বর্ষাকালে আম কাঁঠালের গন্ধে ম ম করে চারদিক। কাঁচা হোক কিংবা পাকা, কাঁঠালের স্বাদের গন্ধে মজে থাকে। জাতীয় ফল কাঁঠাল যুগ যুগ ধরে ফল ও তরকারি হিসেবে কদর পেয়ে আসছে। ভিটামিন সি, ম্যাগনেসিয়াম, পটাসিয়ামসহ বিভিন্ন গুণাগুণে ঠাসা কাঁঠালের জুড়ি মেলা ভার। প্রোটিন, ভিটামিন, জিঙ্ক ও পটাসিয়াম সমৃদ্ধ এই ফল গরমে শরীর সুস্থ রাখার পক্ষে একেবারে আদর্শ। কাঁঠালের বিচিতে দ্রবণীয় এবং অদ্রবণীয় উভয় ফাইবার থাকে। এ ধরনের ফাইবার বাওয়েল মুভমেন্ট বা অন্ত্রের কার্যকলাপ সঠিকভাবে পরিচালনা করে। অদ্রবণীয় ফাইবারগুলোকে প্রিবায়োটিক হিসেবে বিবেচনা করা হয় অর্থাৎ এ ফাইবার অন্ত্রে থাকা উপকারী ব্যাকটেরিয়াদের খাদ্য হিসেবে কাজ করে। এ ফাইবারগুলো ইনফ্ল্যামেটরি বাওয়েল ডিজিজ এবং হেমোরয়েডের লক্ষণ থেকে মুক্তি দিতে পারে।
শরীরের জন্য ভীষণ উপকারী এই ফল খেতে অনেকেই ভালবাসলেও বীজ ফেলে দেন। কিন্তু এমন না করাই ভাল। কারণ উপকারিতার মাপকাঠিতে মোটেই কম যায় না কাঁঠালের বীজ। বরং কাঁঠালের বীজগুলো ভাল করে ধুয়ে সংরক্ষণ করে রাখুন।
বিশেষ করে এই বর্ষায় রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করতে কাঁঠালের বীজের উপকারিতা বহু। মাছ, মাংস যাদের কম খাওয়া হয় তাদের জন্য আমিষের চাহিদা মেটাতে কাঁঠালের বিচি উৎকৃষ্ট খাবার।
কাঁঠালের বীজে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে স্টার্চ, প্রোটিন, ভিটামিন, মিনারেল এবং অ্যান্টি–অক্সিডেন্ট। এক আউন্স বা ২৮ গ্রাম কাঁঠালের বিচিতে থাকে মাত্র ৫৩ ক্যালরি, ১১ গ্রাম কার্বোহাইড্রেট, ২ গ্রাম প্রোটিন, দশমিক ৫ গ্রাম ফাইবার, দৈনিক পুষ্টি চাহিদার ৮% রিবোফ্লাভিন, ৭% থায়ামিন, ৫% ম্যাগনেসিয়াম এবং ৪% ফসফরাস।
বেক করে কিংবা ভেজে খাওয়া ছাড়াও বিভিন্ন রান্নায় কাঠালের বীজ ব্যবহার করতে পারেন। পাঁচমিশেলি সব্জি কিংবা মুগডালে দিয়ে খেলে ভাল লাগবে। কাঁঠালের বীজের ভর্তা, কিংবা শুটকি দিয়ে তরকারি খেতে অনেকেই পছন্দ করেন। শুধু পছন্দ নয়, এর উপকারিতা সম্পর্কে জানলে অবাক হতেই হবে। চলুন জেনে নেয়া যাক, কাঁঠালের বীজের উপকারিতাগুলো।
ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ করে
ডায়াবেটিসের রোগীদের জন্যও কাঁঠালের বীজ বেশ উপকারি। কাঁঠালের বিচিতে থাকা ফাইবার ধমনি থেকে কার্বোহাইড্রেট শুষে নেয়। ফলে রক্তে গ্লুকোজের পরিমাণ বেশি বাড়তে পারে না। ডায়াবেটিসের সমস্যায় ভুগে থাকলে প্রায়ই খাদ্যতালিকায় রাখতে পারেন কাঁঠালের বীজ।
