• সোমবার, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ০৬:০৫ পূর্বাহ্ন
শিরোনাম:

সংগ্রামী কিশোরীর গল্প

আপডেটঃ : শনিবার, ৪ নভেম্বর, ২০১৭

সাজেদার বড় বোনকে ১৪ বছরে বয়সেই বিয়ে দেওয়া হয়। ফলে যৌনরোগসহ নানাবিধ সমস্যায় জর্জড়িত হয়ে পড়ে সে। স্বামী-সংসার সম্পর্কে সম্যক ধারণা না থাকা এবং ঘর কন্যার কাজে অপরিপক্ক থাকায় দেখা দেয় সংসারে অশান্তি-দুর্ভোগ। এ ঘটনার পরও স্কুলজীবনেই সাজেদাকেও বিয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা করে তার বাবা-মা। বাল্যবিয়ের কুফল সম্পর্কে বাবা-মাকে বোঝাতে সক্ষম হয়ে নিজেই নিজেকে বাল্যবিয়ে থেকে রক্ষা করেন। তবে নিজেকে বাল্যবিয়ে থেকে রক্ষা করেই বিরত থাকেননি এই সংগ্রামী কিশোরী, গড়ে তুলেছেন একটি সামাজিক আন্দোলন। যে আন্দোলনের মাধ্যমে অভিভাবকদের বুঝিয়ে নিজ এলাকার বাল্যবিয়ে বন্ধ, ইভটিজিং প্রতিরোধ, ঝরে পড়া শিশুদের স্কুলগামী করা, মাদকাসক্ত যুব-যুবাকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনাসহ বিভিন্ন সামাজিক সচেতনতামূলক কাজে নেমে পড়ে সে। তাকে নিয়েই আমাদের আজকের প্রচ্ছদ গদ্য—

 

গড়ে তোলেন সামাজিক আন্দোলন

 

সানজিদা আক্তার সাজেদা। বরগুনার বুড়িচর ইউনিয়নের মাইঠা গ্রামের দিনমজুর রিকশাচালক সানু মিয়া আর গৃহবধূ ফাতেমা বেগমের মেয়ে। বয়স মাত্র ১৭। অন্যসব মেয়ের মতোই দিন কাটাচ্ছিল সে। কিন্তু প্রাপ্তবয়স্ক না হতেই হঠাত্ করে তার বোনকে বিয়ে দেওয়া হয়। সেসময়ে সাজেদা তারা বাবা-মাকে বাঁধা দিলেও তারা তার কোনো কথাই শুনেনি, বরং বেশ খোশ মেজাজে বিয়ে দিয়ে দেন। কিন্তু বিয়ের কিছুদিন পর খবর আসে তার বোন অসুস্থতায় জর্জরিত। তখন থেকেই বাল্যবিয়ে ঠেকানোর দৃঢ় প্রতিজ্ঞা করেন তিনি। গড়ে তোলেন সামাজিক আন্দোলন। অল্প বয়সেই বাল্যবিয়ে প্রতিরোধে ইন্টারন্যাশনাল চিলড্রেন পিস প্রাইজ-এর জন্য মনোনীত হয়েছেন। তিনি এখন বরগুনা সরকারি মহিলা কলেজের বাণিজ্য বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী।

 

‘প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোধ শ্রেয়, বাল্যবিয়ে ঘটার পূর্বেই অভিভাবকদের এর কুফল সম্পর্কে সচেতন করে প্রতিরোধ করতে হবে। এরপরও যে প্রকারেই হোক বাল্যবিয়ে বন্ধ করতে হবে।’—এমন দৃঢ় অঙ্গীকার ব্যক্ত করলেন বরগুনা সদর উপজেলার ৬নং বুড়িরচর ইউনিয়নের মাইঠা গ্রামের সংগ্রামী কিশোরী সাজেদা আক্তার। সাজেদার প্রতিজ্ঞা, তার নিজগ্রাম মাইঠাকে বাল্যবিয়ে, শিশু নির্যাতন, ইভটিজিং মুক্ত এবং যুব বান্ধব হিসেবে গড়ে তোলা হবে। যে গ্রামে সকল যুবক-যুবতী তাদের প্রাপ্য অধিকার নিয়ে স্বাভাবিকভাবে বেড়ে উঠবে। তাতে বাল্যবিয়ের শিকার হয়ে আর কোনো কিশোরী অকালে মারা যাবে না।

 

নিজের বিয়ে নিজেই ঠেকান

 

