• বুধবার, ২৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২:২৭ পূর্বাহ্ন

ক্যাফে-ক্যান্টিনে কর্মী, যে কারনে যৌনকর্মী কে গলা টিপে হত্যা করেন

নিউজ ডেস্ক
আপডেটঃ : বুধবার, ২১ ফেব্রুয়ারী, ২০২৪
সংগৃহীত ছবি

খোকন ভূইয়া ক্যাফে-ক্যান্টিনে কাজ করেন। এক রাতে কাজ শেষে ফার্মগেট ফুটওভার ব্রিজের ওপর দিয়ে যাওয়ার সময় ভাসমান যৌনকর্মী আসমা ওরফে লিমা বেগম তাকে টাকার বিনিময়ে শারীরিক সম্পর্কের প্রস্তাব দেন। খোকন তার ডাকে সাড়া দেন। দু’জন দরদাম করে তিন হাজার টাকা ঠিক করেন। এরপর তারা শ্যামলীর একটি হোটেলে স্বামী-স্ত্রী পরিচয়ে উঠে শারীরিক সম্পর্কে মিলিত হন। কাজ শেষে খোকনের কাছে চুক্তি করা টাকার থেকে আরও বিশ হাজার টাকা বেশি দাবি করেন আসমা। এতে দু’জনের মধ্যে ঝগড়া ও হাতাহাতি হয়। এক পর্যায়ে আসমাকে গলা টিপে এবং ওড়না দিয়ে মুখ পেঁচিয়ে হত্যা করেন খোকন।

২০২১ সালের ৭ সেপ্টেম্বর রাজধানীর শেরেবাংলা নগর থানার শ্যামলী এলাকার হোটেল রাজ ইন্টারন্যাশনাল (আবাসিক)-এর ৬ষ্ঠ তলার ৬০২ নম্বর কক্ষে খুন হন আসমা। এরপর নিহতের স্বামী সজিব আলী শেখ শেরেবাংলা নগর থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। মামলার পর আসামি খোকনকে গ্রেফতার করে পুলিশ। খুনের দায় স্বীকার করে আদালতে জবানবন্দি দিয়েছেন তিনি।

সম্প্রতি ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে খোকনের বিরুদ্ধে চার্জশিট দাখিল করেছে পুলিশ। চার্জশিটে এসব কথা উল্লেখ করেছেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ডিবি পুলিশের এসআই সুকান্ত বিশ্বাস।

আসমার শরীরে ছিল যৌন অত্যাচারের চিহ্ন

চার্জশিটে তদন্ত কর্মকর্তা উল্লেখ করেন, শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগের দেওয়া ময়না তদন্তের রিপোর্ট পর্যালোচনায় দেখা যায়, ভিকটিম মোছা. আসমা ওরফে মোছা. লিমা বেগম কবিতা (২৫) এর মৃত্যুটি শ্বাসরোধ জানিত হত্যাকাণ্ড। তার শরীরে যৌন অত্যাচারের চিহ্ন পাওয়া গেছে। ডিএনএ পরীক্ষকের মতামত পর্যালোচনায় দেখা যায়, ঘটনাস্থলে থেকে সংগৃহীত নমুনার সঙ্গে আসামি মো. খোকন ভূইয়ার ডিএনএ প্রোফাইলের সবকিছুর মিল পাওয়া গেছে।

তিন হাজার টাকায় ঠিক করা হয় আসামাকে

স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে আসামি খোকন ভূইয়া বলেন, তিনি ক্যাফে-ক্যান্টিনে কাজ করেন। ঘটনার দিন রাতে আসামি নিজের কাজ শেষে ফার্মগেট ওভার ব্রিজের ওপর যায়। সেখানে থাকা ভিকটিম, আসামিকে ডেকে বলেন ‘কাজ করবা’ নাকি। কারণ, ভিকটিম একজন দেহ ব্যবসায়ী। আসামি রাজি হয় এবং দরদাম ঠিক হয় তিন হাজার টাকা। ভিকটিম তার পরিচিত সিএনজিতে করে আসামিকে শ্যামলীর (ঘটনাস্থল) হোটেলে নিয়ে যায়। সেখানে তারা দুইবার শারীরিক সম্পর্কে মিলিত হয়। এরপর ভিকটিম আসামির কাছে নির্ধারিত টাকার চেয়ে আর ২০ হাজার টাকা বেশি দাবি করেন।