রক্তস্বল্পতা দূর করে
প্রতিদিনের খাদ্য তালিকায় কাঁঠালের বীজ রাখলে শরীরের আয়রনের মাত্রা বাড়বে। এই বীজে প্রচুর পরিমাণে আয়রন থাকে। কাঁঠালের বীজ হিমোগ্লোবিনের একটি উপাদান। ফলে এটি খেলে রক্তস্বল্পতা দূরে হবে। আয়রন সুস্থ রাখবে আপনার মস্তিষ্ক ও হৃদযন্ত্রকে।
মস্তিষ্ক ও হার্টের সুস্থতায়
প্রতিদিনের খাবারে কাঁঠালের বীজ রাখলে আপনার শরীরের আয়রনের মাত্রা বাড়বে। এই বীজে প্রচুর পরিমাণে আয়রন থাকে। কাঁঠালের বীজ হিমোগ্লোবিনের একটি উপাদান। আয়রন সুস্থ রাখবে আপনার মস্তিষ্ক ও হার্টকেও।
চোখের জ্যোতি বাড়ায়
কাঁঠালের বীজে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন এ থাকায় এটি শিশুদের চোখের স্বাভাবিক দৃষ্টিশক্তি ও শরীরের স্বাভাবিক বৃদ্ধিতে সহায়ক হিসেবে কাজ করে। চোখের জ্যোতি বাড়িয়ে তুলতেও কাঁঠালের বীজ কার্যকরী। চোখের সমস্যা থাকলে কাঁঠালের বীজ খেতে পারেন।
যৌন চিকিৎসায়
যুগ যুগ ধরে নানা ধরনের যৌনব্যাধিতে কাঁঠালের বীজের ব্যবহার হয়ে আসছে। এশিয়ার অনেক দেশে প্রচলিত চিকিৎসার একটি অন্যতম উপকরণ এটি। কাঁঠালে থাকা আয়রনও এ কাজে সহায়ক।
পেশী গঠন
উচ্চমানের প্রোটিন সমৃদ্ধ কোলেস্টেরলবিহীন বীজটি ডায়েট চার্টে থাকলে তৈরি হবে পেশীবহুল শরীর। মিলবে ক্যালরিও। যারা নিয়মিত শরীরচর্চা করেন, তাদের জন্য কাঁঠাল বীজ হতে পারে অনেক উপকারী এক খাবার।
মানসিক চাপ কমায়
মানসিক চাপ কমাতে কাঁঠালের বীজ খুবই উপকারী। কাঁঠালের বীজ প্রোটিন ও মাইক্রোনিউট্রিয়েন্টসে ঠাসা। যা মস্তিষ্কের ক্যামিকেলের ভারসাম্য বজায় রেখে শরীর মানসিক চাপ নিয়ন্ত্রণে রাখে।
সংক্রমণ রোধে
বর্ষাকালে বিভিন্ন রোগের সংক্রমণ বাড়ে। এই বীজ শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে সাহায্য করে। অনেকেরই হয়তো জানা নেই, কাঁঠাল বীজ বিভিন্ন সংক্রমণ রোধে সাহায্য করে। নিয়মিত কাঁঠালের বীজ খেলে বর্ষা মৌসুমে বিভিন্ন সংক্রমণ থেকে রক্ষা পাবেন।
স্বাস্থ্যকর চুল ও ভালো দৃষ্টিশক্তি
কাঁঠালের বীজে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন এ থাকে। চোখের স্বাস্থ্যের জন্য এই ভিটামিন অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। এটি রাতকানা কাটাতেও সাহায্য করে। শুধু চোখ নয়, চুলের স্বাস্থ্যও ভালো রাখে ভিটামিন এ। চুলের আগা ফেটে যাওয়া রোধ করে এই ভিটামিন।
