• সোমবার, ২০ মে ২০২৪, ০৪:৫৪ অপরাহ্ন

লালনের বাণীতে পাঠান্তর,

নিউজ ডেস্ক
আপডেটঃ : বৃহস্পতিবার, ১৯ অক্টোবর, ২০২৩

লেখক: শাহীনুর রেজা

ফকির লালন শাহ’র ১৩৩ তম তিরোধান দিবস-কে মনে করেই বোধ করি সকাল বেলাতে লালনের দু’একটা গান শুনবার চেষ্টা করলাম। এখন তো আর ক্যাসেট/সিডি’র যুগ নাই, মোবাইলে গুগল অপশনে গিয়ে ‘লালনের গান’ লিখতেই নন্দীত শিল্পী ফরিদা ইয়াসমীনের ছবিসহ কভার ভেসে উঠলো। প্রথম গানটা শিল্পী গাচ্ছেন ‘খাঁচার ভিতর অচিন পাখি কম্নে আসে যায়’…ভুল শুনলাম না তো! ‘কম্নে আসে যায়’….। নাহ! ফিরে আবার ঐ একই শব্দ ‘কম্নে’।
এ গানটি কিরণ চন্দ্র রায়, চন্দনা মজুমদার, শফি মন্ডল, বিউটি সহ আরো দু’একজন শিল্পী গেয়েছেন। প্রত্যেকের কণ্ঠে ‘কেমনে আসে যায়’ শোনা যায়। অত্যন্ত জনপ্রিয় এ গানটি লোকের মুখে-মুখে ফেরে ‘খাঁচার ভিতর অচিন পাখি কেমনে আসে যায়’ এ-ভাবে। ফরিদা পারভীন ক্যাসেটকালীন রেকর্ডে কিন্তু ‘কেমনে আসে যায়’ কথাটিই গেয়েছেন। তাহলে তিনি শব্দটি পরিবর্তন করলেন কেন! আমরা অবশ্যই ভাববো যে, শিল্পী সুস্থ-স্বজ্ঞানেই একাজটি করেছেন। কিন্তু কেন করলেন! নিশ্চয়ই পরবর্তী গবেষকদের গবেষণায় পূর্ববর্তী শব্দটি ভুল প্রমাণিত হওয়ায় তিনি এমনটি গেয়েছেন। তাহলে তো এখন লালনের সব শিল্পীদের ‘কম্নে’ শব্দটিই গাওয়া উচিত। কিন্তু তা হচ্ছে না।
নতুন শিল্পীরা যাঁর রেকর্ড ভালো লাগছে অথবা যে গুরু যে ভাবে শেখাচ্ছেন তেমন করেই গাচ্ছেন। সম্পাদনা গন্থগুলো পর্যালোচনা করলে দেখা যায়- কেবল আবুল আহসান চৌধুরী উল্লিখিত গানে ‘কম্নে’ শব্দটি ব্যবহার করেছেন। অন্যান্য ওয়াকিল আহমেদ, এ এস এম লুৎফর রহমান, আবদেল মান্নান, মুস্তাফা জামান আব্বাসী, ফকির আনোয়ার হোসেন মন্টু শাহ প্রমুখ সম্পাদকদের লালন বিষয়ক সম্পাদনা গ্রন্থে ‘কেমনে’ শব্দ আছে। কেবল একটি শব্দ নয় লালনের গানের অনেক বাক্যে এমনকি অনুচ্ছেদেও লক্ষণীয়ভাবে পাঠান্তর লক্ষ্য করা যায়।
লালনের সর্বাধিক গানের সংগ্রাহক হিসেবে যিনি দাবি করতে পারেন, তিনি মুহম্মদ মনসুরউদ্দীন। তিনি কোনো গান সম্পাদনার ঘোর বিরোধী ছিলেন। তাঁর একমাত্র পঞ্চম খন্ড ‘হারামণি’ সম্পাদিত আকারে প্রকাশিত হয়। তাও তাঁর নিজের সম্পাদনায় নয়, সম্পাদনা করেছিলেন ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের প্রাক্তন অধ্যাপক মুহম্মদ আবদুল হাই। মুহম্মদ মনসুরউদ্দীন যেভাবে অশিক্ষিত জনসাধারণ, ফকীর, বোষ্টম- বোষ্টমী, চাষাভূষা ও মাঝিমাল্লাদের নিকট থেকে লালনের গান সংগ্রহ করেছেন, সেভাবেই ছেপেছেন (যৎ শ্রুতং তৎ লিখিতং) সম্পাদনার ধারে-কাছে যাননি। তাঁরমতে, ‘ইহার ব্যত্যয় ঘটলে অধর্ম হয়- এই মত। তাই তিনি লালনের কোনো কোনো গান বিভিন্ন পাঠের জন্য কয়েকবার মুদ্রণ করেছেন। তিনি যে আন্তর্জাতিক গ্রাম্য গান সংগ্রহ-বিধান অনুসরণ করেছিলেন, সেই সংগ্রহ বিধান আর কোনো সংগ্রাহক অনুসরণ করেছেন, এমন প্রমাণ পাওয়া যায় না। লালনের গান তাঁরা সংশোধন ও সম্পাদনা ছাড়া কেউ ছাপেননি। মুহাম্মদ মনসুরউদ্দীনের সংগ্রহে তাই যেমন লালনের খণ্ডিত গান পাই, তেমনি