুই থেকে আড়াই হাজার মানুষ ডেঙ্গু রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। তার অর্থ হচ্ছে, বয়স্ক এডিস মশা পর্যাপ্ত পরিমাণে আছে। এই মশাগুলো মানুষের রক্ত খেয়েছে। মশাগুলো রক্ত খায় ডিম পাড়ার জন্য। পানি জমলে এই বয়স্ক মশাগুলোই ডিম পাড়বে। ফলে এডিস মশার আরেকটি প্রজন্ম তৈরি হবে। আবার এই নতুন জন্মানো মশাগুলোই ভাইরাসের বাহক হবে। কারণ, এখনও যেহেতু ডেঙ্গু রোগী আছে, তার মানে এডিসের ভাইরাসও আছে। এই মশাগুলোই এডিস সংক্রমণ ঘটাতে থাকবে। এই সাইকেলটা প্রায় দুই থেকে তিন সপ্তাহ চলবে। এখন অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহ চলছে। আমার ধারণা পুরো অক্টোবর ডেঙ্গুর প্রকোপ থাকবে। তবে ডেঙ্গু সংক্রমণের মাত্রা ভয়াবহ হবে না-কি সংক্রমণ কমে যাবে, সেটা একটা প্রশ্ন এবং এটা বলাও কঠিন।
তিনি বলেন, অনেক বেশি বৃষ্টিপাত হলে ডেঙ্গুতে কিছুটা উপকার হয়। বেশি বৃষ্টিপাত হলে এডিসের লার্ভাগুলো ধুয়ে নদীতে চলে যায়। নদীতে চলে যাওয়ার পর সেখান থেকে হয়তো সামান্য কিছু মশা ফিরে আসতে পারে। লার্ভা থেকে মশার যেই প্রজন্মটা হতো সেটা আর হবে না। আবার যে মশাগুলো ডিম পারেনি সেগুলো এখন যে পানি জমে আছে সেখানে ডিম পারবে। বর্তমানে অনেক পাত্রেই এবং বিভিন্ন জায়গায় পানি জমে আছে। এখন যদি সেই সব পাত্র কিংবা জায়গা থেকে পানিগুলো অপসারণ করা যেত তাহলে আমরা এডিস মশা নিয়ন্ত্রণ করতে পারতাম। কিন্তু সেটাই আমাদের হয় না। আমাদের সিটি করপোরেশনগুলো বুঝতেই পারে না, কাজটা কত বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, বর্ষার কারণেই বর্তমানে বৃষ্টিপাত হচ্ছে। অক্টোবর নাগাদ বর্ষা বিদায়ে বৃষ্টিপাত কমে যাবে। গত বছর একুশে অক্টোবর থেকে বর্ষা পুরোপুরি বিদায় নিয়েছিল বলেও আবহাওয়া অধিদপ্তরের মাধ্যমে জানা যায়।
ডেঙ্গু সংক্রমণ কবে কমবে এমন প্রশ্নের উত্তরে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (পরিকল্পনা ও উন্নয়ন) অধ্যাপক ডা. আহমেদুল কবির বলেন, তাপমাত্রা না কমলে হয়তো ডেঙ্গু সংক্রমণটা কমবে না। ডেঙ্গুটা এখন তাপমাত্রার ওপর নির্ভরশীল। বৃষ্টি না থামলে কমার সম্ভাবনা দেখছি না। ডেঙ্গু সংক্রমণ প্রকৃতির ওপর নির্ভরশীল না হলেও এডিস মশার বংশ বৃদ্ধিটা ঠিকই প্রকৃতির ওপর নির্ভর করছে।