হজমশক্তি বাড়ায়
হজমের সমস্যা রোধে খুবই কার্যকরী কাঁঠালের বীজ। এটি রোদে শুকিয়ে গুঁড়া করে পাউডারের মতো করে ফেলুন। হজমে সমস্যা দেখা দিলে ঘরোয়া এই টোটকা প্রয়োগ করে দেখতে পারেন। শুধু কাঁঠালের বীজে কমবে কোষ্ঠকাঠিন্য সমস্যা। কারণ কাঁঠালের মতো এর বীজেও রয়েছে প্রচুর আঁশ।
মেটাবলিজম বাড়ায়
কাঁঠালের বীজে কার্বোহাইড্রেট থাকায় এটি শক্তি বাড়ায়৷ উপরন্তু কাঁঠালের বীজে বি-কমপ্লেক্স ভিটামিন রয়েছে, যা খাদ্যকে শক্তিতে রূপান্তরিত করতে এবং স্বাস্থ্যকর বিপাককে সমর্থন করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
বলিরেখা দূর করে
ত্বকে বলিরেখা দূর করতে জাদুর মতো কাজ করে কাঁঠালের বীজ। একটি বীজ কোল্ড ক্রিমের সঙ্গে গ্রাইন্ড করে একটা পেস্ট তৈরি করুন। তারপর সেটি নিয়মিত ত্বকে লাগান। বলিরেখা বাপ বাপ বলে পালাতে বাধ্য। কাঁঠালের বীজ ত্বককে করে সজীব ও তরতাজা। দুই-একটি বীজ সামান্য দুধ ও মধুতে কিছুক্ষণ ভিজিয়ে রেখে, সেটা দিয়ে একটি পেস্ট তৈরি করুন। সেই পেস্ট সারা মুখে লাগিয়ে শুকোতে দিন। তারপর উষ্ণ গরম পানিতে মুখটা ধুয়ে ফেলুন। দেখবেন, ত্বকের উজ্জ্বলতা বেড়ে দ্বিগুণ হয়ে যাবে।
ক্যানসার প্রতিরোধ করে
চীন ও ভারতে কাঁঠালের বীজ অ্যালকোহলের বিষক্রিয়া দূরীকরণের অ্যান্টিটোড প্রস্তুতে ব্যবহৃত হয়। কাঁঠালের বিচিতে জ্যাকালিন নামের যেই গুরুত্বপূর্ণ ল্যাকটিন আছে, তা এইচআইভি আক্রান্তদের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে সাহায্য করে। কাঁঠালের বীজে ক্যানসার প্রতিরোধক ক্ষমতাও রয়েছে।
যেভাবে সংরক্ষণ করবেন
কাঁঠালের বীজ ভালো করে ধুয়ে শুকিয়ে নিন। দুই দিন রোদে দিলে পরবর্তী ২ সপ্তাহের জন্য ভালো থাকবে। রোদে শুকানো বীজ ঘরের তাপমাত্রায় একটি শীতল ও শুষ্ক জায়গায় রাখুন। ভালো করে শুকালে উপরের সাদা খোসা ছাড়িয়ে নিন। ভেতরের লালচে খোসা ছাড়ানোর দরকার নেই। এছাড়া কাঁঠালের বীজ সেদ্ধ করে ডিপ ফ্রিজে অনেক দিন রেখে দেওয়া যায়। আবার এটি চুলায় রোস্ট করে, মানে তাওয়ার ওপর ভালো করে সেঁকা দিয়ে শুকিয়ে গুঁড়া করে রাখা যায়। যেকোনো তরকারি রান্নার সময় এটি মিশিয়ে দিলে সেই খাবারের স্বাদ এবং পুষ্টিমান অনেক বেড়ে যাবে।