সংবাদ সংযোগ : বিদেশ থেকে অবৈধভাবে মাদকদ্রব্য মিথাইল অ্যালকোহল (মিথানল) আমদানি করছে আকিজ গ্রুপের প্রতিষ্ঠান আকিজ পার্টিকেল বোর্ড লিমিটেড। বৈধ লাইসেন্সের আড়ালে তারা অবৈধ এই কাজ করছে।
এমনকি লাইসেন্স পাওয়ার আগেই মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরসহ সংশ্লিষ্ট সরকারি দপ্তরের চোখ ফাঁকি দিয়ে ৫০৮ মেট্রিক টন মিথানল আমদানি করেছে। আর লাইসেন্সের আওতায় ৬ হাজার ৬২৩ মেট্রিক টন মিথানল আমদানির তথ্যও গোপন করেছে প্রতিষ্ঠানটি।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের সাম্প্রতিক এক তদন্ত প্রতিবেদনে চাঞ্চল্যকর এসব তথ্য উঠে এসেছে। সেই তদন্তে ধরা পড়েছে আকিজ পার্টিকেলের মিথানল আমদানির নানা কারসাজি। অধিদপ্তর এ তদন্ত প্রতিবেদনটি পর্যালোচনা করছে।
মিথানল ‘গ’ শ্রেণির মাদকদ্রব্য বলে জানিয়েছে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর। সম্প্রতি আকিজ পার্টিকেল তাদের সংশ্লিষ্ট লাইসেন্সে মিথানল আমদানির পরিমাণ (লিমিট) বৃদ্ধির আবেদন করে।
তাদের আবেদনটি নিয়ে তদন্তে নামে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর। এরপরই তদন্তে ফাঁস হয় এই গোমর। তদন্তকারী কর্মকর্তা প্রতিবেদনটি মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর ময়মনসিংহ জেলা কার্যালয়ের উপ-পরিচালকের কাছে জমা দিয়েছেন।
এদিকে ওই তদন্ত প্রতিবেদনের আলোকে মাদক নিয়ন্ত্রণে কাজ করা সরকারি এ সংস্থাটি বলছে, আকিজ পার্টিকেল মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরকে অন্ধকারে রেখে অবৈধ পন্থায় মিথানল আমদানি করেছে। তারা এসব মাদকদ্রব্য কী কাজে ব্যবহার করেছে, সে বিষয়টিও অধিদপ্তরের কাছে গোপন রেখেছে। যদিও আকিজ পার্টিকেল কর্তৃপক্ষের দাবি, ‘এটি ভুল বোঝাবুঝি’।
ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘আকিজ পার্টিকেল বরাদ্দকৃত কোটার বাহিরে অধিদপ্তরের অনুমতি ব্যতিত ৬৬২৩ মেট্রিক টন মিথানল আমদানি করেছে, যা মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন ২-১৮ এর ৬৩ নং আইন (সংশোধিত ২০২০) অনুযায়ী লাইসেন্সের শর্ত ভঙ্গের সামিল।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর ময়মনসিংহ জেলা কার্যালয়ের উপপরিচালক মোহাম্মদ খোরশিদ আলম ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘প্রতিবেদনটি পর্যালোচনা করা হচ্ছে। আইন অনুযায়ী সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’
ওই তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, আকিজ পার্টিকেল বোর্ড মিলসের মাদকদ্রব্য আমদানি লাইসেন্স নং ০১/২০২১-২০২২ এর অনুকুলে বার্ষিক বরাদ্দ ৫০ শতাংশ উত্তোলন কোটায় ২২ দশমিক ৫০ মেট্রিক টন বরাদ্দ রয়েছে। বর্তমানে বার্ষিক ১০ শতাংশ কোটায় ২২ হাজার ৫০০ মেট্রিক টনে বর্ধিত করার জন্য ২০২২ সালের ৪ আগস্ট আবেদন করে আকিজ পার্টিকেল।
প্রতিবেদনে তদন্ত কর্মকর্তা উল্লেখ করেন, আকিজ পার্টিকেল বোর্ড মিলস লিমিটেডের ম্যানেজার (এইচ আর এডমিন এন্ড সেইফটি) অনুকূলে বিগত ২০২০-২০২১ ও ২০২১-২০২২ অর্থ বছরে প্রতিষ্ঠানটিতে কী পরিমাণ মিথাইল অ্যালকোহল ব্যবহার করা হয়েছে জানতে চাওয়া হয়। এ বিষয়ে ২০২২ সালের ১৪ আগস্ট ও ৭ সেপ্টেম্বর মৈাখিক ও পত্রের মাধ্যেমে মিথাইল অ্যালকোহল ব্যবহারের তথ্য চাওয়া হয়।