খোকনের কাছে চুক্তির চেয়ে বিশ হাজার টাকা বেশি দাবি করেন আসমা। এতে দুই জনের মধ্যে বাগবিতণ্ডা হয়। এক পর্যায়ে খোকন ভিকটিম আসমাকে গলা টিপে ধরে এবং ওড়না দিয়ে মুখ পেঁচিয়ে হত্যা করেন। আসামি খোকন আদালতে দায় স্বীকার করে জবানবন্দি দিয়েছেন।

টাকা না দিলে সে চিৎকার করে লোকজন জড়ো করার হুমকি

জবানবন্দিতে খোকন আরও বলেন, আমি ভিকটিমকে বলি যে দাম ঠিক করে এনেছি সে টাকাই দিয়েছি। ভিকটিম তাকে বলে, আরও টাকা না দিলে সে চিৎকার করে লোকজন জড়ো করবে। এরমধ্যে ভিকটিম নিচে যায় এবং সাদা পাউডার জাতীয় নেশাদ্রব্য এনে নিজেও সেবন করে এবং তাকেও সেবন করায়। পরবর্তীতে তাদের মধ্যে আবার ঝামেলা হয়। হাতাহাতিও শুরু হয়, এক পর্যায়ে আসমাকে গলা টিপে ধরে এবং তার ওড়না দিয়ে মুখ পেঁচিয়ে দেয় খোকন। এরপর আসমার হাত খাটের সঙ্গে বেঁধে রেখে পালিয়ে যান। পরে জানতে পারেন মেয়েটি মারা গেছে।

মামলার চার্জশিটে তদন্ত কর্মকর্তা উল্লেখ করেন, ২০২১ সালের ৮ সেপ্টেম্বর রাতে ফার্মগেট ফুটওভার ব্রিজ দিয়ে রাস্তা পার হওয়ার সময় যৌনকর্মী হিসেবে ভিকটিম নিহত আসমা ওরফে কবিতা (২৫)-আসামিকে ডাক দিয়ে কাজ করবে কি-না জিজ্ঞেস করেন। আসামি ভিকটিমের ডাকে সাড়া দিয়ে বলেন কোথায় নিয়ে যাবে। কথাবার্তা শেষে তাদের মধ্যে তিন হাজার টাকার বিনিময়ে দৈহিক মিলনের চুক্তি হয়। পরবর্তীতে ভিকটিম নিজের পরিচিত একটি সিএনজিতে খোকনকে রাজ ইন্টারন্যাশনাল আবাসিক হোটেলে নিয়া যান।

সেখানে যাওয়ার পর ভিকটিম হোটেলের ভাড়া পরিশোধ করেন। তারা উভয়ে নিজেদের স্বামী-স্ত্রী পরিচয়ে দিয়ে হোটেলের ৬ষ্ঠ তলার ৬০২ নম্বর কক্ষে যান এবং সেখানে রাত্রি যাপন করেন। ভিকটিম নিজের নাম মোছা. আসমা ওরফে মোছা. লিমা বেগম বলে আসামিকে জানান। আসামি ও ভিকটিম হোটেল কক্ষে অবস্থানকালে দুইবার শারীরিক সম্পর্ক করেন (যা উভয়ের স্বেচ্ছাকৃত এবং টাকার বিনিময়ে চুক্তিকৃত)। দৈহিক মিলন শেষে ভিকটিম, আসামির কাছে চুক্তির চেয়ে অতিরিক্ত ২০ হাজার টাকা দাবি করলে তাদের ঝগড়া হয় এবং আসামি ভিকটিমকে বোঝানোর চেষ্টা করেন।

নাস্তা আনার কথা বলে খোকন পালিয়ে যায় 

চার্জশিটে আছে, একপর্যায়ে তাদের মধ্যে হাতাহাতি শুরু হয়। আসামি খোকন ভিকটিমের উপর ক্ষিপ্ত হয়ে তাকে মারধর করেন। এরপর তারই ব্যবহৃত ওড়না (জব্দকৃত) দিয়ে ভিকটিমের দুই হাত হোটেল রুমে থাকা স্টিলের খাটের সঙ্গে বেঁধে ফেলে ও অপর একটি ওড়না (জব্দকৃত) দিয়ে ভিকটিমের মুখ বেঁধে ফেলে এবং হত্যার উদ্দেশ্যে আসামি ভিকটিমের গলা টিপে ধরে। এতে ভিকটিম আসমার দেহ নিস্তেজ হয়ে পড়ে। আসামি খোকন ভিকটিমের মৃত্যু নিশ্চিত করে কৌশলে হোটেল রুম হতে বের হয়ে যান। যাওয়ার সময় রুমটিতে তালা দেন। রুমের চাবিও হোটেলে জমা দেননি। হোটেল কর্তৃপক্ষকে নাস্তা আনার মিথ্যা বাহানা দিয়ে পালিয়ে যান।

