নাফ নদীর ওপারে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য। আগে নাম ছিল আরাকান। কোনো এক সময়ের রোসাং বা রোহাং। সেই সূত্রে সেখানকার বাসিন্দাদের বলা হত রোহিঙ্গা। রোহিঙ্গারা শতভাগ মুসলমান। তারা এখন নিজ দেশে পরবাসী। তাদের নাগরিক অধিকার কেড়ে নিয়েছে মিয়ানমারের মগ শাসকরা। গত আগস্ট থেকে নতুন করে মিয়ানমারের উগ্র বৌদ্ধ ভিক্ষু, সন্ত্রাসী মগ, জল্লাদ সেনাবাহিনী আর অন সাং সূচির সরকার একজোট হয়ে রোহিঙ্গাদের উপর যে হত্যা, লুটতরাজ, অগ্নিসংযোগ, ধর্ষণ, নারী ও শিশুর অঙ্গহানির তান্ডব চালাচ্ছে, তা ভাষায় প্রকাশ করা অসম্ভব। মিডিয়ায় ও খবরের কাগজে তার যেটুকু বিভৎস ছবি প্রকাশ হতে পারছে, তা দেখে বিশ্ব বিবেক স্তম্ভিত। চারিদিকে নিন্দা ও ক্ষোভের ঝড় বয়ে যাচ্ছে। বিশ^্বসম্প্রদায় এই পৈশাচিক তান্ডবকে গণহত্যা, জাতিগত নির্মূল অভিযান বলে আখ্যায়িত করেছে।
তবে নাফ নদীর এপারে বাংলাদেশ ভূখন্ডে বিরাজ করছে সম্পূর্ণ ভিন্ন চিত্র। রাখাইনে রাজ্যের মৃত্যুকুপ থেকে প্রাণ নিয়ে পালিয়ে যারা বাংলাদেশ ভূখন্ডে প্রবেশ করছে, তাদের জন্য প্রাণের দুয়ার খুলে দিয়েছে সমগ্র বাংলাদেশ। মজলুম রোহিঙ্গা ভাইবোনদের সাহায্যের জন্য সাড়া জেগেছে বাংলাদেশের শহরে গ্রামে আনাচে কানাচে। তাদের হাতে ত্রাণসামগ্রী পৌঁছানোর জন্য এখানকার প্রতিটি মানুষ জেগে উঠেছে দরদমাখা হৃদয় নিয়ে। বিভিন্ন পাড়া মহল্লা, সমিতি সংস্থার ব্যানার ছাড়াও ব্যক্তিগত উদ্যোগে ত্রাণ সমগ্রী ও নগদ অর্থ পৌঁছে দিচ্ছে প্রতিদিন অগণিত মানুষ। গণহত্যার তান্ডবের জেরে শরণার্থীর স্রোত শুরু হওয়ার পর থেকে কক্সবাজার জেলা প্রশাসন ও পুলিশসহ বাংলাদেশের সীমান্ত প্রহরী বিজিবি জনগণের সাথে একাত্ম হয়ে অসহায় রোহিঙ্গা শরণার্থীদের আশ্রয় দেয়ার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা চালাচ্ছে। পরবর্তীতে শরণার্থী শিবির ও ত্রাণ বিতরণে শৃঙ্খলা আনার জন্য নিয়োজিত হয়েছে সেনাবাহিনীর জওয়ানরা। সবমিলে বাংলাদেশের সর্বস্তরের জনগণ লক্ষ লক্ষ শরণার্থীকে গ্রহণ করে যে উদারতা দেখিয়েছে ও দেখাচ্ছে, তা বর্তমান পৃথিবীতে নজিরবিহীন।
বাইরের দুনিয়ায় অনেক সমৃদ্ধ দেশের খবর মিডিয়ায় আসে। সেখানে বড় ধরনের কোনো জলোচ্ছ¡াস হলে বা প্রাকৃতিক দুর্যোগ দেখা দিলে অরাজক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়, লুটতরাজ থামানোর জন্য সেনাবাহিনী নামিয়ে কার্ফু জারি করতে হয়। কিন্তু বাংলাদেশের মত ঘনবসতির গরীব দেশে এক সঙ্গে পাঁচ লক্ষাধিক শরণার্থীকে বরণ করার জন্য জনসাধারণের মাঝে যে স্বতঃস্ফুর্ত সাড়া, হৃদয় নিংড়ানো ভালোবাসা আর ভ্রাতৃত্ব ও মমত্ববোধের জোয়ার বয়ে যাচ্ছে, তাতে বিশ^বাসী আজ হতবাক। এ কথা আমাদের মুখের দাবি নয়; বরং জাতিসংঘ শরনার্থী বিষয়ক কমিশনের প্রধানের মুখ থেকেই উচ্চারিত হয়েছে বাংলাদেশ ও তার জনগণের এই অভাবনীয় উদারতার স্বীকৃতি।
জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআর-এর হাইকমিশনার ফিলিপ্পো গ্র্যান্ডি বলেন, শরণার্থীর প্রতি বাংলাদেশের মানুষ যে মমত্ববোধ দেখিয়েছে; তা আমি আমার কর্মজীবনে কখনো দেখিনি। গেল ২৪ সেপ্টেম্বর রোববার কক্সাবাজারে ইউএনএইচসিআর কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে তিনি এ কথা বলেন। শরণার্থী আগমনের জন্য সীমান্ত খুলে দেয়ায় তিনি বাংলাদেশের প্রতি গভীর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। রোহিঙ্গাদের ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির জন্য তিনি মিয়ানমারের সহিংসতাকে দায়ী করেন। তিনি আরো বলেন, বিশে^র অনেক দেশ যেখানে শরণার্থীদের প্রতি শত্রæ ভাবাপন্ন, সেখানে বাংলাদেশের সরকার ও মানুষ যে ভ্রাতৃত্ব ও মমত্ববোধ দেখিয়েছে, তা উপেক্ষা করার সুযোগ নেই। তিনি বলেন, এই মুহূর্তে ত্রাণ তৎপরতা কিছুটা অগোছালো মনে হয়েছে। কিন্তু মানুষের সহযোগিতা খাটো করে দেখা যাবে না। এ সহযোগিতার সঙ্গে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা যুক্ত হওয়া প্রয়োজন। জাতিসংঘ শরণার্থী বিষয়ক হাইকমিশনার আরো বলেন, এই ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির জন্য সুস্পষ্টভাবে মিয়ানমারের সহিংসতা দায়ী। এখনই সহিংসতা বন্ধ করতে হবে এবং মানবাধিকার সংস্থাগুলোকে রাখাইনের উত্তরে প্রবেশ করতে দিতে হবে। ইয়াঙ্গুনে ইউএনএইচসিআর এর অফিস আছে; কিন্তু তাদের চলাচল নিয়ন্ত্রিত। উল্লেখ্য যে, এর আগে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের আশ্রয় দানের জন্য বাংলাদেশের প্রশংসা করেছে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য কমনওয়েলথসহ বিভিন্ন দেশ ও আন্তর্জাতিক সংস্থা।
কেবল এবারেই নয়; বরং পূর্ব থেকেই সমসংখ্যক রোহিঙ্গা শরণার্থী বাংলাদেশের মাটিতে অবস্থান করছে। এরপরও সম্পূর্ণ মানবিক কারণে অসহায় মানুষের প্রতি প্রাণ উজাড় করার যে দৃষ্টান্ত আজ বাংলাদেশ স্থাপন করেছে তা বিশ^সমাজে এই গরীব দেশের বিরাট অর্জন, যার স্বীকৃতি আন্তর্জাতিক মহল থেকে আমরা পেয়েছি ও পাচ্ছি। এই স্বীকৃতি ও আস্থার কারণেই জাতিসংঘ উদ্বাস্ত বিষয়ক হাইকমিশনার বাংলাদেশকে সহায়তা দানের জন্য বিশ^ সম্প্রদায়ের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। মুসলিম দেশগুলোর মাঝে অতীতের ওসমানী খেলাফতের ঐতিহ্যের ধারক তুরস্ক একাই এক লাখ শরণার্থীর আবাসনের ব্যবস্থা করার ঘোষণা দিয়েছে। এ ছাড়া বিভিন্ন দেশ ত্রাণ সামগ্রী বোঝাই বিমান পাঠিয়ে সহমর্মিতার স্বাক্ষর রাখছে।
