দেশে যেন ধর্ষণের মহোৎসব চলছে। শিশু থেকে বয়স্ক নারী পর্যন্ত কেউই পশুরূপী মানুষের ধর্ষণের কবল থেকে রেহাই পাচ্ছে না। নগর থেকে প্রত্যন্ত গ্রাম পর্যন্ত কোথাও না কোথাও প্রায় প্রতিদিনই ধর্ষণের ঘটনা ঘটছে। এসব ঘটনার সামান্যই পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। তারপরও এ সংখ্যাটি উদ্বেগজনক আকার ধারণ করেছে। কেবল যেসব ঘটনা জানাজানি হয়, সেগুলোই প্রকাশিত হচ্ছে। এর বাইরে যে অসংখ্য ঘটনা রয়েছে, তাতে সন্দেহ নেই। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, প্রায় নব্বই শতাংশের উপরে ধর্ষণের ঘটনা প্রকাশিত হয় না। লোকলজ্জা, পারিবারিক ও সামাজিক লজ্জার কারণে এসব ঘটনা আড়ালেই থেকে যায়। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের প্রতিবেদন অনুযায়ী, এ বছরের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৫৮৮টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটে এবং ধর্ষণের পর ৩৩ জনকে হত্যা করা হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে এ সংখ্যাটি যে হাজার ছাড়িয়ে যাবে, তাতে সন্দেহ নেই। মূলত যেসব ধর্ষণের ঘটনা জনসমক্ষে আসে এবং জানাজানি হয় কিংবা ধর্ষণের শিকার মহিলারা মামলা ও বিচারপ্রার্থী হয়, সেগুলোই কেবল প্রকাশিত হয়। মাস দুয়েক আগে টাঙ্গাইলে এক তরুণী বাসের মধ্যে বাসের কন্ডাক্টরসহ অন্যদের দ্বারা গণধর্ষণ এবং হত্যার শিকার হয়। এ ঘটনায় দেশব্যাপী তোলপাড় হয়। এর রেশ কাটতে না কাটতেই গত বুধবার রাজশাহীতে স্বামীকে বেঁধে রেখে তার স্ত্রীকে সন্ত্রাসীরা ধর্ষণ করে। একই দিনে নোয়াখালির সুবর্ণচর উপজেলার চরবাটা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান কর্তৃক এক তরুণী ধর্ষিত হয়। ধর্ষিতা প্রতারণার বিচার চাইতে গেলে উল্টো আটকে রেখে চেয়ারম্যান তাকে ধর্ষণ করে। একের পর এক ধর্ষণের ঘটনা বৃদ্ধিতে মানুষের নীতি-নৈতিকতা ও মূল্যবোধের চরম অবক্ষয়ের বিষয়টিই যে সামনে এসে পড়ছে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
সমাজে যখন শাসন-বারণের শৈথিল্য, মূল্যবোধের ক্ষয়িষ্ণুতা বৃদ্ধি পায় এবং আইনের শাসন দুর্বল হয়ে পড়ে, তখন নানা নেতিবাচক দিক মাথাচাড়া দিয়ে উঠে। নিপীড়ন, নির্যাতন, বিচারহীনতা, খুন, ধর্ষণ, মান্যগণ্যহীণতা দেখা দেয়। দুর্বৃত্তের আস্ফালন বৃদ্ধি এবং সমাজ কাঠামো ভেঙ্গে পড়ে। সময়ের সাথে জীবনযাপন এবং আচার-আচরণের পরিবর্তন হওয়া স্বাভাবিক, তবে তা সমাজের মূল ছকের মধ্যে থেকেই হওয়া বাঞ্চনীয়। আমাদের পরিবার ও সমাজের যে হাজার বছরের মূল্যবোধ, তা সারা বিশ্বেই প্রশংসিত এবং অনুকরণীয়। দুঃখের বিষয়, যতই দিন যাচ্ছে তার পরিবর্তন নেতিবাচক দিকে ধাবিত হচ্ছে। পারস্পরিক সম্মানবোধ লোপ পাচ্ছে। ধর্ষণ এবং খুনের মতো নৃশংস ও বর্বর ঘটনা বৃদ্ধি তারই ইঙ্গিত দিচ্ছে। এসব ঘটনার সাথে প্রধানত নীতি-নৈতিকতা বিবর্জিত প্রভাবশালী চক্র জড়িয়ে আছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এরাই সমাজের চালক হয়ে আছে। অপরাধমূলক ঘটনার শিকার ব্যক্তি ঘটনার প্রতিকার চাইতে গেলে উল্টো হয়রানির শিকার হচ্ছে। একজন ধর্ষিতার ক্ষেত্রে প্রতিকার পাওয়ার বিষয়টি আরও বেশি অবমাননাকর এবং কঠিন। এমনও দেখা গেছে, ধর্ষণকারীর বিচারের পরিবর্তে ধর্ষিতাকে বিচার এবং নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছে। এটা সম্ভব হচ্ছে, সমাজের সুকুমারবৃত্তিসম্পন্ন বিবেকবানদের নীরবতা এবং ঘটনা এড়িয়ে যাওয়ার কারণে। তারা তাদের নিজ দায়িত্ব এবং প্রভাব সম্পর্কে উদাসীন। এ ধরনের মানসিকতার কারণে অপরাধী প্রশ্রয় পেয়ে আরও দোর্দন্ড প্রতাপশালী হয়ে উঠছে। এদের প্রভাবের দ্বারাই অনেক সময় আইনের গতিপথ নির্ধারিত হয়। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একশ্রেণীর সদস্যও অপরাধীদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। ফলে ধর্ষণের মতো স্পর্শকাতর ঘটনার তদন্ত এবং অপরাধীকে শাস্তির আওতায় আনা দুষ্কর হয়ে পড়ে। আইন প্রয়োগের এই দুর্বলতার কারণে ধর্ষণকারীরা অনেক সময় পার পেয়ে যায় এবং ধর্ষিতাকে হুমকি-ধমকি দিয়ে চুপ করিয়ে দেয়া হয়। সমাজে এখন এমন একটা প্রবণতা বিরাজমান, যেখানে ধর্ষণকারী নয়, ধর্ষিতাকে নানা সামাজিক প্রতিকূলতার সম্মুখীন হতে হচ্ছে। যেন ধর্ষণের শিকার হয়ে ধর্ষিতাই অপরাধ করে ফেলেছে। দেখা গেছে, অনেক ক্ষেত্রে ধর্ষণের বিচার চাইতে গিয়ে ধর্ষিতাই দোষারোপের শিকার হয়েছে। এই মানসিকতা থেকে বের হয়ে আসতে না পারলে ধর্ষণের ঘটনা কোনোভাবেই রোধ করা সম্ভব নয়। বলা বাহুল্য, প্রযুক্তি ও যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতির ফলে সবকিছু মানুষের নাগালের মধ্যে। মানুষের জীবনও গতিপ্রাপ্ত হয়েছে। বিশেষ করে নারীদের চলাচল বৃদ্ধি পেয়েছে। এ অনুপাতে জননিরাপত্তার বিষয়টি সমান্তরালে এগুচ্ছে না। এ সুযোগে দুর্বৃত্তরা বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। চলন্ত যানবাহন থেকে শুরু করে রাস্তা-ঘাট থেকে তুলে নিয়ে ধর্ষণের মতো ঘটনা বৃদ্ধি পাচ্ছে।
দেশব্যাপী যে হারে ধর্ষণের ঘটনা বৃদ্ধি পেয়েছে, তাতে উদ্বিগ্ন না হয়ে পারা যায় না। স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন উঠে, এ কোন বর্বরতার মধ্যে আমরা বসবাস করছি? এ থেকে পরিত্রাণের উপায় কি? অসভ্যতা ও বর্বরতা প্রতিরোধে আইনের কঠোর প্রয়োগ এবং সামাজিক মূল্যবোধ বৃদ্ধির বিকল্প নেই। এ ব্যাপারে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে কার্যকর ভূমিকা পালন করতে হবে। ধর্ষণের অভিযোগ এবং তা প্রমাণের ক্ষেত্রে দীর্ঘসূত্রিতা পরিহার করতে হবে। তদন্ত কাজে ঢিলেমি বা বছরের পর বছর ধরে মামলা যাতে ঝুলে না থাকে, এ ব্যবস্থা করতে হবে। ধর্ষিতার সুরক্ষা নিশ্চিত করে তাকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনতে হবে। এক্ষেত্রে পরিবার ও সমাজের মানুষকে সহমর্মী হয়ে তার পাশে দাঁড়াতে হবে। অন্যদিকে ধর্ষণকারীকে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে, যাতে আর কেউ এই অপকর্মে না জড়ায়। সমাজ থেকে ধর্ষণ ও অন্যান্য অনৈতিক অপকর্ম প্রতিরোধে পারিবারিক ও সামাজিক নীতি-নৈতিকতা এবং মূল্যবোধের চর্চা বৃদ্ধি করতে হবে। আমাদের চিরায়ত মূল্যবোধ এবং ধর্মীয় বিধি-নিষেধ ও আচরণ মেনে চলতে প্রত্যেককে উৎসাহী করে তুলতে হবে। আধুনিকতা মানে উচ্ছৃঙ্খলতা বা নৈতিকতা হারানো নয়, বরং নিজেকে আরও সভ্য করে তোলার উপায়Ñএ মানসিকতা সবার মধ্যে জাগ্রত করতে হবে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও পাঠ্যপুস্তকে নীতি-নৈতিকতার বিষয়গুলোকে আরও ব্যাপকভাবে তুলে ধরতে হবে।