ভিকটিম আসমার মৃত্যুটি শ্বাসরোধ জানিত হত্যাকাণ্ড। তার শরীরে যৌন অত্যাচারের চিহ্ন পাওয়া গেছে। ডিএনএ পরীক্ষকের মতামত পর্যালোচনায় দেখা যায়, ঘটনাস্থলে থেকে সংগৃহীত নমুনার সঙ্গে আসামি মো. খোকন ভূইয়ার ডিএনএ প্রোফাইলের সবকিছুর মিল পাওয়া গেছে।

মোবাইল বন্ধ পাওয়ায় চিন্তিত আসমার স্বামী

মামলার এজাহার থেকে জানা যায়, সজিব আলী শেখ (২১) একজন পান দোকানদার। তার স্ত্রী মোছা. আসমা ওরফে লিমা বেগম (২৫) ২০২১ সালের ৭ সেপ্টেম্বর বিকেল ৪ টার দিকে ফার্মগেট যাওয়ার উদ্দেশ্যে বাসা হতে বের হয়ে আসেন। রাত ১০ টার দিকে স্ত্রীর সঙ্গে কথা হয় তার। এরপর থেকে স্ত্রীর মোবাইল বন্ধ পাওয়ায় তিনি চিন্তিত হয়ে পড়েন। রাতে মোবাইলে পরিচিত ও আত্মীয়-স্বজনদের সঙ্গে কথা বলেন। পরের দিন সকাল ৯ টার দিকে ফার্মগেট গিয়ে খোঁজখবর নিতে থাকেন। খোঁজাখুজির এক পর্যায়ে সন্ধ্যা ৬ টার দিকে সজিব তার স্ত্রীর পরিচিত সালমা বেগমের (৩৫) কাছ থেকে জানতে পারেন তার স্ত্রীর মরদেহ শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজের মর্গে রয়েছে। তাড়াতাড়ি হাসপাতালের মর্গে গিয়ে আসমার মরদেহ শনাক্ত করেন তিনি।

পরবর্তীতে তিনি জানতে পারেন যে, শেরেবাংলা নগর থানা এলাকার শ্যামলীর হোটেল রাজ ইন্টারন্যাশনাল আবাসিক এর ৬ষ্ঠ তলার ৬০২ নম্বর কক্ষ হতে তার স্ত্রীকে স্টিলের খাটের সাথে ওড়না দিয়ে বাঁধা ও মৃত অবস্থায় উদ্ধার করা হয়। আসামি পূর্ব পরিকল্পিতভাবে তার স্ত্রীকে খাটে বেঁধে শ্বাসরুদ্ধ করে হত্যা করে পালিয়ে যায়।

এ ঘটনায় শেরেবাংলা নগর থানায় সজিব আলী শেখ বাদী হয়ে একটি মামলা করেন। মামলার পর আসামি মো. খোকন ভূইয়া ওরফে মো. খোকনকে (২৭) ঢাকার ক্যান্টনমেন্ট থানার মাটিকাটা এলাকা হতে গ্রেফতার করে পুলিশ। পরবর্তীকে খোকন ভূইয়া ঘটনার দায় স্বীকার করে আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন।

এ বিষয়ে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ডিবি পুলিশের এসআই সুকান্ত বিশ্বাস জাগো নিউজকে বলেন, ভিকটিম আসমা ওরফে লিমা বেগম একজন যৌনকর্মী ছিলেন। তাকে যৌনকাজে চুক্তিতে নিয়ে যায় খোকন ভূইয়া। খোকনের কাছে চুক্তির চেয়ে বিশ হাজার টাকা বেশি দাবি করেন আসমা। এতে দুই জনের মধ্যে বাগবিতণ্ডা হয়। এক পর্যায়ে খোকন ভিকটিম আসমাকে গলা টিপে ধরে এবং ওড়না দিয়ে মুখ পেঁচিয়ে হত্যা করেন। আসামি খোকন আদালতে দায় স্বীকার করে জবানবন্দি দিয়েছেন। তদন্তে ঘটনার সত্যতা পেয়ে খোকনের বিরুদ্ধে চার্জশিট দাখিল করেছি।

এ বিষয়ে মামলার বাদী সজিব আলী শেখ বলেন, আমি আমার স্ত্রী আসমার হত্যার বিচার চাই। আসামির দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করছি।


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এই ক্যাটাগরির আরো নিউজ