কয়েক দশক ধরে সৌদি আরব ও ইরানের মধ্যে মধ্যে বৈরি সম্পর্ক বিরাজ করছে। তবে দুই দেশের বুঝতে পারছে, সম্পর্ক স্বাভাবিক থাকলে দুই দেশেরই স্বার্থ রক্ষা হতে পারে। গত বছর চীনের মধ্যস্থতায় কূটনৈতিক সম্পর্ক পুনঃস্থাপনের পর দেশ দুটি সেই বৈরি সম্পর্ক থেকে অনেকটাই বেরিয়ে এসেছে বলা যেতে পারে।
এ ছাড়া মধ্যপ্রাচ্যের এই দুই দেশের সাম্প্রতিক সময়ের কূটনৈতিক আদানপ্রদান তাদের সম্পর্ক গভীর করতে চাওয়ার ইঙ্গিত দিচ্ছে।
যেমন ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্বাস আরাগচির সর্বশেষ সৌদি সফরের কথা বলা যেতে পারে। সফরে তিনি সৌদি যুবরাজ মুহাম্মদ বিন সালমানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন।
পাঁচ দশকের বৈরিতা
এই দেশ দুটির বৈরি সম্পর্কের ইতিহাস বেশ পুরেনো। বলা যেতে পারে, ১৯৭৯ সালে ইরান বিপ্লবের পর থেকেই এমন সম্পর্ক বিরাজ করছে।
কয়েক দশকের পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে বলা যায়, সম্পর্ক পুনঃস্থাপনে দুই দেশের এই চেষ্টা খুবই নতুন এক রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট।
মূলত রাজনীতিতে ধর্মের ভূমিকা নিয়ে দুই দেশের ভাবনা একেবারে দুই রকম। আর এখান থেকেই পরস্পরবিরোধী রাজনৈতিক অবস্থানের যাত্রা শুরু। ১৯৭৯ সালের বিপ্লবের পর ইসলাম নিয়ে ইরান সরকারের বোঝাপড়া ছিল সামাজিক বিপ্লবের জায়গা থেকে।
দীর্ঘ সময় ধরে এই অঞ্চলে দেশটি নিজেকে শিয়াদের নেতা হিসেবে মেলে ধরেছে।
অন্যদিকে সুন্নি মতাদর্শের সৌদি রাজপরিবার নিজের ক্ষমতা ধরে রাখতে ধর্মের ভূমিকার ওপর নির্ভর করে থাকে। মধ্যপ্রাচ্যে নিজেকে ইসলামের নেতৃত্বদানকারী দেশ হিসেবে এবং মুসলমানদের পবিত্র স্থান মক্কা ও মদিনার জিম্মাদার মনে করে দেশটি।
২০১০ সালের আরব বসন্তের সময় দেশ দুটির দুই মেরুর অবস্থান আরো স্পষ্ট হয়ে উঠে। সৌদি রাজপরিবারের আশঙ্কা ছিল, গাঠনিক রূপ দিয়ে ইরান এই আন্দোলনকে ব্যবহার করতে পারে।
দ্বন্দ্বের কেন্দ্রে ইয়েমেন
তবে সম্পর্ক পুনঃস্থাপনের নানা আলাপ-আলোচনা থাকা সত্ত্বেও দেশ দুটি ইয়েমেন প্রশ্নে দুই মেরুতেই অবস্থান করছে। ইরান সমর্থিত হুতি মিলিশিয়ারা ইয়েমেনের সাবেক প্রেসিডেন্ট আবেদ রাবু মানসুরকে ক্ষমতাচ্যুত করা চেষ্টা করেছে এবং দেশটির কিছু অঞ্চল নিজেদের নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়েছে।
অন্যদিকে সৌদি আরবের নেতৃত্বে সুন্নি দেশগুলোর যে জোট তা আবার পশ্চিমাদের, বিশেষ করেযুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন পাচ্ছে। তারা হুতিদের মোকাবেলা করতে চায়। মূলত এই অঞ্চলে ইরানের প্রভাব ঠেকাতে তৎপর তারা।
সম্পর্ক পুনঃস্থাপনে সৌদির স্বার্থ
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সম্পর্ক পুনঃস্থাপনের এই চেষ্টায় সৌদি আরবের দৃষ্টিকোণ থেকে বেশ কিছু সুবিধা রয়েছে।
জার্মানির থিংকট্যাংক সিএআরপিওর বিশ্লেষক সেবাস্টিয়ান সোনস বলেন, ‘২০১৯ সালে সৌদি আরবের তেলের স্থাপনায় ইরানের হামলার পর সৌদি সরকার বুঝতে পেরেছে, তারা যুক্তরাষ্ট্রের ওপর পুরোপুরি নির্ভর করতে পারবে না। সেই সঙ্গে প্রতিবেশী ইরানের সঙ্গে বৈরিতার সমাধান করতে হবে।’
তিনি বলেন, তেলের ওপর নির্ভর করা রিয়াদের কাছে দেশটির অর্থনীতির সফলতা নির্ভর করবে এই অঞ্চলের স্থিতিশীলতার ওপর। এই বিষয়টি বুঝতে পেরেছে সৌদি আরব।
তা ছাড়া সৌদি আরবে ক্ষেপণাস্ত্র হামলার ঘটনাও বন্ধ করতে চায় রিয়াদ। সৌদি আরব মনে করে, হুতি মিলিশিয়াদের প্রভাবিত করতে পারে ইরান।
