‘নিরাপদ পানি’ হিসেবে আমরা অনেকেই পথে ঘাটে, রাস্তার পাশের দোকানে বিক্রি করা জারের পানি পান করে তৃষ্ণা মিটাই; কিন্তু আমরা কি জানি প্রতি গ্লাস এক টাকা হিসাবে পাওয়া এই পানি কতটা অনিরাপদ। গবেষণায় পাওয়া তথ্যে জানা যাচ্ছে, জারের পানি নিরাপদ তো নয়ই বরং তা স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর।
বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিলের (বিএআরসি) এক গবেষণায় দেখানো হয়েছে, পথে ঘাটে, রাস্তার পাশের দোকানে এসব জারের পানিতে রয়েছে ‘মলমূত্রের জীবাণু’ যা ছড়াচ্ছে আমাশয়, টাইফয়েড, কলেরা, ইউরিন ইনফেকশন ও জন্ডিসসহ অনেক জীবনঘাতী রোগ। সর্বস্বীকৃত প্রতিষ্ঠান এক্রিডেটেড ল্যাবরেটরি এসজিএস বাংলাদেশ লিমিটেড কর্তৃক নমুনা পানিসমূহের পরিমাণগত ও গুণগতমান বিশ্লেষণ করে এ তথ্য দিয়েছে তারা।
ঢাকার ২৪টি স্থানসহ দেশের সব বিভাগের বিভিন্ন জেলা থেকে ২৫০টি নমুনা সংগ্রহ করে এই গবেষণা পরিচালনা করে সরকারি সংস্থা বিএআরসি।
বিজ্ঞানীরা বলছেন, কলিফর্ম মূলত বিভিন্ন রোগ সৃষ্টিকারী প্যাথোজেন, যেমন- ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস ও প্রোটাজেয়ার সৃষ্টিতে উত্সাহ যোগায় বা সৃষ্টি করে। বিভিন্ন রোগ সৃষ্টিকারী ব্যাকটেরিয়া মানবদেহে নানাবিধ রোগ সৃষ্টি করে। ক্রমাগত মানুষের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা হ্রাস/নষ্ট করে দেয়। ফলস্বরূপ পরবর্তীতে যে কোনো রোগ সৃষ্টিকারী অণুজীব দ্বারা খুব সহজেই আক্রান্ত হবার আশঙ্কা বেড়ে যায়।
বিশ্লেষণকৃত ফলাফলে দেখা যায় যে, বাজারজাতকৃত জার পানির শতভাগই উচ্চ মাত্রায় কলিফর্মযুক্ত। তাছাড়া, এলিফ্যান্ট রোড, চকবাজার, বাসাবো, গুলশান, বনানী হতে সংগ্রহকৃত পানির নমুনায় উল্লেখযোগ্য মাত্রায় কলিফর্ম ও ফেকাল কলিফর্মের উপস্থিতি পাওয়া যায়। তবে সদরঘাট এলাকার জার পানির নমুনা সবচেয়ে দূষণযুক্ত নির্দেশ করে; ঐ সব নমুনায় সর্বোচ্চ টোটাল কলিফর্ম ও ফেকাল কলিফর্মের উপস্থিতির পরিমাণ ছিল যথাক্রমে ১৬০০ ও ২৪০ এমপিএন/১০০ মিলি মাত্রার। এছাড়া স্ট্যান্ডার্ড মান অনুযায়ী পানিতে নাইট্রেট, লিড, ক্রোমিয়াম ও আয়রন থাকা যাবে না; কিন্তু নমুনা জারের পানিতে এগুলো পাওয়া গেছে।
গবেষকরা জানিয়েছেন, সুস্থভাবে জীবন ধারণের জন্য একজন প্রাপ্ত বয়স্ক নর-নারীর দৈনিক ৬ থেকে ১৪ গ্লাস লিটার পানি পান করা আবশ্যক। খাবার হিসাবে ব্যবহৃত পানি অবশ্যই নিরাপদ হতে হবে, অন্যথায় পানি বাহিত রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দেওয়ার আশঙ্কা বেড়ে যায়।
গবেষণার সাথে সংশ্লিষ্ট বিজ্ঞানীরা বলেছেন, বিগত দুই দশক থেকে বাংলাদেশে উৎপাদিত ব্র্যান্ড ও নন-ব্রান্ড বোতলজাত পানি, জার পানি ও আমদানিকৃত বোতলজাত পানির ব্যবহার লক্ষণীয় মাত্রায় বৃদ্ধি পেয়েছে। হোটেল, অফিস, রাস্তার পার্শ্ব দোকান থেকে শুরু করে, উৎসব-অনুষ্ঠান, ভ্রমণ পথে, বাসা-বাড়িতে জারের খাবার পানি ব্যাপক হারে ব্যবহৃত হচ্ছে।
পানির মান দেখার জন্যই এই গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়। চলতি বছরের এপ্রিল মাসে এ গবেষণা কার্যক্রম শুরু করে বিএআরসি।
গবেষণার জন্য দেশের বিভিন্ন বিভাগীয় শহর ও জেলা শহর থেকে বোতল ও জারকৃত পানির তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করা হয়। ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা, বরিশাল , রাজশাহী , কুমিল্লা, ফেনী, রংপুর, দিনাজপুর, বগুড়া, সিরাজগঞ্জ, পাবনা, পটুয়াখালী, সাভার, গাজীপুর, ময়মনসিংহ, সিলেট, নরসিংদী প্রভৃতি স্থানসমূহ হতে পানির উপাদানসমূহের পরিমাণগত ও গুণগতমান বিশ্লেষণে ৩৫টি বিভিন্ন ব্যান্ডের বোতলজাত পানি ও জার পানির ২৫০টি নমুনা সংগ্রহ করা হয়।
জার পানির ক্ষেত্রে বিশেষ করে ঢাকাস্থ ফার্মগেট, কাওরানবাজার, এলিফ্যান্ট রোড, নিউ মার্কেট, চকবাজার, সদরঘাট, কেরানিগঞ্জ, যাত্রাবাড়ী, মতিঝিল, বাসাবো, মালিবাগ, রামপুরা, মহাখালী, গুলশান, বনানী, উত্তরা, এয়ারপোর্ট, ধানমন্ডি, মোহাম্মদপুর, মিরপুর, গাবতলী, আমিনবাজার, আশুলিয়া ও সাভার এলাকা হতে সংগ্রহ করা হয়।
গবেষকরা বলছেন, জার পানির ক্ষেত্রে রিভার্স অসমোসিস প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয় না বা মান নিয়ন্ত্রণহীন ভাবে উৎপাদিত হয়, ফলে সেখানে টিডিএস-এর মাত্রা বোতলজাত পানির চেয়ে বেশি পাওয়া যায় (৬২-৪৭৪ মিলিগ্রাম/লিটার)।
এছাড়াও টিডিএস-এর মাত্রা বেশি হলে পানির ক্ষরতা, হার্ডনেস ও লবণাক্ততা বৃদ্ধি পায়। ফলে, পানির পাইপ আটকে যায়। এমতাবস্থায় পাইপে রোগ সৃষ্টিকারী জীবাণু এবং অন্যান্য অণুজীবের সংখ্যা বৃদ্ধি পায়।
এ বিষয়ের গবেষক ও বিএআরসির পরিচালক ড. মনিরুল ইসলাম বলেন, ‘জারের পানি নিরাপদ নয়। এমনকি নামি দামি অনেক ব্রান্ডের পানিও নিরাপদ নয়। তাই পানি পানের ক্ষেত্রে সতর্ক হতে হবে। ফুটিয়ে পানি পান করতে হবে’।