সিরাজগঞ্জের মেয়ে রূপার কথা এখনো হয়ত মনে রহিয়াছে অনেকের। বগুড়া হইতে ময়মনসিংহ যাইবার পথে গত বত্সর আগস্টে বাসের মধ্যে বীভত্স ধর্ষণের শিকার হয় রূপা। ধর্ষক বাসের চালক ও হেলপাররা এক পর্যায়ে অত্যন্ত নির্মমভাবে ঘাড় মটকাইয়া হত্যা করে রূপাকে। ওই ভয়াবহ ধর্ষণ ও হত্যাকাণ্ড ঘিরিয়া তীব্র প্রতিবাদের ঝড় ওঠে দেশব্যাপী। সাধারণভাবে ধর্ষণের অনেক ঘটনা প্রতিনিয়তই প্রকাশ পাইতেছে বিভিন্ন গণমাধ্যমে। সর্বশেষ গত রবিবার ঢাকার ধামরাইয়ে চলন্ত বাসে এক পোশাকশ্রমিক শিকার হন গণধর্ষণের। পুলিশ অবশ্য পাঁচ ধর্ষককে হাতেনাতে আটক করিতে সক্ষম হইয়াছে। জব্দ করা হইয়াছে বাসটিও। ধামরাই থানার পুলিশসূত্রে বলা হয়, ২৩ বত্সর বয়সী তরুণীটি ধামরাইয়ের শ্রীরামপুরের একটি পোশাক কারখানার কর্মী। গত রবিবার ছুটির পর রাত সোয়া ৯টার দিকে তিনি সাভারগামী যাত্রীসেবা পরিবহন নামের একটি বাসে ওঠেন। একপর্যায়ে অন্য যাত্রীরা নামিয়া গেলে বাসটির কর্মীরা তরুণীকে জোরপূর্বক ধর্ষণ করে। বাসটি জয়পুরা বাসস্ট্যান্ডের অদূরে পৌঁছাইলে মেয়েটি প্রাণরক্ষার্থে চিত্কার করেন। তাহা শুনিয়া ধামরাই থানার টহল পুলিশ ধাওয়া করিয়া বাসটিকে আটক করিতে সক্ষম হয়।
যেই পোশাকশ্রমিকেরা দেশের অর্থনীতিতে বিপুল অবদান রাখিয়া চলিতেছেন, তাহাদের যাতায়াত ও আবাসনের উপযুক্ত ব্যবস্থা কারখানার মালিকেরা সাধারণত করিতে পারেন না। নিত্যদিন তাহাদের ভোরে বা রাতে কর্মস্থলে যাওয়া-আসা করিতে হয়। ফলে সর্বদাই তাহাদের মুখোমুখি হইতে হয় বিভিন্ন রকম ঝুঁকির। আমরা দেখিতেছি, ঢাকা-আরিচা মহাসড়কে বাসচালক ও স্টাফদের দ্বারা নারী পোশাকশ্রমিকদের সম্ভ্রমহানির ঘটনা প্রায়শই ঘটিতেছে। অনেকক্ষেত্রেই লোকলজ্জার ভয়ে এই বিষয়ে পুলিশের নিকট অভিযোগও করা হয় না। তাহা ছাড়া কারখানা হইতে রাত্রিকালে বাসায় ফিরিবার পথেও তাহারা অনেক সময় নিগৃহীত হইয়া থাকে স্থানীয় মাস্তান বা সন্ত্রাসীদের দ্বারা।
পাঁচ বত্সর পূর্বে দিল্লিতে চলন্ত বাসে ধর্ষণ ও হত্যার ঘটনা ব্যাপক আলোড়ন তুলিয়াছিল ভারতজুড়িয়া। বিশ্বমিডিয়াতে ঠাঁই পায় সেই নৃশংস ঘটনা। দিল্লির ওই ঘটনার কয়েক মাস পর বাংলাদেশেও চলন্ত বাসে ধর্ষণের ঘটনা ঘটে। অপরাধবিজ্ঞানীর অনেকে মনে করেন, গণমাধ্যমে অপরাধের ফলাও প্রচারের কারণে অনেক সময় এই ধরনের অপরাধ উত্সাহিত হইতে পারে। অন্যদিকে ধর্ষণের অপরাধে লঘু শাস্তি বা বিচার না হওয়ার নজির বাংলাদেশে অনেক বেশি দেখা যায়। এই ব্যাপারে অনেক বিশ্লেষক মনে করেন, ধর্ষণের যত ঘটনা ঘটে, তাহার বৃহত্ একটি অংশ অপ্রকাশিতই থাকে। কেবল তাহাই নহে, এইসকল ঘটনা আদালত পর্যন্ত গড়ায় আরো কম। তাহা ছাড়া, ধর্ষণের কারণে একটি নারী নষ্ট হইয়া যায়—এমন পশ্চাত্পদ দৃষ্টিভঙ্গি অত্যন্ত গভীরে গাঁথিয়া রহিয়াছে আমাদের সমাজের মননে। ধর্ষণের ঘটনা চাপিয়া যাওয়া ও মামলা না হইবার নেপথ্যে এই দৃষ্টিভঙ্গিটিও গুরুত্বপূর্ণ। এইজন্য নারী-পুরুষ উভয়ে মিলিয়া নিরাপদ সমাজ ও পরিবেশ সৃষ্টিতে সামাজিক আন্দোলন গড়িয়া তোলা প্রয়োজন। পাশাপাশি নারী নির্যাতন ও ধর্ষণের ঘটনা প্রতিরোধে দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করিতে হইবে সরকারকে।