একান্ত সাক্ষাত্কারে দৈনিক ইত্তেফাককে সাজেদা আক্তার জানান, তার বড় বোনকে বিয়ে দেওয়ার পর অনেককিছুই ঘটে। যে কারণে সংসারে দিনদিন অশান্তি বেড়েই চলে। এ ঘটনার পরও স্কুলজীবনেই সাজেদাকেও বিয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা করে তার বাবা-মা। বাল্যবিয়ের কুফল সম্পর্কে বাবা-মাকে বোঝাতে সক্ষম হয়ে নিজেই নিজেকে বাল্যবিয়ে থেকে রক্ষা করেন। তবে নিজেকে বাল্যবিয়ে থেকে রক্ষা করেই বিরত থাকেনি সংগ্রামী কিশোরী সাজেদা। অভিভাবকদের বুঝিয়ে নিজ এলাকার বাল্যবিয়ে বন্ধ, ইভটিজিং প্রতিরোধ, ঝরে পড়া শিশুদের স্কুলগামী করা, মাদকাসক্ত যুব-যুবাকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনাসহ বিভিন্ন সামাজিক সচেতনতামূলক কাজে নেমে পড়ে সে।

 

এরই ধারাবাহিকতায় ২০১০ সালে প্ল্যান-ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ’-এর ‘আরলি চাইল্ডহুড কেয়ার অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট’ প্রকল্পের মাইঠা শিশু সংগঠনের সদস্য হন সানজিদা আক্তার সাজেদা। এরপর ওই সংগঠনের সভাপতি নির্বাচিত হয় সাজেদা। এ সময় শিশু অধিকার, ইভটিজিং প্রতিরোধসহ শিশু সুরক্ষায় সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। সাজেদা আক্তার ২০১২ সালে প্ল্যান-ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ’-এর কারিগরি সহযোগিতায় স্যাপ বাংলাদেশের বাস্তবায়নে কৈশর যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য অধিকার সহায়ক প্রকল্পের অধীনে মাইঠা সূর্যের আলো যুব ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন এবং সূর্য শিখা যুব গ্রুপের পিয়ার অ্যাডুকেটর। এছাড়া ইউনিসেফের শিশু পরিষদের ইউনিয়ন টিম লিডার, বরগুনা সরকারি মহিলা কলেজের রোভার স্কাউটসের সহ-সিনিয়র রোভারমেট এবং ইউনিয়ন যুব ফোরামের কার্যকরি সদস্য সাজেদা স্থানীয় সূর্যের আলো যুব ক্লাব সদস্যদের নিয়ে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও প্রশাসনের সহযোগিতায় এ পর্যন্ত ১০৭টি বাল্যবিয়ে বন্ধ, ৮৭ জন ঝরে পড়া শিশুকে স্কুলগামী করা, ১৪ জন মাদকাসক্ত যুব-যুবাকে মাদকাসক্ত থেকে ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছে। পাশাপাশি নানা সামাজিক সচেতনতামূলক কর্মকাণ্ডের নেতৃত্ব দিয়ে সর্বমহলে প্রশংসিত হচ্ছেন।

 

এসব সামাজিক কর্মকাণ্ডের সম্মাননা স্বরূপ গত ২ অক্টোবর বরগুনা প্রেসক্লাব একদিনের জন্য সভাপতির (প্রতীকী) দায়িত্ব পালনের সুযোগ পান সানজিদা আক্তার সাজেদা। এ দায়িত্ব পালনকালে বরগুনা জেলা প্রশাসন কর্তৃক আয়োজিত জাতীয় উত্পাদনশীলতা দিবসের আলোচনা সভা, জেলা শিশু একাডেমি কর্তৃক আয়োজিত বিশ্ব শিশু দিবসের র্যালি এবং জেলা মহিলা ও শিশুবিষয়ক কর্মকর্তার সাথে প্রেসক্লাব সভাপতি হিসেবে সৌজন্য সাক্ষাত্ করেন সাজেদা আক্তার। এ সময় প্রেসক্লাবের সদস্যদের বিশেষ সভায় সভাপতিত্ব করেন সাজেদা। সাজেদা তার অনুভূতি ব্যক্ত করতে গিয়ে বলেন, ‘আমি অত্যন্ত আনন্দিত যে, একজন মেয়ে শিশু হিসেবে আজকে আমি বরগুনা প্রেসক্লাবের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছি। আমি জেনেছি সাংবাদিকরা কিভাবে তথ্য সংগ্রহ করে এবং সত্য বিষয়টি সকলের সামনে তুলে ধরে, যা সবার পক্ষে সম্ভব নয়। এ দায়িত্ব পালনের মাধ্যমে আমি যেমন শিখেছি তেমনি উত্সাহিত হয়েছি, যা সারাদেশের নারী শিশুদের উত্সাহিত করবে এবং একদিন আমাদের দেশ অবশ্যই সমৃদ্ধশালী হবে। ভবিষ্যতে সাজেদা শিক্ষক হতে চান, পাশাপাশি নারী উন্নয়নে কাজ করার অঙ্গীকার ব্যক্ত করেন।

 

