দুর্নীতি বন্ধ হইলে জাতীয় প্রবৃদ্ধির হার ১০ শতাংশেরও বেশি অর্জন সম্ভব। সেই সাথে দারিদ্র্যের হারও ১০ শতাংশের নিচে নামিয়া আসিবে। দেশিবিদেশি বিশেষজ্ঞদের মুখে এমন কথা আমরা শুনিয়া আসিতেছি দীর্ঘদিন যাবত্। সম্প্রতি ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) আয়োজিত ‘স্থানীয় পর্যায়ে দুর্নীতিবিরোধী সামাজিক আন্দোলন: সম্ভাবনা ও চ্যালেঞ্জ’ শীর্ষক এক মতবিনিময় সভায় আবারও তাহার প্রতিধ্বনি শোনা গিয়াছে। বলা হইয়াছে যে রাষ্ট্রীয়ভাবে দুর্নীতির আশ্রয়-প্রশ্রয় বন্ধ করা, দুর্নীতিবাজদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করা ও সর্বস্তরে জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা গেলে দুর্নীতি কমিবে। এইদিকে তৃণমূল পর্যায়ে দুর্নীতিবাজদের খোঁজে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) মাঠে নামিয়াছে—এই খবরও নূতন নহে। জানা যায়, এই লক্ষ্যে ইউনিয়ন পর্যায়ে সরকারি বরাদ্দ, বিতরণ ও খরচের হিসাব-নিকাশ গোপনে যাচাই-বাছাই করিয়া দেখিতেছে দুদক। ইতোমধ্যে দুর্নীতির অভিযোগে কয়েকজন ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) চেয়ারম্যানকে গ্রেফতারও করা হইয়াছে। পাশাপাশি চলমান রহিয়াছে দেশের ৪ হাজার ৫৫৪টি ইউনিয়নে দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটি গঠনের কাজও। সব মিলাইয়া দুর্নীতিবিরোধী হাঁকডাকের কোনো অভাব নাই। কিন্তু যাহার বিরুদ্ধে এত তর্জনগর্জন সেই দুর্নীতি যেন ক্রমেই মোটাতাজা হইয়া চলিয়াছে।
বিশেষ করিয়া তৃণমূল পর্যায়ে দুুর্নীতির আগ্রাসী রূপ দেখিয়া রীতিমতো আতঙ্কিত হইতে হয়। বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের জন্য বরাদ্দকৃত অর্থ প্রায় পুরাটাই লোপাট হইয়া যাইতেছে। দুর্নীতিবাজ চক্রটি এতটাই বেপরোয়া হইয়া উঠিয়াছে যে ক্ষেত্রবিশেষে তাহাদের কার্যকলাপ আমাদের কল্পনাকেও হার মানায়। প্রশ্ন হইল, তাহারা এতটা দুঃসাহস পাইতেছে কোথায়? আমাদের জানামতে, সরকারের নীতিনির্ধারক মহলের মনোভাব এই ব্যাপারে অত্যন্ত কঠোর। সংগত কারণেই বৃহত্তর জাতীয় স্বার্থে ইহা উদ্ঘাটন করা জরুরি হইয়া পড়িয়াছে যে উন্নয়ন প্রকল্পের অর্থ লুটপাটে কে তাহাদের মদদ জোগাইতেছে। সকলেই জানেন, স্থানীয় পর্যায়ে সরকারের উন্নয়ন কার্যক্রম তদারকির জন্য যথাযথ প্রশাসনিক কাঠামো যেমন রহিয়াছে, তেমনি আছেন বিভিন্ন পর্যায়ের জনপ্রতিনিধিগণও। সর্বোপরি, আছে দুদক। তাহার পরও কোনো কাজ না করিয়া একটি চক্র কীভাবে দিনের পর দিন সরকারি অর্থ লোপাট করিয়া চলিয়াছে—তাহা আমরা বুঝিতে অক্ষম। তবে দুদকের কর্তাব্যক্তিদের অব্যক্ত হতাশার যে যিকঞ্চিত্ বহিঃপ্রকাশ ঘটিতেছে নানা উপলক্ষে তাহাতে পাষাণেরও কান্না পাইবে বৈকি!
দুদক-এর ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা অবশ্য আশ্বস্ত করিয়াছেন যে যেখানেই দুর্নীতি হইবে সেখানেই দুদক যাইবে। তাহার মতে, আগে কমিশনের পক্ষে ইউনিয়ন পর্যায়ের দুর্নীতির দিকে মনোযোগী হওয়া সম্ভব হয় নাই। তবে এখন তৃণমূল পর্যায়েও নজর দেওয়া হইতেছে। ইউনিয়ন পর্যায়ের দুর্নীতিবাজদের চিহ্নিত করিয়া তাহাদের বিরুদ্ধেও আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হইতেছে। ভবিষ্যতে এই নজরদারি আরো জোরদার করা হইবে। প্রসঙ্গত বলা প্রয়োজন যে দুর্নীতির শিকড়বাকড় যে অনেক পোক্ত তাহা কোনো নূতন কথা নহে। অতএব, সরিষার ভিতরে ঘাপটি মারিয়া থাকা দুর্নীতির আসল ইন্ধনদাতাদের ধরাছোঁয়ার বাহিরে রাখিয়া দুর্নীতির ভূত তাড়াইতে দুদকের এই উদ্যোগ কতটা সফল হইবে তাহাই এখন দেখিবার বিষয়।