আজ ২৫ ডিসেম্বর। শুভ বড়দিন। পৃথিবীর আহ্নিক গতির হিসাবে দক্ষিণ গোলার্ধে এই দিনটি আক্ষরিক অর্থেই দীর্ঘতর দিবালোকে বিকশিত। তবে উত্তর গোলার্ধে তাহার বিপরীত, অর্থাত্ ক্ষুদ্রতর দিন। কিন্তু দুই গোলার্ধ মিলিয়া বিশ্বব্যাপী আজ ‘বড়দিন’। কেননা প্রায় দুই সহস্রাধিক বত্সর পূর্বে এইদিনে ফিলিস্তিনের পশ্চিম তীরে বেথেলহেম শহরে কুমারী মাতা মরিয়মের গর্ভে জন্মগ্রহণ করেন এক মহাপুরুষ। তাহার নাম যিশুখ্রিষ্ট। মুসলমানদের নিকট তিনি মাসিহ ইবনে মারইয়াম বা হযরত ঈসা (আ) নামে পরিচিত। ইংরেজিতে এই দিনটিকে খ্রিস্টমাস বলা হইলেও বাংলা সাহিত্যের অন্যতম দিকপাল ঈশ্বর চন্দ্র গুপ্ত ইহাকে ‘বড়দিন’ হিসাবে আখ্যায়িত করেন। খ্রিষ্টান ধর্মাবলম্বীদের বিশ্বাস অনুযায়ী বড়দিন মানে সৃষ্টিকর্তা ঈশ্বরের সবচাইতে বড় পরিকল্পনা বাস্তবায়নের শুরুর দিন। বড়দিন মানে মিথ্যা, চালাকি, প্রতারণা, ভণ্ডামি ও যাবতীয় পাপ কাজ ছাড়িয়া পুণ্যপথে চলিবার দিন।
খ্রিষ্টান ধর্মের শাস্ত্র অনুযায়ী ‘হেরোদ রাজার রাজত্বের সময়ে যিহুদিয়ার বৈেলহম গ্রামে একটি গোয়াল ঘরে পবিত্র আত্মার (পাক-রুহের) শক্তি দ্বারা কুমারী মরিয়মের মাধ্যমে যিশুখ্রিষ্ট জন্মগ্রহণ করেন।’ পবিত্র বাইবেলের লুক ১:৩০-৩৫ অধ্যায়ে তাঁহার এই ব্যতিক্রমী জন্মবৃত্তান্তের উল্লেখ রহিয়াছে। বেথেলহেমের নভোমণ্ডলে ঐ সময় একটি উজ্জ্বল নক্ষত্রের আবির্ভাব দেখিয়া সুদূরপ্রাচ্যের তিন জ্ঞানী ব্যক্তি মহাপুরুষ যিশুখ্রিষ্টের জন্মের বার্তা পান। তাহারা ভবিষ্যদ্বাণী করেন যে, এই শিশুই একদিন মানবতার ত্রাতা হিসাবে আবির্ভূত হইবেন। এই মহানপুরুষের মূলবাণীই ছিল ‘ভালোবাসা’। তাঁহার ধর্মে ‘ঈশ্বর’ ও ‘ভালোবাসা’ দুইটি ধারণাই পাশাপাশি উচ্চারিত হয়। ঈশ্বরকে কেবল ভক্তি বা ভয় নহে, তাঁহাকেও যে ভালোবাসা যায় এবং বিনিময়ে ঈশ্বরের নিকট হইতে নিছক করুণা বা দয়া নহে, সেই ভালোবাসাই পাওয়া যায়, খ্রিষ্ট-পূর্ব সময়কালে এমনটি ছিল বিরলদৃষ্ট।
যিশুকে যাহারা ভালোবাসেন, বাইবেলের বর্ণনা স্মরণ করিয়া প্রতি বত্সর ২৫ ডিসেম্বর তাঁহার জন্মদিবস উদযাপনে তাহারা গির্জা ও গৃহের উচ্চস্থানে তারকাসদৃশ আলো স্থাপন করিয়া থাকেন। এইরূপ আলোক সংকেতের মধ্য দিয়া জানানো হয় যে, একদিন যিনি অন্যায়, অত্যাচার, শোষণ হইতে মানুষকে মুক্ত করিতে একনিষ্ঠ ও সচেষ্ট ছিলেন, তিনি মানুষের সকল শোক, দুঃখের ভার গ্রহণ করিয়া আত্মত্যাগ করেন। তিনি শাসকের অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে শোষিত, বঞ্চিত ও নির্যাতিত মানুষের পক্ষাবলম্বন করিয়াছিলেন বলিয়া মাত্র ৩৩ বত্সর বয়সে তাঁহাকে ক্রুশবিদ্ধ করা হয়। ক্রুশে বিদ্ধ অবস্থাতেও তিনি ছিলেন ক্ষমাশীলতার অপূর্ব আলোয় উদ্ভাসিত। যেই সাতটি বাণী ক্রুশবিদ্ধ অবস্থায় তিনি উচ্চারণ করেন, তাহার প্রথম কথাটিই ছিল—ক্ষমা। তিনি বলেন, ‘পিতঃ, ইহাদিগকে (যাহারা তাহাকে ক্রুশবিদ্ধ করিয়াছে) ক্ষমা করো, কেননা ইহারা কি করিতেছে তাহা জানে না।’ এভাবে তিনি প্রেম, সেবা, ক্ষমা ও সৌহার্দের যে আদর্শ ধারণ করিয়াছিলেন, দুই সহস্র বত্সর পর আজও তাহা কোটি কোটি মানুষকে অনুপ্রাণিত করিয়া যাইতেছে। বড়দিন উপলক্ষে খ্রিষ্টান ধর্মাবলম্বী ভাই-বোনদের প্রতি আমরা জানাই আন্তরিক প্রীতি ও শুভেচ্ছা।