সামাজিক কর্মকাণ্ডের স্বীকৃতি

 

সাজেদা আক্তারের কাজে উত্সাহ জোগাতে গত ৫ অক্টোবর বেসরকারি সংগঠন প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ-এর বরিশাল বিভাগীয় ম্যানেজারের দায়িত্ব পালনের সুযোগ পান। এ সময় সাজেদা প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের একজন কর্মকর্তা হিসেবে বরিশাল বিভাগীয় কমিশনার মো. শহীদুজ্জামানের সাথে সৌজন্য সাক্ষাত্ করতে গেলে তিনি সাজেদার সামাজিক কর্মকাণ্ডের স্বীকৃতি হিসেবে ৭ হাজার টাকার চেক প্রদান করেন।

 

এদিকে, জাতীয় শিশু অধিকার সপ্তাহ উপলক্ষে গত ১২ অক্টোবর কেন্দ্রীয় শিশু একাডেমি মিলনায়তনে শিশু একাডেমির চেয়ারম্যান কথাশিল্পী ড. সেলিনা হোসেনের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠিত সেমিনারে বাল্যবিয়ে প্রতিরোধে বক্তব্য রাখেন সানজিদা আক্তার সাজেদা। এ সময় সাবেক মন্ত্রী ডা. দিপু মনি, এমপিসহ দেশের খ্যাতনামা ব্যক্তিবর্গ উপস্থিত ছিলেন।

 

বাল্যবিয়ে প্রতিরোধে কি ধরনের প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হয়েছেন? এমন প্রশ্নে সাজেদা বলেন, ‘এক্ষেত্রে অভিভাবকদের অসচেতনতা, ধর্মীয় কুসংস্কার, সামাজিক ব্যবস্থা প্রভৃতি বেশি দায়ী।’ কী কারণে বাবা-মা তাদের কিশোরী মেয়েকে বাল্য দিচ্ছেন এ ব্যাপারে সাজেদা জানান, বখাটের উত্পাত, ইভটিজিং, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যেতে দুর্বৃত্তদের অশালীন আচরণ, এমনকি জোরপূর্বক ধর্ষণের ঘটনাও ঘটছে। আর এসব কারণে বাধ্য হয়ে বাবা-মা তাদের অপ্রাপ্ত বয়স্ক কন্যাদের বিয়ে দিয়ে দায়মুক্ত হতে চেষ্টা করেন। এ ব্যাপারে জনপ্রতিনিধি, সুশীল সমাজ, প্রশাসন সক্রিয় ভূমিকা পালন করলে বাল্যবিয়ে প্রতিরোধ অনেকটা সহজ হবে বলে জানান সাজেদা।

 

বরগুনা প্রেসক্লাবের সভাপতি জাকির হোসেন মিরাজ বলেন, ‘নারীর নেতৃত্ব, নারীর অংশগ্রহণ, সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং তাদের বিকশিত করার লক্ষ্যেই বরগুনা প্রেসক্লাব সুশীল সমাজের অংশ হিসেবে সাজেদাকে প্রতীকী দায়িত্ব পালনের সুযোগ দিয়েছি।’ প্রেসক্লাব সভাপতি আরও বলেন, ‘সাজেদা যাতে তার কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে আরও এগিয়ে যেতে পারে সে ব্যাপারে বরগুনা প্রেসক্লাব সার্বিক সহযোগিতা করবে।’

 

বরগুনা সরকারি মহিলা কলেজের দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্রী মুক্তা বলেন, ‘১ বছর আগে আমার বাবা-মা আমাকে বিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে। এ সময় আমি সাজেদা আপুকে ফোন দিই এবং বলি আমি পড়ালেখা করতে চাই। তখন সে (সাজেদা) আমাদের বাড়িতে গেলে আমার বাবা-মা প্রথমে ক্ষিপ্ত হয়ে যায়। পরে তাদেরকে বাল্যবিয়ের কুফলগুলো জানানো হলে তারা বুঝতে পারে এবং বিয়ে বন্ধ হয়ে যায়। আমি সাজেদা আপুর কারণেই বাল্যবিয়ে থেকে রক্ষা পেয়ে আজ লেখাপড়া করতে পারছি।’

 

বরগুনা জেলা মহিলাবিষয়ক কর্মকর্তা মেহেরুন্নাহার মুন্নি বলেন, ‘সাজেদা আক্তার যে বয়সে বাল্যবিয়ে প্রতিরোধ, শিশু নির্যাতন বন্ধ এবং মাদক বিরোধীসহ বিভিন্ন সামাজিক কর্মকাণ্ডে তত্পরতা চালাচ্ছে। এটা আমাদের গর্বের বিষয়। আমি মনে করি আমাদের সকলের ওকে সহযোগিতা করা উচিত।’


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এই ক্যাটাগরির আরো নিউজ