তবে প্রতিষ্ঠানটি মিথাইল অ্যালকোহল (মিথানল) ব্যবহারের তথ্য না দেওয়ার কারণে ২০২২ সালের ১৮ অক্টোবর সঙ্গীয় ফোর্স নিয়ে আকিজ পার্টিকেল বোর্ড মিলস কারখানা পরিদর্শন করেন তদন্ত কর্মকর্তা।
প্রতিবেদেনে তিনি উল্লেখ করেন, পরিদর্শনকালে আকিজ পাটিকেল বোর্ড মিলসের ডিজি এম (এইচআর অ্যাডমিন অ্যান্ড সেইফটি) মামুন আক্তারসহ প্রতিষ্ঠানটির অন্যান্য কর্মকর্তা কর্মচারী উপস্থিত ছিলেন।
তদন্তকালে জানা যায়, মিথানল (মিথাই অ্যালকহল) পাটিকেল বোর্ড তৈরির অন্যতম কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহারের উদ্দেশ্যে বার্ষিক বরাদ্দ ৫০ শতাংশ উত্তোলন কোটায় ২ হাজার ২৫০ মেট্রিক টন মিথানল আমদানির লাইসেন্স প্রদান করা হয়।
তারা ২০২১ সালের ৭ নভেম্বর ১ম কোটা ১ হাজার ১২৫ মেট্রিক টন মিথাইল অ্যালকোহল আমদানির পূর্বানুমতির জন্য আবেদন করেন। ওই আবেদন দাখিলের প্রেক্ষিতে অত্র কার্যালয় হতে সুপারিশ করে অতিরিক্ত পরিচালক, বিভাগীয় কার্যালয়, ময়মনসিংহ বরাবর প্রেরণ করা হয়।
তদন্ত কর্মকর্তা প্রতিবেদনে আরও বলেন, মিথাইল অ্যালকোহল (মিথানল) মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর ২০১৮ সালে মিথাইল অ্যালকোহল ‘গ’ শ্রেণির মাদকদ্রব্য হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। এটি একটি তফসিলভুক্ত মাদকদ্রব্য। আবেদনকারীর আবেদন ও দাখিল করা কাগজপত্র, আমদানি রেকর্ড ও ভাউচার (বিল অব এন্ট্রি) পর্যালোচনা করে দেখা যায়, প্রতিষ্ঠানটি ২০১৯ সালে প্রায় ৫০৮ মেট্রিক টন মিথানল মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের লাইসেন্স ছাড়াই আমদানি করেছে।
পরবর্তীতে লাইসেন্স পাওয়ার পর নভেম্বর/২০২১ হতে সেপ্টেম্বর/২০২২ পর্যন্ত সর্বমোট ৭ হাজার ৭৪৮ মেট্রিক টন মিথানল আমদানি করেছে। প্রতিষ্ঠানটির ২০২১-২০২২ অর্থ বছরের বার্ষিক বরাদ্দকৃত কোটা ২ হাজার ২৫০ মেট্রিক টন। প্রতি কোটায় এককালীন উত্তোলন কোটা ৫০ শতাংশ হিসেবে ১ হাজার ১২৫ মেট্রিক টন।
অধিদপ্তর থেকে প্রতি কোটায় প্রথমবার মিথানল আমদানির অনুমতি নিলেও পরবর্তীতে তার বরাদ্দকৃত কোটার বাইরে অধিদপ্তরের অনুমতি ব্যতিত ৬ হাজার ৬২৩ মেট্রিক টন মিথানল আমদানি করেছে। যা মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন ২০১৮ এর ৬৩ নং আইন (সংশোধিত ২০২০) অনুযায়ী লাইসেন্সের শর্ত ভঙ্গের শামিল।
মাদকদ্রব্য আমদানি লাইসেন্সের শর্তানুযায়ী লাইসেন্সধারী প্রতিবার কোনো মাদকদ্রব্য আমদানির পর অধিদপ্তরের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে লিখিতভাবে রিপোর্ট করার বিধান রয়েছে। উক্ত কর্মকতার ব্যক্তিগত উপস্থিতি ও পরীক্ষা-নীরিক্ষা ছাড়া কোনো মাদকদ্রব্যের কোনো মোড়ক খুলতে বা বিক্রয় কিংবা উৎপাদন কাজে ব্যবহার করা যাবে না।
তবে আকিজ পার্টিকেল বোর্ড মিলস এসব নিয়মের ধার ধারেনি। প্রতিষ্ঠানটি প্রথম কোটাসহ পরবর্তী ৬ হাজার ৬২৩ মেট্রিক টন মিথানল আমদানির কোনো তথ্য এবং মোড়ক খোলার সময় মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাকে অবহিত করেনি।
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে আকিজ পার্টিকেল বোর্ড মিলসের ম্যানেজার শাহরিয়ার জামান ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘আমাদের প্রতিষ্ঠান রেগুলার বেসিসে মিথানল আমদানি করে থাকে। কোথাও একটু ভুল বোঝাবুঝি বা মিসকমিউনিকেশন হয়েছে।’