প্রক্ষিপ্ত অংশও তাঁর সংগৃহীত গানে আমরা লক্ষ্য করি। এছাড়াও অনেক অর্থহীন শব্দ ও বাক্যের উপস্থিতি আমাদের দৃষ্টিপীড়া ঘটায়। এজন্য কেউ তাঁর অসম্পাদিত লালন সংগীত প্রকাশ সমর্থন করতে পারেননি। পক্ষান্তরে যারা লালনের গান সংগ্রহ করে ছাপেন সম্পাদনার ক্ষেত্রে তারা কতটুকু স্বাধীনতা ভোগ করেন, সেটাও বিচার্য বিষয়। ‘নিজস্ব বিচার-বুদ্ধি প্রয়োগ’ আদৌ নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি নিরপেক্ষ হতে পারে কি-না, সেটাও বিচার-বিবেচনা করে দেখা দরকার।
‘এলাহি আলামিন গো আল্লা বাদশা আলমপানা তুমি’- গানটি থেকে একটি অনুচ্ছেদের দৃষ্টান্ত দিলে পাঠক বিভিন্ন সম্পাদকের হাতে সম্পাদনাকৃত পাঠে পাঠান্তরের সাথে-সাথে অর্থ ভেদটাও বুঝতে পারবেন। উপেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্যের পাঠ-
নবী না মানিল যারা
নেহায়েত কাফের তারা,
সেই কাফের দায়মাল হবে
বিনা হিসেবে দোজখে যাবে।
আবার তারে খালাস দেবে
জানা গেল এর হমি।।
খোন্দকার রফিউদ্দীনের পাঠ-
নবী না মানে যারা
মরদুদ কাফের তারা,
সেই মরদুদ দায়মাল হবে
বিনা হিসাবে দোজখ যাবে।
আবার তারে খালাস দিবে
বলে লালন কি হয় জানি।।
মুহম্মদ আবু তালেবের পাঠ-
নবী না মানিল যারা
মুআহিদ কাফির তারা,
সেই মুআহিদ দায়মাল হবে
বিনা হিসেবে দোজখে যাবে।
আবার কি তারে খালাস দিবে
ফকীর লালন কয়মোর কি হয় জানি।।
আবুল আহসান চৌধুরীর পাঠ-
নবী না মানে যারা
মোয়াহেদ কাফের তারা,
সেই মোয়াহেদ দায়মাল হবে
বেহিসাব দোজখে যাবে
আবার তারে খালাস পাবে
লালন কয় মোর কী হয় জানি।।
ওয়াকিল আহমেদের পাঠ-
নবী না মানিল যারা
মর্তুাহেদ কাফের তারা
সেই মর্তুাহেদ দায়মাল হবে
বিনা হিসেবে দোজখে যাবে
আবার তারে খালাস দিবে
লালন কয়, মোর কি হয় জানি।।
ফকির আনোয়ার হোসেন মন্টু শাহ’র পাঠ-
নবী না মানে যারা
মোয়াহেদ কাফের তারা
সেই মোয়াহেদ দায়মাল হবে
বেহিসাব দোজখে যাবে
আবার তারা খালাস পাবে
লালন কয় মোর কি হয় জানি।।
কেবল শব্দ, বাক্যবিন্যাস বা অনুচ্ছেদে নয়, অর্থের ভিন্নতাও এখানে স্পষ্ট হয়ে ফুটে উঠেছে। এছাড়াও আছে বানান ও বিরাম চিহ্নের দূর্বলতা।
এতো গেলো এক গানের পাঠান্তর। এরকম ৫০টি গানের পাঠান্তর এ লেখকের ‘লালন কী জাত সংসারে’ গ্রন্থে পাওয়া যাবে।
যতদিন যাবে, মুখে মুখে চলে আসা লালনের গানের পাঠান্তর বিকৃতির প্রলেপটা আরও বেশি করে পড়বে। তাই দ্ব্যার্থ কণ্ঠে বলা যায়, লালনের বাণীতে পাঠান্তর রোধ করা না গেলে লালন চর্চা ব্যহৃত হবে, শুদ্ধ বাণী হুমকির মুখে পড়বে। লালনের শুদ্ধ চর্চার জন্যই শুদ্ধ বাণীর প্রয়োজন, আর শুদ্ধ বাণী প্রতিষ্ঠা পেতে পাঠান্তর রোধ করা জরুরী- তা আইন করে হলেও।
লেখক : সাহিত্য ও সংগীত ব্যক্তিত্ব
ভারপাপ্ত সম্পাদক দৈনিক সংবাদ সংযোগ পত্রিকা
                                                                                                                                             shahinurmusic70@gmail.com 


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এই ক্যাটাগরির আরো নিউজ