প্রার্থী বিজয়ে ফ্যাক্টর জাতীয় পার্টি
শ্রীপুর উপজেলা ও সদর উপজেলার ৯টি ইউনিয়ন ও একটি পৌরসভা নিয়ে মাগুরা-১ আসন। এলাকাটি আওয়ামী লীগের শক্ত ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত। ’৯০-পরবর্তী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এ আসন থেকে বিএনপির প্রভাবশালী নেতা সাবেক পানিসম্পদমন্ত্রী মেজর জেনারেল (অব.) মজিদ-উল হক বিজয়ী হন। এর পর আসনটি বিএনপির হাতছাড়া হয়ে যায়।
পরের চার দফা নির্বাচনেই বিজয়ী হন আওয়ামী লীগের আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ ডাক্তার সিরাজুল আকবর।
আসনটি পুনরুদ্ধারে বিএনপি বারবার চেষ্টা করলেও কাজ হয়নি। তবে বিএনপির হাইকমান্ড এবারও নতুন প্রার্থী দিয়ে আসনটি দখলে নিতে চাইছে। একাদশ সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের পরিকল্পনাও বর্তমান এমপি মেজর জেনারেল (অব.) এটিএম আবদুল ওয়াহ্হাব এবং প্রধানমন্ত্রীর সহকারী একান্ত সচিব অ্যাডভোকেট সাইফুজ্জামান শিখরকে ঘিরেই।
১৯৯৬ সালে জাতীয় নির্বাচনে ডাক্তার সিরাজুল আকবর বিএনপির প্রভাবশালী মন্ত্রী মজিদ-উল হককে পরাজিত করেন। পরবর্তী সময়ে কেন্দ্রীয় নেতা অ্যাডভোকেট নিতাই রায় চৌধুরী ও পৌর মেয়র ইকবাল আকতার খান কাফুরকে প্রার্থী করেও বিএনপি আসনটি পুনরুদ্ধার করতে পরেনি।
২০১৪ সালের ৯ মার্চ চারবারের এমপি ডাক্তার আকবরের মৃত্যু হলে উপনির্বাচনে বিজয়ী হন আবদুল ওয়াহ্হাব। ভোটের আগে দলের সঙ্গে রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা খুব বেশি না থাকলেও আওয়ামী লীগের দুর্গ হওয়ায় নৌকা প্রতীক নিয়েই এমপি হন। কিন্তু দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে তিনি স্থানীয় নেতাকর্মীদের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
সহজ সরল এবং রাজনৈতিক জটিলতামুক্ত হিসেবে আবদুল ওয়াহ্হাব সবার কাছে প্রতিষ্ঠিত। নির্বাচনকে সামনে রেখে তৎপরতা না থাকলেও জেলা নেতাদের পাশ কাটিয়ে চলার অভিযোগ রয়েছে এমপির বিরুদ্ধে।
আসন্ন নির্বাচনের মনোনয়ন নিয়ে কথা হয় এমপি আবদুল ওয়াহ্হাবের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘ডা. আকবর ছিলেন মাগুরার কিংবদন্তি রাজনীতিক। তার মৃত্যুর পর জননেত্রী আমার ওপর আস্থা রেখেছেন। বিগত সময়ে নির্বাচনী এলাকার রাস্তাঘাট, বিদ্যুৎ সংযোগ স্থাপনের পাশাপাশি বিভিন্ন উন্নয়ন মূলক কাজের মধ্য দিয়ে নেত্রীর আস্থার প্রতিদানও দিয়েছি।
যে কারণে আগামী নির্বাচনে আমার মনোনয়ন না পাওয়ার কোনো আশঙ্কাই দেখি না।’
এদিকে আওয়ামী লীগের আরও অন্তত চারজন প্রার্থী আগামী নির্বাচনে মনোনয়ন পেতে জোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।
তাদের অন্যতম হচ্ছেন প্রধানমন্ত্রীর সহকারী একান্ত সচিব অ্যাডভোকেট সাইফুজ্জামান শিখর।
২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পর থেকেই মাগুরায় আলোচনার আসেন ছাত্রলীগের সাবেক কেন্দ্রীয় যুগ্ম সম্পাদক অ্যাডভোকেট সাইফুজ্জামান শিখর। জেলার সর্বত্রই নিজের উপস্থাপন করতে সক্ষম হয়েছেন তিনি।
কথা হয় মাগুরা জেলা আওয়ামী লীগের দফতর সম্পাদক অ্যাডভোকেট রাশেদ মাহমুদ শাহিনের সঙ্গে।
তিনি বলেন, ‘মাগুরা জেলার রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড আবর্তিত হচ্ছে সাইফুজ্জামান শিখরকে ঘিরেই। জেলার সব স্তরেই তিনি নিজের অপরিহার্যতা প্রমাণের সুযোগ পেয়েছেন। তাকে মনোনয়ন দিলে জেলায় আওয়ামী লীগের রাজনীতি নিরাপদ থাকবে।’
এ আসনে মনোনয়নপ্রত্যাশীদের মধ্যে মাগুরা জেলা পরিষদের সাবেক প্রশাসক আওয়ামী লীগের বর্ষীয়ান নেতা সৈয়দা সাজেদা চৌধুরীর নিকটাত্মীয় মাগুরা জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি অ্যাডভোকেট সৈয়দ শরিফুল ইসলাম অন্যতম।
তিনি ছাড়াও মনোনয়ন চাইবেন মাগুরা সদর উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান জেলা আওয়ামী লীগের আরেক সহসভাপতি আবু নাসির বাবলু এবং বৃহত্তর যশোর সমিতির সাধারণ সম্পাদক ঢাকায় বসবাসরত অ্যাডভোকেট কাজি রফিক। এলাকার সঙ্গে যোগাযোগ বৃদ্ধির পাশাপাশি কেন্দ্রের সঙ্গেও লবিং চালিয়ে যাচ্ছেন তারা।
জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান পঙ্কজ কুমার কুণ্ডু বলেন, ‘বর্তমান এমপি মন্দ লোক না হলেও রাজনৈতিক অনভিজ্ঞতার কারণে দল ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
যে কারণে জেলা আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও দীর্ঘদিনের ভোট-ব্যাংকটি ধরে রাখতে আগামী নির্বাচনে যোগ্য প্রার্থী নির্বাচন সম্ভব হলে দলীয় নেতাকর্মীরা আওয়ামী লীগের প্রার্থীকে বিজয়ী করতে কাজ করবে।’
মাগুরায় বিএনপি রাজনীতির স্তম্ভ হিসেবে পরিচিত সাবেক মন্ত্রী মজিদ-উল হক জেলার উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখলেও রাজনীতির দুষ্টচক্রে পড়ে তিনি দিনে দিনে কর্মী বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন। যার প্রত্যক্ষ প্রভাব পড়ে ’৯৬ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে।
সর্বশেষ ২০০৮ সালের নির্বাচনে ধানের শীষ নিয়ে লড়ে একসময়ের জাকের পার্টি নেতা মাগুরা পৌর চেয়ারম্যান ইকবাল আকতার খান কাফুর পরাজিত হন। আগামী নির্বাচনেও তিনি মনোনয়ন চাইবেন।
ইকবাল আকতার খান কাফুর যুগান্তরকে বলেন, ‘একাধিকবার মাগুরা পৌরসভার চেয়ারম্যান হওয়ার সুবাদে স্থানীয় সাধারণ মানুষের পাশে দাঁড়ানোর সুযোগ পেয়েছি। ওয়ান-ইলেভেনের পর ইলেকশন ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের মাধ্যমে বিএনপিকে হারানো হয়েছে।
সে নির্বাচনে দলীয় চেয়ারপারসন আমার ওপর আস্থা রেখেছিলেন। আগামী নির্বাচনেও মনোনয়ন দিলে আসনটি পুনরুদ্ধার করতে সক্ষম হব।’জেলার আরও হাফ ডজন বিএনপি নেতা দৌড়ঝাঁপ শুরু করেছেন।
এরা হলেন : জেলা বিএনপির আহ্বায়ক কমিটির সদস্য ইনসেপ্টা ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেডের কর্মকর্তা মনোয়ার হোসেন খান। মনোয়ার হোসেন খান মোবাইল ফোনে বলেন, ‘ইতিবাচক রাজনীতিতে বিশ্বাসী হলেও মিথ্যা মামলার শিকার হয়েছি। সব সময় দলমত নির্বিশেষে সাধারণ মানুষের বিপদে পাশে দাঁড়িয়েছি। তৃণমূলের সঙ্গেও রয়েছে নিবিড় সম্পর্ক। যে কারণে আমাকে মনোনয়ন দিলে অবশ্যই বিজয়ী হব।’
আরেক মনোনয়নপ্রত্যাশী জেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি দলের চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য জিয়া পরিষদের প্রতিষ্ঠাতা কবির মুরাদ। নির্বাচনী ভাবনা নিয়ে কবির মুরাদ বলেন, ‘বর্তমান সরকারের জেল-জুলুমের ভয় না করে বিএনপির চরম দুঃসময়ে শক্ত হাতে দলের হাল ধরেছি।
দলের একজন প্রবীণ নেতা হিসেবে আগামী নির্বাচনে মনোনয়ন পেলে ধানের শীষ নেত্রীর হাতেই তুলে দেব বলে বিশ্বাস।’ অন্যদের মধ্যে জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক আহসান হাবিব কিশোর এবং সৈয়দ মোকাদ্দেস আলি, শ্রীপুর উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক বদরুল আলম হিরো দলীয় মনোনয়ন চাইবেন।
মাগুরা জেলা বিএনপির আহ্বায়ক সৈয়দ আলি করিম বলেন, ‘বিএনপির প্রার্থী অনেক। কিন্তু সরকারি দলের হামলা মামলা আর নির্যাতনের কারণে তারা সঠিকভাবে দলের কর্মকাণ্ড চালাতে পারছেন না। সুষ্ঠু রাজনৈতিক পরিবেশ ফিরে এলে এবং নির্বাচন অবাধ ও নিরপেক্ষ হলে অবশ্যই মাগুরা-১ আসনটি আওয়ামী লীগের হাতছাড়া হবে।’
এ আসনে জাতীয় পার্টির প্রার্থী হচ্ছেন জেলা জাতীয় পার্টির সাধারণ সম্পাদক ও দলের চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের উপদেষ্টা অ্যাডভোকেট হাসান সিরাজ সুজা। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, এ আসনে জাতীয় পার্টির ১০ শতাংশের বেশি ভোট রয়েছে।
একানব্বই-পরবর্তী প্রতিটি নির্বাচনেই ফলাফল নির্ধারণে এ দলের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। আগামী নির্বাচনেও ভূমিকা থাকবে বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের অভিমত।