গাজীপুরে মাটি খুঁড়ে মধ্যযুগের একডালা দুর্গের সন্ধান দুর্গের প্রত্নতত্ত্ব নিদর্শন দেখতে দর্শনার্থীদের ভিড়। ছবি: সংগৃহীত
মাটি খুঁড়ে সন্ধান মিলেছে ১৪শ’ বছর পুরোনো তথা মধ্যযুগের একটি একডালা দুর্গের। দুর্গটি ৬০০ সালে নির্মিত হয়েছিল বলে জানাচ্ছেন প্রত্মতাত্ত্বিকরা। গাজীপুরের কাপাসিয়া উপজেলার রায়েদ ইউনিয়নের দরদরিয়া এলাকায় এ দুর্গটি আবিষ্কার হয়েছে।
জানা গেছে, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ড. সুফি মুস্তাফিজুর রহমানের নেতৃত্বে একদল বিশেষজ্ঞ গত ২৬ ডিসেম্বর দরদরিয়া এলাকায় প্রত্নতাত্ত্বিক খনন ও গবেষণা কাজ শুরু করেন। খনন শুরুর পর সেখান থেকে বের হয়ে আসছে প্রাচীন স্থাপত্যের বিভিন্ন ইতিহাস ও ঐতিহ্যের নিদর্শন।
সেখানে পাওয়া যাচ্ছে, প্রাচীনকালে নিরাপত্তা কৌশল ও স্থাপত্য শৈলীর বিচক্ষণতার চিহ্ন। একপর্যায়ে মধ্যযুগের ইট দিয়ে নির্মিত প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন মধ্যযুগের একটি দুর্গের সন্ধান পাওয়া গেছে।
ইতিহাস ও বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, দুর্গটি আনুমানিক ৬০০ খ্রিস্টাব্দের দিকে বানিয়া রাজা দুর্গটি নির্মাণ করেছিলেন। দুর্গটির দৈর্ঘ্য ছিল ৫ কিলোমিটার আর প্রস্থে ছিল ২ কিলোমিটার।
ইলিয়াস শাহ বাংলার স্বাধীন সুলতান হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার পর, দিল্লীর সুলতান ফিরোজ তুঘলকের সম্ভাব্য আক্রমণ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য ১৩৫২ খ্রিষ্টাব্দের দিকে দুর্গটির সংস্কার সম্পন্ন করেন। ১৩৫৩ খ্রিষ্টাব্দে ফিরোজ তুঘলক বাংলা আক্রমণ করলে, ইলিয়াস শাহ কোনো বাধা না দিয়ে এই দুর্গে আশ্রয় নেন। ওই সময় ফিরোজ তুঘলক দুর্গটি দখল করতে পারেনি। কয়েক মাস অবরুদ্ধ থাকার পর, উভয় বাহিনীর মধ্যে যুদ্ধ হলে, বাংলার সৈন্যরা পরাজিত হয় কিন্তু তখনও একডালা দুর্গ অপরাজেয় ছিল। অবশেষে হতাশ হয়ে ফিরোজ তুঘলক দিল্লী ফিরে যান। পরে উভয়ের ভেতরে শান্তি স্থাপিত হয়।
১৩৫৭ খ্রিষ্টাব্দে ইলিয়াস শাহ মৃত্যুবরণ করলে বাংলার সিংহাসনে বসেন তার ছেলে সিকান্দার শাহ। ইলিয়াস শাহের মৃত্যুর পর ফিরোজ তুঘলক পুনরায় বাংলা আক্রমণ করেন। এবারও পিতার মতো সিকান্দার শাহ একডালা দুর্গে আশ্রয় নেন। কয়েকমাস এই দুর্গ অবরোধ করে রাখার পর ফিরোজ তুঘলক সন্ধি করেন।