তবে বার্লিনের ইনস্টিটিউট ফর ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্ড সিকিউরিটি অ্যাফেয়ার্সের হামিদরেজা আজিজি বলেন, হুতির সব কার্যক্রমের ওপর ইরান প্রভাব ফেলতে পারবে, বিষয়টি এমন নয়। তবে হুতি ও ইরান একে অপরের স্বার্থ রক্ষা করে থাকে। এই সম্পর্ক ইয়েমেনে যুদ্ধবিরতিতে ভূমিকা রাখতে পারে।
ইরানের স্বার্থ
সৌদি আরবের সঙ্গে সম্পর্ক পুনঃস্থাপনের মাধ্যমে নিজের সুনির্দিষ্ট স্বার্থ হাসিল করতে চায় ইরান। আজিজি বলেন, বছরের পর বছর ধরে ইরানের ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞা, দেশের ভেতরে অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনা ও দুর্নীতি ইরানকে ক্ষতির মুখে ফেলেছে। অর্থনৈতিক এই অস্থিরতার কারণে দেশের ভেতরে মারাত্মক বিক্ষোভ, আন্দোলন তৈরি হতে পারে বলে আশঙ্কা ইরান সরকারের।
আজিজির মতে, সরকার কার্যকরভাবে দেশ পরিচালনা করতে পারছে না—এমন ভাবনা ইরানিদের মধ্যে রয়েছে।
যেহেতু পশ্চিমাদের সঙ্গে পরমাণু বিষয়ে কোনো সমঝোতায় পৌঁছাতে পারেনি এবং অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা উঠাতে পারেনি, এই ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে ইরান ভিন্ন পথ খোঁজার চেষ্টা করছে। এর অংশ হিসেবে বিভিন্ন বহুজাতিক সংস্থা, যেমন ব্রিকস, সাংহাই কো-অপারেশন অর্গানাইজেশন ইত্যাদি জায়গায় নিজেদের যুক্ত করতে চাইছে। সেই সঙ্গে প্রতিবেশী দেশ, যেমন সৌদি আরবের সঙ্গেও সম্পর্ক উন্নয়ন করতে চাইছে ইরান।
নিরাপত্তার বিষয়েও উদ্বেগ রয়েছে ইরানের। আজিজির মতে, চীনের মধ্যস্ততায় সৌদি আরব ও ইরানের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক পুনঃস্থাপনের আগে সৌদি আরব ও ইসরায়েলের মধ্যে সম্পর্ক তৈরি হওয়ার ইঙ্গিত দেখা গিয়েছিল। এই অবস্থায় মধ্যপ্রাচ্যে ইসরায়েল ও আরবদেশগুলোর মিলে ইরানবিরোধী একটি জোট তৈরি হতে পারে—এমন আশঙ্কা করছিল ইরান। এর সমাধান হিসেবে কূটনৈতিকভাবে আরবদেশগুলোর সঙ্গে যোগাযোগে এগিয়ে আসে ইরান।
যদিও বর্তমান প্রেক্ষাপটে সৌদি-ইসরায়েলি সম্পর্ক স্থাপনের চেষ্টা আর প্রাসঙ্গিক নয়। উদাহরণ হিসেবে আজিজি বলেন, সৌদি আরব এরই মধ্যে ফিলিস্তিন সমস্যা সমাধানে দ্বি রাষ্ট্রের পরিকল্পনা সামনে এনেছে, যা ইসরায়েলের কূটনৈতিক মনোভাবের বিরোধী।
তবে আজিজি এ-ও বলেন, ইসরায়েলের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়া কিংবা ইরানের সঙ্গে গভীরতা বাড়িয়ে পশ্চিমাদের থেকে দূরে সরে যাওয়ার কোনো ইচ্ছা সৌদি আরবের নেই। এর পরিবর্তে এক ধরনের কৌশলগত অবস্থান তৈরি করতে চায় সৌদি আরব।
মধ্যস্থতাকারী হওয়ার ইচ্ছা রিয়াদের
বিশ্লেষক সোনসের মতে, সব পক্ষের মধ্যস্থতাকারী হওয়ার মতো একটি অবস্থানে যেতে চায় সৌদি আরব। তিনি বলেন, একই ভূমিকা পালন করছে কাতার। সৌদি আরব ছিল অনেকটা রক্ষণশীল। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে তারা তেহরানের সঙ্গে যোগাযোগের রাস্তা উন্মুক্ত রাখতে চায়।
যুক্তরাষ্ট্র থেকে সৌদি আরবের মাধ্যমে ইরানকে বার্তা পাঠানো হয়েছে। সোনসের মতে, এ ধরনের কৌশলগত অবস্থান হতে পারে সৌদি আরবের আঞ্চলিক নীতি ও কূটনীতির গুরুত্বপূর্ণ অংশ। একই কথা বলছেন আজিজিও। এই বিশ্লেষকের মতে, ইরান-সৌদি আরবের সুসম্পর্ক এই অঞ্চলে দীর্ঘমেয়াদে স্থিতিশীলতা তৈরি করবে। আর ইরান বুঝতে পারছে, সম্পর্ক পুনঃস্থাপন সব পক্ষের জন্যই লাভজনক।