দক্ষিণ আফ্রিকা সফরে আসিয়া ব্যাটিং যেন ভুলিতে বসিয়াছেন বাংলাদেশের ক্রিকেটাররা! প্রথম টেস্টে যাচ্ছেতাইভাবে পরাজয়, দ্বিতীয় টেস্টে বাংলাদেশ হারিয়াছে এক ইনিংস ও ২৫৪ রানে। নিন্দুকেরা বলিতেছেন, এই সফরে বাংলাদেশ যেন টাইম মেশিনে করিয়া পুরানো দিনে ফিরিয়া গিয়াছে।
ভুলিয়া গেলে চলিবে না যে, একটি সময় নিয়মিতই ছিল বাংলাদেশের ইনিংস পরাজয়ের দৃশ্য। ক্রিকেটের বড় শক্তিগুলির বিপক্ষে ইনিংস ব্যবধানে পরাজয় এড়াইবার চেষ্টাই ছিল তখনকার সবচাইতে বড় লক্ষ্য। টেস্ট জয়ের দেখা পাওয়া ছিল সোনার হরিণের মতো। ড্র করাটাকেই মনে করা হইত জয়ের সমান। কিন্তু গত কয়েক বত্সরে ওয়ানডে এবং টেস্টে নিয়মিত সাফল্য পাইয়াছে বাংলাদেশ। ইংল্যান্ড, শ্রীলঙ্কা কিংবা অস্ট্রেলিয়ার মতো দল বাংলাদেশের নিকট পরাজয় বরণ করিয়াছে নিয়মিত। আর এইবার দক্ষিণ আফ্রিকা সফরে ২১টি টেস্টের পর ইনিংস পরাজয়ের স্বাদ পাইল বাংলাদেশ। এমনটি হইতেই পারে। পৃথিবীর সমীহযোগ্য কোন টেস্ট খেলুড়ে দল রহিয়াছে, যাহাদের পরাজয়ের মাল্য পরিধান করিতে হয় নাই? ১৯৮৩ সালে বিশ্বকাপ জয় করিলেও এক সময় দক্ষিণ আফ্রিকা, পাকিস্তান, অস্ট্রেলিয়ার নিকট নিয়মিত পরাজয় বরণ করিতে হইয়াছে ভারতকে। শ্রীলঙ্কা এখন সমীহযোগ্য ক্রিকেটশক্তি বটে, টেস্ট খেলুড়ে দেশের মর্যাদা অর্জনের পর বত্সরের পর বত্সর তাহাদের নিকটও টেস্টে জয় ছিল স্বপ্নের মতো। পাকিস্তানের ক্রিকেট অনিশ্চয়তায় ভরা, আজ তাহারা ব্যাঘ্রের ন্যায় খেলিল তো পরের দিন বিড়ালের মতো। অস্ট্রেলিয়া ও দক্ষিণ আফ্রিকা সবচাইতে টেকসই ক্রিকেট শক্তি। কিন্তু তাহাদেরও পরাজয়ের স্বাদ গ্রহণ করিতে হয়। ক্রিকেটের জনক ইংল্যান্ডের অভিজ্ঞতার ঝুলিতেও পরাজয়ের ট্রফি কম নাই। তাহা ছাড়া দীর্ঘদিন ধরিয়াই দক্ষিণ আফ্রিকা দলটি ঘরের মাঠে দুর্দান্ত প্রতাপের সহিত খেলিয়া থাকে। সুতরাং পর পর দুই টেস্টে দক্ষিণ আফ্রিকার মাটিতে বাংলাদেশের এমন পরাজয়ের ঘটনায় ভাঙিয়া পড়িবার কিছু নাই।
প্রকৃতপক্ষে, বিজয় আসিলে ক্রিকেটারদের জাতীয় বীরের মর্যাদা দিয়া মাথায় তুলিয়া নাচিব, আর অকস্মাত্ পারফরম্যান্স খারাপ করিলেই আছাড় মারিয়া মাটিতে ফেলিব—এমন মানসিকতার ভিতরে শিশুতোষ আবেগ বৈ আর কিছু নাই। এমন মানসিকতা প্রকৃত অবস্থার অতিমূল্যায়ন বা অবমূল্যায়ন ঘটায়—যাহা কাম্য নহে। মনে রাখিতে হইবে, যাহারা আমাদের মুখ উজ্জ্বল করিয়াছে বহুবার, দুঃসময়ই সবচাইতে বেশি প্রয়োজন তাহাদের পাশে থাকিবার। আমরা নিশ্চয়ই চাহিব না, তীব্র নিন্দার ঝড়ে বিধ্বস্ত হউক আমাদের ক্রিকেটাররা, সমালোচনার ঝাঁক ঝাঁক বিষাক্ত তীরে ক্ষতবিক্ষত হউক তাহাদের মনোবল। ওয়ানডে সিরিজ বাকি আছে এখনো। ওয়ানডে সিরিজে যাহাতে বাংলাদেশ ভালো পারফর্ম করে, তাহার জন্য অকুণ্ঠ সমর্থন ও ভালোবাসা দিতে হইবে আমাদের ক্রিকেটারদের। স্মর্তব্য যে, ভুল বা পরাজয়ের মতো বড় শিক্ষক আর কেহ নাই, সেই ভুল বা পরাজয় হইতে শিক্ষা লইতে হইবে।
নিন্দা নহে, ভালোবাসার হাত বাড়াইয়া দিতে হইবে তাহাদের প্রতি। জয় বহুদূরবাসী কোনো রূপকথা নহে।