এরপর ফিরোজ তুঘলক বাংলার স্বাধীনতা মেনে নিয়ে দিল্লীতে ফিরে যান। এরপর ১৫১৮ খ্রিষ্টাব্দ হতে ১৫৩২ খ্রিষ্টাব্দের ভেতরে আলাউদ্দিন হোসেন শাহের ছেলে নাসির উদ্দিন শাহ পুনরায় দুর্গটি সংস্কার করেন।
রায়েদ ইউনিয়নে কালী বানার নদীর পূর্ব তীরে অবস্থিত দরদরিয়া দুর্গ ছিল একডালা দুর্গের শাখা দুর্গ। মোগল সম্রাট আকবরের সময়ে রাজা টোডরমল এ অঞ্চলকে ভাওয়াল পরগণায় অন্তর্ভুক্ত করেন। ক্রমে ক্রমে এই দুর্গটি পরিত্যক্ত হয়।
দুর্গটির বাইরের প্রাচীর মাটি দ্বারা নির্মিত। প্রাচীরের উচ্চতা ১২-১৪ ফুট। প্রাচীরের পরিধি প্রায় ২ মাইল এবং এর প্রস্থ প্রায় ৩০ ফুট। দুর্গের ৫টি প্রবেশদ্বার ছিল, তবে ইট বা পাথর নির্মিত প্রবেশদ্বার বা তোরণের কোন চিহ্ন পরিলক্ষিত হয়নি। প্রাচীরটি অর্ধচন্দ্রাকার করে নির্মিত। এই প্রাচীরের কিছুটা দূরে আরেকটি প্রতিরক্ষা প্রাচীরের চিহ্ন রয়েছে। এটি ইট দিয়ে নির্মিত।
অনুমান করা হয় যে, এই প্রাচীরে তিনটি প্রবেশদ্বার ছিল। দুর্গটি ‘রানির বাড়ি’ নামে পরিচিত। বলা হয়, বানিয়া রাজাদের শেষ বংশধর রানি ভবানী ১২০৪ খ্রিষ্টাব্দে মুসলিম অভিযানের সময় এই দুর্গে বসবাস করেছিলেন।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক সুফি মোস্তাফিজুর রহমান জানান, কাপাসিয়ায় রানির বাড়ি বা দুর্গে খনন কাজ গত ২৬ ডিসেম্বর শুরু হয়। প্রাথমিক জরিপে দুর্গের আকার আকৃতি পরিমাপ করা হয়েছে। পূর্বদিকে অর্ধচন্দ্রের পরিধিব্যাপী পরিখা এবং পশ্চিমের দিকে রয়েছে বানার নদ। দুর্গটি প্রকৃতি এবং মানব সৃষ্ট এক দারুণ কৌশলগত প্রতিরক্ষার কথা চিন্তা করে নির্মাণ করা হয়েছে। এটি সমতল ভূমি থেকে মাটির নিচে ২ মিটার পর্যন্ত বিস্তৃত।
ইটের গাঁথুনি দিয়ে নির্মিত দেয়ালের প্রশস্ত ৬৫ সেন্টিমিটার। প্রাচীরের উপরের অংশগুলি ধ্বংসপ্রাপ্ত রয়েছে। এটি মূলত একটি প্রতিরক্ষা দুর্গ হিসেবে তৈরি করা হয়েছিল। সামরিক দিক বিবেচনায় বুরুজটি খুবই কৌশলগত স্থাপনা। এর অংশ থেকে সহজে সোজা ডানে এবং বামে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ছিল অর্থাৎ ঐ স্থান থেকে গোলা বারুদ বা তীর নিক্ষেপ করা যেত। দুর্গটির চারপাশে বর্তমানে কৃষি জমি, চালা জমি রয়েছে। গজারি বন-জঙ্গল যা প্রায় ১৫ কিলোমিটার ব্যাপী বিস্তৃত। দুর্গটি ছিল তিন স্তর বিশিষ্ট। যা প্রাচীনকালে ছিল খুবই শক্তিশালী দুর্গ। দ্বিস্তর বিশিষ্ট দুর্গ ভারতবর্ষে হাতে-গোনা মাত্র কয়েকটি।