তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা ফেরাতে সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিলের রায় পুনর্বিবেচনার (রিভিউ) আবেদনের শুনানি পিছিয়ে ৯ ফেব্রুয়ারি দিন ধার্য করেছেন আদালত। বিএনপির পক্ষের আইনজীবীরা সময়ের আরজি জানালে জ্যেষ্ঠ বিচারপতি মো. আশফাকুল ইসলামের নেতৃত্বাধীন চার সদস্যের আপিল বেঞ্চ আজ রবিবার এই দিন ধার্য করেন।
গত ১ ডিসেম্বর প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদের নেতৃত্বাধীন আপিল বেঞ্চ শুনানির এই দিন ধার্য করেছিলেন। সে অনুযায়ী আপিল বিভাগের রবিবারের কার্যতালিকায় ১৩ নম্বর ক্রমিকে রাখা হয় আবেদনটি।
কিন্তু ক্রম অনুসারে শুনানিতে উঠার আগেই বিএনপির আইনজীবী জয়নুল আবেদীন আদালতকে বলেন, ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করা সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী হাইকোর্ট বাতিল করে রায় দিয়েছেন। কিন্তু পূর্ণাঙ্গ রায়টি আমরা এখনো পাইনি।
এসময় আদালত এই জ্যেষ্ঠ আইনজীবীর আরজি জানতে চাইলে আরেক জ্যেষ্ঠ আইনজীবী মো. রুহুল কুদ্দুস কাজল বলেন, ‘এই রিভিউ শুনানিতে পঞ্চদশ সংশোধনী বাতিলের পূর্ণাঙ্গ রায়টি দরকার।’
তখন বিএনপির আইনজীবীরা রিভিউ আবেদনের শুনানি দুই সপ্তাহ পেছানোর আরজি জানালে আদালত ৯ ফেব্রুয়ারি শুনানির তারিখ দেন।
১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলোর আন্দোলনের চাপে সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী আনে বিএনপি সরকার। ওই বছর ২৭ মার্চ সংবিধানে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতির প্রবর্তন ঘটে। এরপর এই পদ্ধতির অধীনে ১৯৯৬ সালে সপ্তম, ২০০১ সালে অষ্টম এবং ২০০৮ সালে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচন হয়।
২০০৪ সালে বিএনপি-জামায়াতের চার দলীয় জোট সরকারের আমলে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাকে অগণতান্ত্রিক ও সংবিধানবহির্ভূত আখ্যা দিয়ে আইনজীবী এম. সলিমউল্যাহসহ তিন আইনজীবী হাইকোর্টে একটি রিট করেন।
শুনানির পর তিন বিচারপতির বৃহত্তর বেঞ্চ ২০০৪ সালের ৪ আগস্ট রায় দেন। রায়ে বলা হয়, ত্রয়োদশ সংশোধনী সংবিধানসম্মত ও বৈধ। এ সংশোধনী সংবিধানের কোনো মৌলিক কাঠামোকে ক্ষতিগ্রস্ত করেনি।
এরপর সংঘাতময় পরিস্থিতিতে ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করে সেনাবাহিনী। জারি করা হয় জরুরি অবস্থা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ফখরুদ্দিন আহমদের নেতৃত্বে একটি নতুন তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন করা হয়। সেনাবাহিনীর মদদপুষ্ট এই তত্ত্বাবধায়ক সরকার দুই বছর ক্ষমতায় থাকার পর তত্ত্বাবধায়ক পদ্ধতির দুর্বলতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে।
২০০৮ সালে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে হয়। ক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন জোট। ওই বছর রিট আবেদনকারীরা হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করেন। ২০১০ সালে আপিল শুনানি শুরু হয়। আপিল বিভাগ এ মামলায় এমিচি কিউরি (আদালতকে সহায়তাকারী) হিসেবে দেশের আটজন সংবিধান বিশেষজ্ঞের বক্তব্য শোনেন। তারা তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বহাল রাখার পক্ষে মত দেন। এমনকি তৎকালীন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলমও এর পক্ষে মত দেন।
তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে ২০১১ সালের ১০ মে রায় দেন প্রধান বিচারপতি হিসেবে এ বি এম খায়রুল হকের নেতৃত্বাধীন আপিল বেঞ্চ। পরের বছর সেপ্টেম্বরে পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হয়। তখন সাবেক প্রধান বিচারপতি খায়রুল হকের বিরুদ্ধে রায় পরিবর্তনের অভিযোগ ওঠে। সর্বোচ্চ আদালতের এই রায়কে আশ্রয় করে দলীয় সরকারের অধীনে পর পর তিনিটি নির্বাচন করে ক্ষমতায় টিকে থাকে শেখ হাসিনা।
ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে গত ৫ আগস্ট তাঁর পতন ঘটে। এরপর আপিল বিভাগের ওই রায় পুনর্বিবেচনা চেয়ে গত ২৭ আগস্ট রিভিউ (পুনর্বিচেনার) আবেদন করেন বদিউল আলম মজুমদারসহ পাঁচ ব্যক্তি। অন্য চারজন হলেন, তোফায়েল আহমেদ, এম হাফিজউদ্দিন খান, জোবাইরুল হক ভূঁইয়া ও জাহরা রহমান।
এরপর ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিলের রায় বাতিল চেয়ে গত ১৭ অক্টোবর আবেদন করেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। পরে ২৩ অক্টোবর আরেকটি আবেদন করেন বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার।
এ ছাড়া নওগাঁর রানীনগরের নারায়ণপাড়ার বাসিন্দা বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. মোফাজ্জল হোসেন আপিল বিভাগের রায় পুনর্বিবেচনা চেয়ে আবেদন করেন। আবেদনগুলোর শুনানি এ নিয়ে চারবার পেছানো হলো।