বাংলাদেশের আছে বিপুল জনশক্তি, যার অধিকাংশ তরুণ এবং আজকের বিশে^্ব বিরল। বিপুল জনশক্তির মাঝে অপর যে শক্তিটি এতদিন লুকায়িত ছিল এবং বিশ^ সমাজ জানতে পারি নি তা হল কবি কাজী নজরুল ইসলামের ভাষায় ‘আপনাকে বিলিয়ে দে’য়ার নৈতিক শক্তি। বিশে^র বিভিন্ন দেশে শান্তিরক্ষী বাহিনীতে বাংলাদেশের সৈনিকরা এর বহু দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেও গোটা জাতি যে কীভাবে অসহায় মানুষের জন্য নিজেকে উজাড় করে দিতে পারে তার বৃহত্তম প্রমাণ উপস্থাপিত হয়েছে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের প্রতি দরদী আচরণের মধ্য দিয়ে।
যারা এরমধ্যে রোহিঙ্গা মোহাজিরদের দেখতে গেছেন তাদের অভিজ্ঞতা হল, মানুষ কক্সবাজার ও টেকনাফ সফর করে আনন্দ ভ্রমন ও বিনোদনের জন্যে। কিন্তু এখন মানুষ যাচ্ছে ত্রাণ সামগ্রীর বহর নিয়ে ঈমানী চেতনায় উজ্জীবিত ইসলামী ভ্রাতৃত্ববোধ ও মমত্বের স্বাক্ষর রাখার জন্যে। বাংলাদেশের মানুষ এই শিক্ষা পেয়েছে পবিত্র ইসলাম থেকে। মদীনার আনসারগণ মক্কার মুহাজিরদের যেভাবে প্রাণঢালা অভ্যর্থনা জানিয়েছিলেন, মনে হবে কক্সবাজার থেকে টেকনাফগামী রাস্তার দুপাশে, নাইক্ষংছড়িতে সেই আদর্শের অনুশীলন হচ্ছে। বিশ^বাসীর প্রতি আমরা আহ্বান জানাই, আসুন, ইসলামী ভ্রাতৃত্বের এই সৌন্দর্য উপভোগ করুন। জাতিসংঘ শরণার্থী বিষয়ক হাইকমিশনার যেভাবে অভিভূত হয়েছেন, তার বাস্তব চিত্র আপনারা দেখে যান। এর নামই ইসলাম। এখানেই ইসলামের সৌন্দর্য্য। ইসলামের সৌন্দর্য্য বলতে কোনো দালান কোঠা, চোখ ধাঁধানো জৌলুস বা প্রত্মতাত্তি¡ক অট্টালিকা নয়; বরং নিজের অভাবের মধ্যেও ঈমানী ভাইয়ের জন্য প্রাণের দুয়ার খুলে দেয়ার মধ্যে এই সৌন্দর্য্য লুকায়িত।
হাফেজ মুজিবুর রহমান বেলালের বাড়ি রামুতে। ব্যবসা সূত্রে থাকেন কক্সবাজারে। কুরবানীর ঈদের দিন তিনি যেভাবে রান্না করা গোশত শত অনিশ্চয়তার মধ্যে নাইক্ষংছড়ির দুর্গম পাহাড়ে ডেকচি ভরে নিয়ে গেলেন, তার বর্ণনা শুনলে আনন্দে চোখে পানি এসে যায়। তিনি বলেছেন, আমার কুরবানী এ বছর সার্থক মনে হয়েছে, যখন পাড়ার তরুণ ছেলে ও ভাতিজাদেরসহ কাঁধে বহন করে দুই ঘন্টার পাহাড়ি পথ পাড়ি দিয়ে সদ্য সীমান্ত পার হওয়া নির্যাতিত মুসলমান ভাইবোনদের মুখে গরম ভাত আর রান্না করা গোশত তুলে দিতে পেরেছি। কক্সবাজার-টেকনাফ সীমান্তে এ ধরনের বা এর চেয়েও প্রাণস্পর্শী ভ্রাতৃত্ব ও মমত্ববোধের ভুরি ভুরি উদাহরণ এখন সাধারণ ব্যাপার।
মনে হচ্ছে, বাংলাদেশের মানুষের হৃদয়ের গহীনে হাদীস শরীফের এই বাণী আজ নিত্য অনুরণিত। নোমান ইবনে বশীর (র) বর্ণিত হ্দাীসে নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, ‘তুমি মুমিনদেরকে দেখবে পরস্পরের প্রতি ভালোবাসা, দয়া-মায়া ও সহানুভুতির ক্ষেত্রে এক দেহের মতো। দেহের কোনো অঙ্গ যখন ব্যথায় কাতর হয় তখন সমস্ত অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ জ¦র ও বিনিদ্রায় তার সাথে সহমর্মিতা প্রকাশ করে।’ (বুখারী শরীফ, হাদীস নং: ৬০১১)